বাংলাদেশ ও ভারতের তাবৎ বাংলা দৈনিক কাগজগুলো অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোকবিহ্বল। নানাভাবে বলা হয়েছে আপসহীন, সংগ্রামী, বহুমানিত পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী। তিনি গবেষক। তাঁর প্রয়ানে দুই বঙ্গ, অভিভাবক হারালো। তিনি জীবনের নানা কথা লিখেছেন আত্মচরিতে। পড়ে বহু কিছুই জানতে পারি।
দোষেগুণে সবাই মানুষ, ব্যতিক্রম নন আনিসুজ্জামানও। কিন্তু আপসহীন বললে বাড়িয়ে বলা। আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের বিস্তর ক্ষতিও করেছেন। বিগত সব সরকারের সঙ্গে, প্রত্যক্ষ না হলেও, আড়ালে আবডালে দহরম মহরম ছিল ওপেন সিক্রেট। কখনও কোনও আঁচড় স্পর্শ করে নি তাঁকে। সমস্ত সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন। বিএনপি’রআমলে, যুদ্ধাপরাধীর সাক্ষীর মামলায় একটু বিপদে পড়েছিলেন, তাও কাটিয়ে ওঠেন। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছেনে শেখ হাসিনার আমলে। স্বৈরাচারী হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’জুড়ে দিলেন এবং রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ করলেন। ‘আপসহীন’হিসেবে আনিসুজ্জামানের উচ্চকণ্ঠ নেই, পথেও নামলেন না। স্বৈরশাসকের ভয়ে? সেনার ভয়ে? নাকী অন্যকিছু?
ডক্টর আহমদ শরীফের মতো বুদ্ধিজীবী কেন সোচ্চার হলেন? বাংলাদেশে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক (বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ডক্টর আহমদ শরীফ, স্পষ্টবাদী, গবেষক, বহুগ্রন্থের লেখক, অথচ তাঁর মৃত্যুতে আনন্দবাজারে কোনও খবর প্রকাশিত হয় নি। ডক্টর আহমদ শরীফের স্নেহভাজন এবং সহকর্মীআনিসুজ্জামান। আনিসুজ্জামান সম্পর্কে ডক্টর শরীফলিখেছেন– “আমাদের অজাতশত্রু গুণে-গৌরবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ড. আনিসুজ্জামান কি যাদুকরী নীতি ও আদর্শে একাধারে ও যুগপৎ বিরোধী রাজনীতিক দলের প্রতিবাদী বিবৃতির লেখক ও স্বাক্ষরদাতা, বক্তা হয়েও সরকারের কাজে-কমিটিতে, রেডিও-টিভিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যক্তি হিসেবে গণ্য ও আস্থাভাজন থাকেন। আবার একাধারে ও যুগপৎ মার্কিন ও রাশিয়ার প্রিয় ও আস্থাভাজন থাকেন তা ভেবে পাইনে। তিনিই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনন্য পুরুষ। তার জনপ্রিয়তাও অসামান্য। তার বক্তৃতার কোন শব্দ বা বাক্যই আজো কারো আপত্তির বা অপছন্দের কারণ হয়নি। ড. আনিসুজ্জামান হচ্ছেন পদ্মপত্র বা কচুপাতার মতো চরিতের লোক। জলেতে নামবে, কিন্তু গায়ে জল লাগাবে না॥” (আহমদ শরীফ, আহমদ শরীফের ডায়েরি: ভাব-বুদ্বুদ, জাগৃতি প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯, ঢাকা; পৃ: ১৩০-১৩১)
গত শতকে ষাট দশকের শেষে প্রকাশিত বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’, এরপরেওআরো চারটি সংস্করণ। এই পত্রলেখকের কাছে আছে চট্টগ্রামের‘বইঘর’ থেকে প্রকাশিত সংস্করণ (১৯৮৫)। ৪৫০ পৃষ্ঠায় বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন (ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতাকাজী গোলাম মাহবুবের স্মৃতিচারণ) “সর্বদলীয় কমিটিরশান্তিনগর বৈঠক ৭ মার্চ (১৯৫২) অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তোয়াহা, অলি আহাদ, মুজিবুল হক, মীর্জা গোলাম হাফিজ ও আমি উপস্থিত ছিলাম। আন্দোলনের (ভাষা আন্দোলনের) ভবিষ্যৎ বিকাশ সম্পর্কেআলোচনা এর পূর্বেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বৈঠক প্রায় ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়েছিলো এবং আমি ছাড়া অন্য সকল উপস্থিত সদস্যই গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলেন। … আমাদেরকে ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আনিসুজ্জামানের (পরবর্তীকালে ডক্টরেট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) হাত ছিলো।“ দুই বিদ্দজনের দুই লেখার একটিরও তিনি প্রতিবাদ করেন নি। এই নিয়ে সাধারণ্যে (সভা সমিতিতে) প্রশ্ন করলে হয় নিশ্চুপ নয়তো ভিন্ন প্রসঙ্গ পাল্টাতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রছিলাম। ছাত্র হিসেবেই এই অভিজ্ঞতা এখনও জাগ্রত।
বাংলাদেশে বহু কিছু নিয়ে প্রতিবাদ, মানববন্ধন হয়। রাজপথে মিছিল করে, ভাঙচুর, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও। শেখ হাসিনা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেও সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাদ দেন নি।যথারীতি বহাল রেখেছেন।আনিসুজ্জামান কি এই নিয়ে কোনও শোরগোল তুলেছিলেন? না। বরং ‘অসাম্প্রদায়িক তকমায়’ মেনে নিয়েছেন। মানববন্ধন করেছেন? রাজপথে নেমেছেন? বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে, শিল্পী সাহিত্যিকদের নিয়ে আন্দোলন করেছেন? না। কেন? শেখ হাসিনা তাঁর ছাত্রী ছিলেন (বিশ্ববিদ্যালয়ে, টিউটোরিয়ালে) বলে? ‘স্নেহের’ ছিলেন, তাই? তা হলে তো এটাই ছিল মোক্ষম দাওয়াই। কবিরাজ সে-পথে যান নি।আওয়ামী লীগ সরকারের বহু অন্যায় চোখে দেখেও দেখেন নি, মেনে নিয়েছেন। প্রতিবাদ দূরের কথা। আওয়ামী লীগের ঘরের লোক, আওয়ামী ঘরানার, সবসময়ই ‘আপসহীনে’র মুখোশে ধরি মাছ না ছুঁই পানি, আওয়ামী লীগ সরকারের চৌহদ্দিতে সর্বদাই দালালি করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের ভয়ানক ক্ষতি করেছেন তিনি। স্তাবকতা ছিল তাঁর প্রিয়। পরশুরামের ‘উৎকোচ–তত্ত্ব’ নিয়ে পল্প আছে।নানাবিধ উৎকোচ। আনিসুজ্জামানের উৎকোচপ্রিয়তাসাধারণ্যেও জানাজানি। এক ধনী ব্যবসায়ী তাঁকে চিকিৎসারজন্যে সিঙ্গাপুরে পাঠালেন, সমস্ত খরচ ধনীর। স্বাস্থ্য মজবুত হলে দেশে ফিরলেন, স্বাস্থ্য আরো পোক্ত করার জন্যে দার্জিলিং পাঠালেন। ধনীই ব্যয়ভার বহন করেন। ধনী বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেলেন। ধনীর নাম মারুফুল ইসলাম। এক কলম গদ্য, কবিতা লিখতে জানেন না। পুরস্কার ঘোষণার পর আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ছি ছি ছিক্কার। কাগজেও লেখালিখি। আনিসুজ্জামান নির্বিকার। মনে রাখা দরকার তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি।
আরো আছে। বাংলাদেশের সম্মানিত পুরস্কার ‘একুশের পদক’।’আনিসুজ্জামান এই পুরস্কারেরও বাছাইকর্তা।‘বাংলাভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের’ জন্যে পুরস্কার দিলেন নাজমুন নেসা পিয়ারিকে। একটি সম্পূর্ণ বাক্যও শুদ্ধ লিখতে পারেন না এই নেসা। তিনি কী লিখেছেন? কেন পুরস্কার দেওয়া হয়? আনিসুজ্জামানকে দুইবার জার্মানির বার্লিনে নিয়ে এসেছেন নাজমুন নেসা পিয়ারি। ঢাকায় গেলে আনিসুজ্জামানের জন্যে দুই বোতল স্কচ হুইস্কি ‘উপহার’পিয়ারির। প্রত্যেকেই জানে।
আপসহীন সংগ্রামী’, ’বুদ্ধিজীবীর’ সাহিত্য বিচার বাঙালি পাঠকেরও জানা উচিত।
– হাবিবুল্লাহ মনসুর খান
ফ্রাইবুর্গ, জার্মানি।