বেলারুশের উন্নয়নের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেংকো প্রায় এক-চতুর্থ শতক বেলারুশের ক্ষমতার আঠা হয়ে আছেন। তিনি ভোটসমনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দিনের বেলার পরিবর্তে নিশিভোট চালু করায়; বেলারুশের নাম বদলে নিশিরুশ করার পক্ষে এখন অনেকেই। সম্প্রতি এক নিশিভোটে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ভোটের দাবীদার হওয়ায়; লুকাশেংকোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সুশীলেরা পরাজিত শত্রু আম্রিকার টেকাটুকা খেয়ে ফেসবুকে উস্কানি দিয়ে জনগণকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়।
বেলারুশের স্ট্রবেরি টিভির অনুগত সাংবাদিকেরা যারা গত ২২-২৩বছর ধরে লুকাশেংকো’র উন্নয়নের লিপ-সার্ভিসে বড্ড খুশি ছিলো; হঠাত কী যে হলো; আম্রিকায় এসাইলাম নিয়ে পাকা পায়খানা ব্যবহারের হাতছানিতে কীনা জানি না! “আর মিথ্যা সাংবাদিকতা করতে পারবো না” বলে বেঁকে বসেছে।
এই তো দুদিন আগেও এরা কৃষকের টিভি বাইট চালিয়েছে বেলারুশ টিভি ওয়ান-এ; যেখানে কৃষক বলছিলো, এই মাংস-পনির খাওয়ার দিন আর আমার স্ত্রী’র পার্টি গাউন কে দিয়েছে আমাকে; লুকাশেংকো দিয়েছে। লুকি ক্ষমতায় আছে বলেই, পাখি গান গায়, ফসলের মাঠে সমৃদ্ধি হাসে।
অথচ প্রায় ৩০০ সাংবাদিক ষড়যন্ত্রকারী দেশের শত্রুদের প্ররোচনায়; স্টুডিও খালি করে চলে গেলে; টিভি স্ক্রিনে দেখা যায় স্টুডিও গান গাইছে, শুন্য এ বুকে পাখি মোর আয়; ফিরে আয়; ফিরে আয়।
লুটস্কিনা নামে এক সর্বোনেশে নারী সাংবাদিক বললেন, আর স্ট্রবেরি খেতে ইচ্ছা করছে না। সত্য কথা বলতে না পারলে; সাংবাদিকতা করার মানে হয় না।
অবাধ্য সাংবাদিকদের বশীকরণে লুকাশেংকো তাদের “সকল দেশের রাণী”-র কাছে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণের উদ্যোগ নেন। পৃথিবীর সেরা বাতাবি লেবু মিডিয়ার জন্য বিখ্যাত এই সকল দেশের রাণীতে “উই আর বর্ণ টু এগ্রি” ঘরানার টেকসই সাংবাদিকতা চালু আছে। এগ্রিকালচার ভিত্তিক সমাজ কাঠামোর কারণে এগ্রি করাটা এক রকম ধর্ম; যা নানা কাল্পনিক ভক্তিরসে ভাসতে থাকে বিশ্বাসের নৌকায়।
বেলারুশের সাংবাদিকেরা সকল দেশের রাণীতে পৌঁছালে; তাদেরকে প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হয় একটি প্রাইভেট বাতাবী লেবু টিভিতে। সেখানে টিভি প্রধানের অফিস কক্ষে বিছানায় বসে তিনি গান গাইছেন, “ঘুমাতে পারিনা সারারাত ধরে।”
নিশি ভোটের ভোটসমনিয়ার এই গান ৯৯ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করে। বেলারুশের সাংবাদিকদের এই গান শেখান সকল দেশের রাণীর সেলিব্রেটি সাংবাদিক ল্যারি কিং। সমবেত কন্ঠে তারা গাইতে থাকে, “গুমাতে পারিনা সারারাত ধরে”। ল্যারি কিং ঠিক করে দেন, ‘গুম’ না ‘ঘুম’ বলুন।
এরপর আরেকটি বাতাবী লেবু টিভি টকশো স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হয় বেলারুশের সাংবাদিকদের। সেখানে সরকার বিরোধী এক লোককে গলায় গামছা দিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ টকার সিংহ মামা কেশর ফুলিয়ে তাকে চেতনার তালিম দিচ্ছে। এক নারী সাংবাদিক শাসাচ্ছে, আপনার বিরুদ্ধে ফিমেল হ্যারাসমেন্টের কেস ঠুকে দেবো; যদি আপনি আর একটা কথা বলেন। উপস্থাপিকা খুব মুচকি হেসে; মুখ টিপে হেসে; রগড়ের সুখ নিচ্ছে।
বেলারুশের সাংবাদিকদের এশিয়াটিক মোড অফ প্রোডাকশানের “কুয়োতলা ডকট্রিন” সম্পর্কে আলোকিত করেন টিভি প্রধান। “জেমসের হাডুডু টিক টিক জাপটাইয়া ধরোরে” গানটি শেখানো হয় তাদের।
টিভি স্টেশান থেকে বেরিয়ে বেলারুশের সাংবাদিকেরা দেখে, ফুটপাথে বিভিন্ন টিভির লোগো লাগানো প্লাস্টিকের মাইক্রোফোন খেলনা বিক্রি হচ্ছে।
এরপর বেলারুশের সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হয়, হ্যাপি ইনসাইডার অফিসে। সেখানে সবাইকে গ্লাসে করে বোরহানি পরিবেশন করা হয়। প্রতিষ্ঠান প্রধান উগান্ডা বংশোদ্ভুত নিউজের ইদি আমিন যেন। তিনি বলেন, যা ঘটেনি তা প্রকাশ আপনার দায়িত্ব। ইয়েলো জার্নালিজম ইজ দ্য মাদার অফ গুড ফরচুন; এটা ভুলে যাবেন না। আগে হরিণ বিড়ি ফুঁকতাম; এখন মার্লবরো খাই। সাংঘাতিক হইতে না পারলে সাংবাদিকতা ছাইড়া দেন।
বেলারুশের সাংবাদিকদের এবার “ষড়যন্ত্র সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে” নিয়ে যাওয়া হয় “যন্ত্র ঐ একটাই ‘ষড়যন্ত্র” শীর্ষক কর্মশালা ও কর্মশালীতে। সেখানে রিসোর্স পারসন হিসেবে রয়েছেন হাঞ্জব্যাক অফ চেতনাদামেরা। ষড়যন্ত্রের ঘন্টা বাজিয়ে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। চেতনাদাম বলেন, ষড়যন্ত্র ইজ দ্য মাদার অফ পাওয়ার প্ল্যান্ট। আপনাকে সব সরকার বিরোধী প্রতিবাদকেই ষড়যন্ত্র হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করতে হবে। রুশ দাদাদের সঙ্গে মিলে ঝুলে যত দোষ আম্রিকা ঘোষ; মাঝে মাঝে জার্মানি ঘোষ বলবেন। মনে রাখবেন, যন্ত্র ঐ একটাই ‘ষড়যন্ত্র’। আর শুধু মিডিয়া নয়; সোশ্যাল মিডিয়ায় গিয়ে তোতা পাখির মতো বলতে হবে, তুই ষড়যন্ত্র; তুই ষড়যন্ত্র।
এরপর বেলারুশের সাংবাদিকদের খানিকটা বিনোদনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় “লা গোবরিনা ফেস্টে”। টমেটো ফেস্টের মতোই ব্যাপারটা; টমেটোর পরিবর্তে গোবরের এই ব্যবহার বেলারুশের সাংবাদিকদের কাছে অবাক লাগে। বেলারুশের এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করে, আপনাদের এই দুর্গন্ধে এমন হাকালুকি করতে ভালো লাগে।
টমেটো ফেস্টের সংস্কৃতি মামা বলেন, গোরু আমার মা, ছাগল আমার ভাই; ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি। গোবরানুভূতিতে আঘাত করবেন না প্লিজ।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া বলদা রায় বেলারুশের সাংবাদিককে দেখিয়ে বলে, উঁহ দুর্গন্ধ লাগতেছে! পুঁজিবাদের দালাল কুতাকার। গোবর খাইয়ে শুদ্ধ করুন এদের।
গোবর ছুঁড়ে খিল খিল করে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে, উইকলি বেডরুম ব্লগের সম্পাদক ইতিহাসান। সে উপযাচক হয়ে বলে, বেলারুশে যারা বিদ্রোহী হয়েছে; তাদের বেড রুমের খবর ফাঁস করে দিন।
বেলারুশের সাংবাদিক লুটস্কিনা বলে, বেড রুমের যে প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে আপনি জন্ম নিয়েছেন; সেই একই পদ্ধতিতে পৃথিবীর সব শিশুই জন্মায়। ফলে বেডরুমের খবর নতুন কিছু নয়।
বেডরুম ব্লগের সম্পাদক বলে, ঠিক আছে তাহলে এখন ইতিহাস নিয়ে আলাপ করি। লুকাশেংকো-কে ইতিহাসের সেরা শাসক করে তুলুন। বই পুস্তক লিখুন; সেগুলো পাঁপড়ভাজার মতো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে বিক্রি করুন। আর ফেসবুকে একটা টাইম মেশিন বসান। বর্তমানের সমালোচনা কেউ করলেই; তাদের ইতিহাসে নিয়ে যান; ইতিহাসের ত্যানা পেঁচিয়ে খান; অসুবিধা কী!
সবশেষে ভি আই পি প্রেস কনফারেন্স দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয় বেলারুশের সাংবাদিকদের। প্রেসকনফারেন্সে বেলারুশিদের হাতে একটি করে তেলের বোতল ধরিয়ে দেয়া হয়। একটা করে লিকুইড সোপ দেয়া হয়; হাত কচলানো শেখাতে।
এরপর সংস্কৃতির মুক্তাঞ্চলে বেলারুশিদের নিয়ে আসা হয় এন্টি স্ট্যাবলিশমেন্ট থিয়েটার শেখাতে। অত্যন্ত আর্ট কালচারের সংস্কৃতি মামারা দেশোদ্ধারের ব্রতে চোখ লাল আর রাগী করে ঘুরছে। বেলারুশের সাংবাদিকেরা ভয় পেয়ে যায়। এক সংস্কৃতি মামা এগিয়ে এসে বলে, বিদ্রোহ করবেন বেলারুশের ফুল-ফল-লতা-পাতার বিরুদ্ধে; কিন্তু অন্তরে জপবেন, “লুকাশেংকোই পারে; লুকাশেংকোই পারবে।” রাষ্ট্রীয় পদক-টদক তো পাইতে হবেরে ভাই।
প্রশিক্ষণের শেষে “ছা-ছপ-ছমুছা ভাষাবিজ্ঞান ইনসটিটিউটে’ বেলারুশের সাংবাদিকদের সহমতশেংকো শব্দটি শেখান এক ভাষা বিজ্ঞানী। “এক মত এক ঋষি; বেলারুশের দিবা নিশি” মূলমন্ত্র শিখিয়ে দেয়া হয়। এরপর গান শোনানো হয়; “বি কেয়ার ফুল বি কেয়ার ফুল; লুকাশেংকো ভাইয়ের দুই নয়ন; বেলারুশের উন্নয়ন।”
বিদায় বেলায় সকল দেশের রাণীর এক রোমান্টিক সাংবাদিক বেলারুশের সাংবাদিকদের বলে, আপনারা দেখলাম জাপটাজাপটি কইরা সেলফি তোলেন না একদমই। সহমতশেংকো হইতে একটু ঘন হইয়া আসাটা শিখতে হবে। বিমানে ওঠার সময় বেলারুশের সাংবাদিকদের হাতে একটি করে খাম ধরিয়ে দিয়ে; উন্নয়নের এক খোকন সোনা বলে, এখন থেকে আপনারা পোকিত খামবাদিক। ফিরা গিয়া ফাস্ট কেলাস কইরা লিখবেন; ঘুরে এলাম ভূ-স্বর্গ।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
এডিটর-ইন-চীফ, ই সাউথ এশিয়া