শাহ আব্দুল হান্নান নামের একজন প্রয়াত সরকারি কর্মকর্তার ‘সততা’র সুনাম নিয়ে একটি জাতীয় পত্রিকায় অবিচুয়ারি লেখায় বিক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উদারনৈতিক হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ সমর্থক কয়েকজন সাংবাদিক। এদের কেউ কেউ ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বর্তমানে একই সঙ্গে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে নিরাপোষ ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে শিরোধার্য জাস্টিফিকেশন-ইজমেরও আপোষী অনুশীলক।
মি হান্নানকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তিনি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ উগ্রবাদে পরিণত হয়ে একাত্তরে গণহত্যা ঘটিয়েছিলো। সে কারণে তার অবিচুয়ারিতে ‘সততা’র সুনামে প্রতিবাদের সুনামী নিয়ে হাজির শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের নেতাদের কেউ কেউ। তাদের যুক্তি হচ্ছে মানবতা বিরোধী অপরাধে দোষী প্রমাণিত জামায়াতের একজন সমর্থক হান্নান শাহ নিজে মানবতাবিরোধী অপরাধী না হলেও মানবতাবিরোধী সংগঠনের সদস্য হবার কারণে ঢাকার সাংস্কৃতিক জোটের গোত্রচ্যুত হয়েছেন। বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক বলয় নির্ধারণ করে দেয়, মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের নেমেসিস নাসিমের মৃতদেহকে সম্মান জানাতে হবে; আর হান্নান-এর মৃতদেহকে জুতা ছুঁড়তে হবে।
মানবতা বিরোধী অপরাধ কেবল ‘একাত্তর সালে’ ফেভিকল দিয়ে আটকে রাখা প্রপঞ্চ নয়। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়াতে বাংলাদেশে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছেন; তারা গত ৫০ বছর ধরে মানবাধিকার হনন করেছেন। হত্যা-ধর্ষণ-উচ্ছেদ-লুন্ঠন; এরকম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত একাত্তরের ‘রাজাকার’দের একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধ আদালতে বিচার করা হয়েছে।
হত্যা-ধর্ষণ-উচ্ছেদ-লুন্ঠন করেছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, জামায়াত-হেফাজত সদস্যরা; গত ৫০ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দেশের জিডিপি গ্রোথ, মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি, ব্যাংক রিজার্ভ বৃদ্ধি করে চলেছেন ৫০ বছরের প্রতিদিন। আর ৫০ বছর ধরে কোন দলের টিকেট নিয়ে গণতন্ত্রের টেবিল ডান্স বারে ঢুকে; নৈতিকতার স্ট্রিপট্রিজ দেখে; দেশ লুন্ঠন করেছেন; প্রতি পাঁচবছরের ৩০০ জন নাগরিক। তাদের দলীয় পরিচয় যাই হোক; তারা নির্বাচনে জেতার দিন যে পরিমাণ সম্পদের মালিক ছিলেন; ৫ বছর পর সে ব্যক্তিগত সম্পদ বেড়েছে ১০০ গুণ। যারা আপাত সৎ; তাদেরও আত্মীয় স্বজনেরা সম্পদ একশোগুণ বাড়িয়ে এই মিথকে নির্ভুলভাবে প্রমাণ করেছে; সরকারের অন্য নাম থাগস অফ বেঙ্গল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, চোরের খনি।
এদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে লিপসার্ভিস দেয় যে ইতিহাসবিদ; সেও ব্যাংকের পরিচালক হয়ে; শাকান্ন ফেলে; শাক দিয়ে মাছ ঢাকে। যে সাংবাদিক জাস্টিফিকেশান লিখে দুর্নীতিবাজ সরকার টিকিয়ে রাখে, তাদের বঙ্গবন্ধু, চাটার দল বলে গেছেন। এই চাটার দলও কিন্তু আর্থিকভাবে বেনিফিশিয়ারি হয়। প্লট-পদক-চাকরির নিশ্চয়তা-ক্ষমতার শিহরণ চাটার দলের মূল প্রেরণার জায়গা। নো লিপ সার্ভিস ইজ ফ্রি।
এই যে ক্ষমতাসীন সরকার ২০১৪ সালের পর যে লিপ সার্ভিস দিয়ে ‘দেশপ্রেম চেতনার স্বয়ম্ভু’ হয়ে টিকে আছে। একে বলা যায় ডাকাতের সহমত ভাইয়ের বড় গলা। ‘প্রাইম মিনিস্টার’স’ মেনদের হাতে পুলিশ, এলিট ফোর্স, প্রশাসন, মিডিয়া নাচে; গণতন্ত্রের বস্ত্র বিসর্জনের নৃত্যের আসরে।
নিহত বিশ্বজিত দাসের শরীরে আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পায়না সরকারি সহমত ডাক্তার; কার্টুনিস্ট কিশোরের শরীরেও নো ওয়ান টাচড; এমনই সব ময়না তদন্তের দেশে; সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক বলয়ের লোক খুব আয়েশ করে, কুঁচ কুঁচ কইরা পুরোহিতের মতো ‘জামায়াতের শাহ’-কে গোত্রচ্যুত কইরা শূদ্র ঘোষণার পূজো-আর্চা শুরু করে। নিও রুলিং এলিট মানেই যেন ব্রাহ্মণ ; বিশুদ্ধতার পরাকাষ্ঠা; দেশপ্রেম টিপেটুপে যে পাপ-পুণ্যের বিচার এই পৃথিবীতেই করবে। আঙ্গুল তুলে দেকিয়ে দেবে; স্বাস্থ্যখাত লুন্ঠন করা কাছিমের লাশ শহীদ মিনারে এলে তাকে ফুল দিয়ে বরণ করতে হবে। আর হান্নানের লাশের দিকের পাথর ছুঁড়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিতে হবে; বা পাকিস্তানে পাঠাইয়া দিতে হবে।
আবার সমসাময়িক জাস্টিফিকেশান লীগের কন্ঠে মানবতা বিরোধী অপরাধ কেবল একাত্তরে আর বিএনপি-জামাতের আমলে সংঘটিত হয়েছে; আর আওয়ামী লীগ-জাসদ-মহাজোট-হেফাজতের আমলে ‘নো ওয়ান কিল্ড তনু’; নো ওয়ান কিল্ড ত্বকী-সাগর-রুনি। অন্যদেশের কোম্পানি থাকে; আর কোম্পানির একটি দেশ আছে। সুতরাং ‘মুনিয়া হত্যার’ অভিযুক্ত আসামি বসুন্ধরা পুত্রের বিচার চেয়ে মানববন্ধন পণ্ড করে দেয়; হেলমেট ও হাতুড়ির ( বঙ্গবন্ধুর ভাষায় এন এস এফ-এর) পাণ্ডারা। নব্য রুলিং এলিট বামুন পুরোহিতের জ্ঞানের ভারে এক চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। খোলা চোখটিতে কেবল হান্নানের পলিটিক্যাল ইনকারেক্ট নেস চোখে পড়ছে। কিন্তু নাসিমের স্বাস্থ্যখাত উজাড় ও ব্যক্তিগত সম্পদ পশ্চিমে সেকেন্ড প্যালেসে জমা হবার পলিটিক্যাল ইনকারেক্টনেস; এ দলান্ধের চোখে পড়বে না।
এদের আবার ধর্মের কার্ড প্লে করা পলিটিক্যাল প্লে বয় এরশাদকে গোত্রচ্যুত করে আবার বিশেষ দূত করে তুলে আনতে হয়েছে; এরশাদের কাঁটা দিয়ে খালেদার কাঁটা তুলতে। হেফাজতের সঙ্গে শোকরানা মেহেফিলে নানালাস্যে হেসেছিলো তারা নিউমদিনার নেশায়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত গোত্রে কাউকে জোর করে ঠেলে দেয়া গেলেই যেন, শূদ্র করে দেয়া গেলো; এরকম প্রশান্তির হাসি সরকারের চাটার দল ব্রাহ্মণ সেজে গালফোলানো পুরোহিতের। শত বছরের শূদ্র জীবন যাপনের পর; এই যে রুলিং এলিট হয়ে ব্রাহ্মণ মর্যাদা লাভের ও স্যার ডাক শোনার যে আকুতি; দার্শনিক ফ্রিডেরিশ নিটশে ঠিক এটাকেই, ফইন্নির ঘরের ফইন্নির জীনগত আশ্লেষ বলে অভিহিত করছেন। নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে; তিন প্রজন্মের শিক্ষা ও নৈতিকতা চর্চা ছাড়া নৈর্বক্তিকতার ক্ষমতা; কোনো জীন অর্জন করতে পারেনা। আর পুষ্টির অভাবে অবিকশিত মস্তিষ্ক টেকাটুকা ও ইমেডিয়েট বেনিফিটের বাইরে টেকসই কোন জীবনপন্থার কথা ভাবতে পারে না।
মানুষ মরছে করোনাভাইরাসের ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ে; আর সরকারি ধামা আপা পদ্মা সেতুর বিজ্ঞাপনের মুখ ঢেকে দিতে দলীয় প্রতীক নৌকায় চড়ে সহমত ভাইয়ের জন্মদিন পালন করছে; পদ্মার ঢেউরে বলে খিল খিল করে হাসছে; নিও এফলুয়েন্সের ও পাওয়ার ইউফোরিয়ার এল এস ডিতে। এই লোডস অফ সুইফ ডেভেলপমেন্ট বা এল এস ডিতে ভাসছে, জাতীয় বাজেট-প্রণোদনা প্যাকেজ-একসেস টু টেকাটুকা প্রজেক্ট-স্বজনপ্রীতির রিরংসা। এরা আবার জনগণকে উদ্দেশ্য করে গান গায়, আমি তো ভালানা ভালা লইয়া থাইকো।
গহীন বালুচর চলচ্চিত্রের সুবর্ণা মুস্তাফা; পান-সুপারী চিবাইতে চিবাইতে খালি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে চলেন অনন্তকাল; কত প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার বিষ তার মনে; তা খোদাও জানতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই হয়তো তাকে নিয়তির হাতে সঁপে দিয়ে ‘হাঁসুনি বাঁকের উপকথা’ ও ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র সমসাময়িক সংস্করণ লিখছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। গহীন চরের কথিত অসাম্প্রদায়িক সুবর্ণা-ই একমাত্র নারী; যিনি নির্বাচনী প্রচারণায় হজ্জ্ব করে ফেরা কালো পট্টি মাথায় বেঁধে এই ধর্মীয় চিহ্নটিকে জনপ্রিয় করেছেন আপামর নারী সমাজে। তবু অসাম্প্রদায়িকতার ‘স্বর্ণদণ্ড’ ও ‘অলিভ বৃক্ষে’র ডাল নড়িয়ে তিনি উদারপন্থার রাজশ্রী হয়ে বিরাজ করেন।
করোনাকালে অদৃশ্য দুর্ভিক্ষ মধ্যবিত্তের ঘরে; সড়ক ও জনপথ (সওজ) ভাইয়ার ডিজিটাল বাংলাদেশের ঝলক দেখে ফ্রি লান্সার হওয়া তরুণের আত্মহত্যার খবর ঢেকে যায় টাইমমেশিনে চড়িয়ে অতীত ইতিহাসে ঘুরপাক খাইয়ে। বর্তমানের মৃত্যুকে ঢেকে দিতে অতীতের মৃত্যুর কান্নায় ডুকরে ওঠে ভাড়া করা রুদালিরা।
সবদেশে বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ডিজিটালি; অথচ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শ্লোগানে কানে তালা লাগিয়ে দেয়া বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলছেন, করোনা গেলে খোদার ইচ্ছায় আবার পড়ালেখা হবে। খোদা নড়ে চড়ে বসেন তার লেখার টেবিলে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের আত্মহত্যার খবর হারিয়ে যায়; বিদেশে আম রপ্তানী করে তাক লাগিয়ে দেয়ার ‘বেহুদা ঢোলে’। বঙ্গবন্ধু আইয়ুব খানের বেহুদা উন্নয়ন ঢোলে বিরক্ত হতেন; কারণ বেহুলা বাংলার জলাবদ্ধতার মসজিদে কোমর পানিয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া সাধারণ মানুষের কাতারেই তিনি ছিলেন। রুলিং এলিট কনসেপ্টটাকে উনি পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন; সেই সাম্য চিন্তাকে ভয় পেয়েই পশ্চিম পাকিস্তানের নব্য রুলিং এলিটের খুনে এলিট ফোর্স হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ২৫ মার্চের কালরাতে।
মসজিদের কোমর পানিতে নামাজের ছবি দেখে ক্ষমতাসীনের সরাসরি বেনিফিশিয়ারি ধামাচাপা আপা এগিয়ে এসে বলেন; এরকম ঘটনা বাংলাদেশে নয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতার খবর রাখেন না; ক্ষমতার প্রাসাদে ক্ষমতার এলএসডিতে মাতাল আপা ও ভাইয়ারা। অবশেষে জলাবদ্ধ এলাকার সাংসদ; পাবলিকের ধাওয়া খেলে; তখন কিল খেয়ে কিল চুরি করা দায়িত্ব জ্ঞানহীন নিও জমিদার সাংসদ বলেন, আমাকে ধাওয়া দেয়নি; পত্রিকায় বানিয়ে ছানিয়ে লিখেছে। জলাবদ্ধতা নয়; নতুন বড়লোক হওয়া লোকেরা ব্যস্ত ইমেজ নিয়ে। যেহেতু দশবছর হলো ইমেজ শব্দটির সঙ্গে পরিচয়। নতুন মানসম্মানের কামড় সবসময়ই বেশি হয়।
জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ হাজারটা ইস্যু ফেলে; হান্নান ও জামাতের চাবানো চুইংগামের আবার চেবানোর যে সংস্কৃতি ও সাংবাদিক বলয়; এরা একাত্তরের নিজামি-কাদের-সাইদি জাতীয় রাজাকারের ২০২১-এর সংস্করণ। রাজা যায় রাজা আসে; রাজাকার যায় রাজাকার আসে; কিন্তু নিষ্ঠুর নিপীড়ক সরকার বনাম চর দখলের লড়াইয়ে আত্মকেন্দ্রিক বিরোধী দলের মাঝে পিষ্ট জনমানুষ আর মানবতা ও বাকস্বাধীনতাহীন ৫৬ হাজার বর্গমাইল পড়ে থাকে অবহেলায়; শোক তাপে, অভিভাবকহীনতার মূঢ় বেদনায়।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া