ক’
দিন আগে কয়েকজনের কাছ থেকে মধ্যরাতে রাতে একের পর এক একটা লিঙ্ক পাই। সেটা ছিল কানাডার মূলধারার সংবাদ মাধ্যম সিটিভি’র একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি তৈরী করা হয়েছে, কানাডার অন্টারিও প্রাদেশিক পরিষদের বিভিন্ন দলের ৪০ জন সদস্যদের (এমপিপি) স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে। মানে কার কয়টা বাড়ী আছে, সেগুলো তারা যখন কিনেছেন, এখন তার দাম কত এবং কে কতটা লাভবান হয়েছে, সে হিসেবটা দেখানো হয়েছে।
সেখানে অন্টারিও প্রাদেশিক পরিষদের প্রথম বাংলাদেশি বংশদ্ভুদ ডলি বেগমের নাম আছে। এই সংবাদটি এমন সময় প্রকাশিত হয়েছে যখন নির্বাচনের আর মাত্র ১২দিন বাকি। কেন এমন সময় সংবাদটি প্রকাশিত হলো? কারা তা প্রকাশ করলো? তাদের স্বার্থ-সমীকরণ কি? সে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। সে ভাবনা মাথায় না থাকলে, চিলের পিছনেই দৌড়োতে হবে কিন্তু কান আর মিলবে না।
আমার ফেসবুকে কানাডার মূলধারায় বেড়ে ওঠা অনেক বন্ধু আছেন। কিন্তু সংবাদ লিংকটা আমি তাদের কারো কাছ থেকে পাইনি। পেয়েছি কানাডায় বাংলাদেশী অভিবাসিদের কাছ থেকে। সেখানে তাদের কয়েকজনের মন্তব্যও আছে। সে মন্তব্যগুলো অত্যন্ত নেতিবাচক ও আপত্তিকর। কিন্তু তারা যে ধরণের মন্তব্য করেছেন তার সাথে ব্যক্তি ডলি’র নীতি-নৈতিকতা ও নেতৃত্বের কোন সম্পর্ক নেই। আসলে প্রতিবেদনটা তারা ভাল করে পড়েছেন কিনা তাতে আমি সন্দিহান। সেখানে ডলি সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলাও হয়নি। বিষয়টা না বুঝে একজন পাবলিক ভিগার সম্পর্কে এমন মন্তব্য অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায়। এই নেতিবাচক প্রচারণা শুধু ডলির জন্য অসম্মানের নয়, আমাদের দেশের জন্যও অমর্যাদার। সেই কারণেই বিষয়টি নিয়ে কথা করছি।
প্রতিবেদনে যে ৪০ জন এমপিপি’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তারমধ্যে রক্ষনশীল দলের ২৭ জন, এনডিপি’র ১৫ জন এবং লিবারেলের ৪ জন। তন্মধ্যে এনডিপি’র ডলি বেগমের নাম আছে। সেখানে হয়েছে, ডলি মূলত একটি বাড়ীর মালিক। তার বাবা বাকি দুটোর মালিক। আর একটি তার ভাইয়ের জন্য কেনা। একটু দেখে নেয়া যাক তাদের বাড়ী ক্রয় ও মালিকানার বিষয়টি।
ডলি’র বাবা ২০০৫ সালে প্রথম বাড়ী ক্রয় করে তখন সে শিশু ছিল। তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। ডলি বিয়ের আগ পর্যন্ত সেখানেই থাকতেন। ২০১৪ সালে তারা দ্বিতীয় বাড়ীটি ক্রয় করেন। তার ভাই সেটা ক্রয় করেন। এই দুই বাড়ীর কোনটাতেই ডলির মালিকানা নেই। ডলি লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে যোগদানের পর ২০১৩ সালে সে প্রথম নিজ অর্থে বাড়ী কেনেন। বর্তমানে যেখানে সে তার স্বামীকে নিয়ে বাস করেন। ২০২০ সালে তাদের পরিবারের পক্ষ আরেকটি বাড়ী ক্রয় করা।
ডলির পরিবারের পক্ষ থেকে ২০০৫ থেকে ২০২০ এর মধ্যে যে বাড়ীগুলো কেনা হয়েছে সেগুলোর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দাম বৃদ্ধিতে ডলির কি কোন দায় আছে? সম্পদের দাম বৃদ্ধি অর্থনীতির একটি সাধারণ প্রবণতা। তবে এ কথা সত্য, অন্টারিওতে গতকয়েক বছরে বাড়ীর দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। সে জন্য দায়ী যারা আবাসিক খাত ও ব্যাবসার সাথে যুক্ত তাদের। সেখানে ডলি তার পরিবার অন্যান্য সাধারণ ক্রেতার মতই এর সুবিধাভোগী।
যারা এই প্রতিবেদনকে নিয়ে- বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন ও নেতিবাচক আলোচনা করছেন তাদের কাছে জিজ্ঞাসা।
১। বৈধ অর্থ দিয়ে বাড়ীর কেনা ও তার দাম বাড়ার সাথে কি ডলির নীতি-নৈতিকতা, নেতৃত্ব ও রাজনীতির কোন সম্পর্ক আছে?
২। একজন রাজনীতিকের জন্য তা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেন্স হয় কিভাবে? সে কি হাউজিং ব্যাবসা বা বাড়ী-কেনা-বেচার সাথে যুক্ত?
৩। ডলি’র পরিবারের বাড়ীর দাম বাড়ার সাথে এফোর্ডএবল হাউজিং এর দাবী কিভাবে সাংঘর্ষিক?
৪। বিষয়টা কি এমন যে, শুধু ডলি’র বা তার নির্বাচনী এলাকার বাসার দামই বেড়েছে? অন্যস্থানে বা অন্যদের বাড়ীর দাম বাড়েনি?
৫। নির্বাচিত নেতা হিসেবে সে কি কারসাজি করে বাড়ীর বাড়িয়ে- সুবিধা নিয়েছে, মুনাফা করেছে?
৬। সে কি কোন সরকারি প্রকল্পের অর্থে নিজের বাড়ী কেনার কাজে ব্যবহার করেছে?
৭। নিজেরসহ অন্যদের বাসা-বাড়ীর দাম বাড়লে কি কেউ ‘এই খাতের নিয়ন্ত্রণ, নীতিমালা ও শৃংখলা’ চাইতে পারে না? তা চাইলে কি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হয়?
না তা হয় না। বর্তমানে বিমান টিকিটের দাম কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি অবশ্যই তার দাম কমার পক্ষে কিন্তু একই সাথে প্রয়োজনে আমাকে বাড়তি অর্থ দিয়ে ভ্রমন করতে হচ্ছে- তাহলে আমার সেই চাওয়া কি সাংঘর্ষিক? বিষয়টা এমন হলে বলতে হয়- আমাদের সমাজে স্বার্থ-সংঘাতের দ্বন্দ্ব অন্তহীন।
কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের ওয়েব ডেফিনেশন বলছে, যখন একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক অবস্থানের কারণে অবিশ্বস্ত হয়ে পড়েন তখন এই দ্বন্দ্ব ঘটে। এ ধরনের সংঘাতের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ নিহিত থাকে। তেমন পরিস্থিতিতে কর্ম বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরিস্থিতি তৈরী হলে- তাকে/তাদের সাধারণত সরিয়ে দেয়া হয়।
সম্পদের দাম বৃদ্ধির সাথে বাজার ও অর্থনীতির অনেক কারণ-সমীকরণ যুক্ত। তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে কি কারণে? সাধারণ মানুষের এই দূর্ভোগের সাথে কাদের স্বার্থ-দ্বন্দ্ব-সুবিধা জড়িত? অর্থনীতি-রাজনীতির সাধারণ জ্ঞান যার আছে তিনিও জানেন এর কারণ-সমীকরণ ও চাহিদা-যোগান সূত্র। কর্পোরেটের বাজার নিয়ন্ত্রণ, কৃত্তিম সংকট মনোপেলির বিষয়টিও জানি। শুধু বাসা-বাড়ীর নয় স্বর্ণালঙ্কারের দামও কয়েকগুণ বেড়েছে। তাহলে সে আলাপ কোথায়?
ডলি যদি বাড়ী কেনা-বেচার ব্যবস্যা করতো, এই খাতের একজন নিয়ন্ত্রক হতো তাহলে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের প্রশ্ন আসতো। কিন্তু এখানে বিষয়টি মোটেই তা নয়। ডলি ও তার পরিবার যে বাড়িগুলো কিনেছে তার কোনটাই তারা বিক্রী করেনি। তাহলে ধরে নেয়া যায় এগুলো তাদের থাকা ও নিরাপত্তার জন্যই ক্রয় করেছে। এটা নিয়ে এমন সংবাদ বিভ্রান্তি ও দূরভিসন্ধি বৈ অন্য কিছু নয়।
তাহলে কেন একে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ করা হলো? ডলির নাম কেন সেখানে অন্তর্ভূক্ত করা হলো? এটা কি কোন উদ্দেশ্যমুলক প্রতিবেদন? তাঁর নির্বাচনকে কি কোন ভাবে প্রভাবিত করার দূরভিসন্ধি? নাকি এফোর্ডএবল হাউজিং এর দাবী-প্রয়োজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই সেটা করা হয়েছে? সে সব প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
– ড. মঞ্জুরে খোদা (টরিক) লেখক-গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।