যেখানেই থাকি না কেন একুশে আসে প্রভাত ফেরীর স্মৃতি নিয়ে, সুদূর শ্লোগানের স্মতি চেতনায় ধ্বনিত হয় । সুদূর জন্মভূমির ভেজা মাটির গন্ধ পাই।সেই দিনগুলিতে ফিরে যাই বারবার হৃদয় মথিত হয় বেদনায়। মনে পড়ে সেই সব দিনগুলি যখন ফাল্গুন স্পর্শ করেছিল আমাকে তখনো আমাদের পরিবার ও সমাজ মোটেও আধুনিক ছিল না। যদিও মধ্যবিত্ত পরিবারসমূহে নারী শিক্ষার প্রচলন বিস্তৃত হচ্ছিল। মোটামুটি সব পরিবারেই এক নম্বর নিয়ম ছিল বাড়ী থেকে স্কুল স্কুল থেকে বাড়ী নাক বরাবর, কোন রকম এদিক সেদিক তাকানো নয়। স্কুলগামী কিশোরীদের পোষাক ছিল সালোয়ার কামিজ ও দোপাট্টা এবং কলেজে ছিল শাড়ী ও সালোয়ার কামিজের মিশ্রণ।বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রীরাই শাড়ী পরতেন। আমরাও শাড়ী পরেছি তখনো আমাদের মায়েরা শাড়ীর আচঁল মাথায় টেনে একটু ঘোমটা পরেছেন। আর আমরা প্রচলিত প্রথা ও নিয়ম ভাঙতে ব্যস্ত এক কথায় বিদ্রোহী। এটা অভিভাবকদের কাছে গ্রহনযোগ্য ছিল না। কঠিন বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের অনেককেই। বিশেষ করে যাদের পরিবার তত উদার ছিল না।
আমরা সমান অধিকার দাবী করেছি, স্বায়ত্ব শাসনের তাগিদ অনুভব করেছি। অনুভব করেছি সমাজ ও দেশকে বদলানোর দায়িত্ব শুধু পুরুষদের একার নয় আমাদেরও।
আমরা বসন্তোৎসব, ২১শে ফেব্রুয়ারি , বাংলা নববর্ষ, বর্ষা মঙ্গল, বর্বীন্দ্র ও নজরুল জন্ম বার্ষিকী পালন করেছি। বিশেষ করে বাঙালী মুসলিম পরিবারে উৎসব পালন করার চর্চা ছিল না। কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল। বাংলা ও বাংলা সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারন করেছি গভীর আবেগ নিয়ে ।সহজেই বাংলাভাষা জাগরিত হয়েছে, বাঙালীসত্ত্বার উন্মেষ ঘটেছে সেই সময়টিতেই। সেই সাথে পূর্ন মানবিকতাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল তখন ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ক্রমাগত বাঙালীর হৃদয়ে ও মননে যে চেতনা সঞ্চারিত হয়েছিল তা ক্রমশ মহাসমুদ্রের বিশাল জলস্তম্ভের মত উত্থিত মুক্তির সংগ্রাম পরম কাঙ্খিত স্বাধীনতা, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল।
বাস্তবিক আমার পরিবার শঙ্কিত হয়েছিল পারিবারিক পরিবেশকে আলোড়িত করেছিলাম অজান্তেই। বিষ্ণুদের কবিতার কিছু লাইন রনেশদা শুনিয়েছিলেন দুটো লাইন আজো মনে পড়ে,
“বাছারে বুঝি না যে আমি তোর ভাষা
ঝড়কে যে ডেকে আনিস আঙিনায় ও ঘরে”।
তাই সেই সময়ের আমরা এমনি দস্যি মেয়ে ছিলাম। আমার পরিবার শঙ্কিত হয়তো বা বিব্রত ও বোধ করেছে। একুশ ছিল এক প্রখর দুর্বার কবিতা, প্রভাত ফেরী,দেশের গান, শিশির শিক্ত মাটির গান পাগল করা দেশ প্রেম। দেশকে ভালোবাসা আমাদের সকলের মনে প্রচন্ড শক্তি দিয়েছিল। সেই শক্তি জীবনের প্রতি পদক্ষেপে অনুভব করেছি।
সেই সময়ে আমরা ঘরে বাইরে সংগ্রাম করেছি বললে কম বলা হবে না।
সবই আজ ইতিহাস হয়ে গেছে।আমরা আর সত্তরে নেই ২০২১ এ আমাদের পদচিহ্ন অনিশ্চিত, এলোমেলো ও বিক্ষিপ্ত । সময় পরিবর্তনশীল ও বহতা তা কারু অনুমোদনের অপেক্ষা করে না গভীর ভাবে অনুভব করি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান মনষ্কতা, মানবতাবোধ ও শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাব। যার ফলে আমরা একটি অচলাবস্তায় দাড়িয়ে আছি।বসন্তের সুবিমল হাওয়া আমাদের স্পর্শ করেনা সেভাবে আর!
– – নীনা হাসেল, কানাডা প্রবাসী কবি