সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেছেন- তাঁর কাছে গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, সংখ্যালঘুর প্রটেকশন। আদর্শিক ভিন্নমত, দেখতে ভিন্ন, বিশ্বাসে ভিন্ন, যেভাবে হোক এদের প্রটেক্ট করা হচ্ছে গণতন্ত্র।
শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০), বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় ‘হক-কথা’য় ড. রীয়াজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর কাজ ও চিন্তা নিয়ে এক লাইভ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। লাইভ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রফেসর ফাহমিদুল হক।
কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন
বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়নের পক্ষে অনেকে বলেন। এ ব্যাপারে তিনি কি মনে করেন? সঞ্চালকের এমন প্রশ্নে ড. আলী রীয়াজ বলেন- তাঁর কাছে গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, সংখ্যালঘুর প্রটেকশন। আদর্শিক ভিন্নমত, দেখতে ভিন্ন, বিশ্বাসে ভিন্ন, যেভাবে হোক এদের প্রটেক্ট করা হচ্ছে গণতন্ত্র। এখন ভিন্নমত রক্ষা না করে, যতই আপনি বলেন আমি ভিন্নমত সহ্য করবো না, উন্নয়ন হবে তাতো হবার নয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন- কার উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে? নর্মেটিভলি যদি আপনি দেখেন উন্নয়ন করার জন্য যদি আপনি গণতন্ত্রকে বাদ দেবেন তাহলে তো হয় না। উন্নয়ন মানে কী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি? অমর্ত্য সেন এ বিষয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন অন্য কিছু বিষয়ের সাথে গণতন্ত্র থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না।
তিনি বলেন- প্রথমত: যদি একটা মানুষের মানবিক উন্নয়ন, তার সম্ভাবনা বিকশিত করার পরিবেশ তৈরি করতে না পারা যায়, কেবলমাত্র অর্থের যোগানেই সব উন্নয়ন দেখানো হয়, তাহলে তা উন্নয়ন নয় । দ্বিতীয় যেটা ইম্পেরিক্যালি যদি বলি আপনি তিনটি দেশের (মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, দ: কোরিয়া) উদাহরণ দিলেন, আমিও একটা উদাহরণ দেই। নাইজেরিয়া গণতন্ত্রও নাই উন্নয়নও নাই। উন্নয়ন হওয়ার নামে গণতন্ত্রকে ছেঁটে দেয়ার পর যেটা হয়েছে সেটা তো দৃশ্যমান। আপনি উন্নয়ন চান গণতন্ত্র চান না? তাহলে পিনোশে কে পছন্দ করুন। একটা সাফল্যের পেছনে দশটা ব্যর্থতা থাকে। আপনি ব্যর্থতার কথা বলবেন না কেন? ইনক্লুসিভ হয়েইতো উন্নয়ন অর্জন করা যাচ্ছে। আপনি রাতারাতি উন্নয়ন করার জন্য যদি আপনি বাংলাদেশের ষোল কোটির মধ্যে আট কোটিকে আপনি সরিয়ে ফেলেন। তাহলে অনেক উন্নতি হবে। আপনি কি তাই করবেন? কেন করবেন না। আপনি দালান কোঠা বাড়িঘর ব্রীজ করবেন, সে ব্রীজ আবার ভেঙে পড়ে দুদিন পর পর, তাহলেই সমস্যা। এখন লাখো কোটি টাকা খরচ করে এগুলো করে সেটাকেই আপনি বলছেন উন্নয়ন! কিন্তু আপনার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই, ইনক্লুসিভিটির কোন ব্যবস্থা নেই এটা কিসের উন্নয়ন?
ড. রীয়াজ বলেন- সিঙ্গাপুরের গভর্নেন্সের মাত্রাটা, করাপশনের লেবেলটা দেখুন, পলিটিক্যাল পার্টি সেখানে পার্টিজান এডমিনিস্ট্রেশন তৈরি করেছে কি না দেখানতো, কোরিয়ার কথা বলেছেন। কোরিয়াতে কি করাপশন হয় না, হয় কিন্তু প্রতি পদে পদে করাপশন হয়? তাহলে দেখা যায় গভর্নেন্সে একটা ডাইমেনশন আছে। গুড গভর্নেন্স এনসিওর করা। সাধারণভাবে যদি বলি আপনারতো জবাবদিহিতা থাকতে হবে। কোন না কোনভাবে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। সে গুলোকে শিকেয় তুলে দিয়ে বলবেন এটা গণতন্ত্র, তাতো হবে না।
তিনি বলেন বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো পুরো ধ্বংস হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ গুলো পূণরুদ্ধার করা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের গণতন্ত্র আইনের শাসন এ সব ইস্যুগুলোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত হতে হবে।
সমালোচকদের কারো কারো মন্তব্যের বিষয়ে
বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অভিমতে ইউনাইটেড স্টেটসের ফরেন পলিসির ছাপ থাকে বলে সমালোচকদের কারো কারো মন্তব্যের বিষয়ে তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বলেন তিনি তার নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে রিপ্রেজেন্ট করেন না। ড. আলী রীয়াজ প্রসঙ্গত: বলেন-আমি বহু আগে থেকে আফগানিস্তানের যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছি। বলেছি পাকিস্তান ইজ দ্য মেইন প্রবলেম দেয়ার। ইউনাইটেড স্টেটস যখন আফগান যুদ্ধে জড়িত তখন আমি প্রশ্ন তুলেছি কেন ভারত পাকিস্তানের আঞ্চলিক বিরোধে ইউনাইটেড স্টেটস জড়িত হবে, সেখানে কেন মার্কিন করদাতাদের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে? আমি বলেছি ইরাকের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবসুলিউটলি ভায়োলেশন অফ ইন্টারন্যাশনাল ল’ এন্ড নর্মস। আমি আমার কথা বলি এবং তা বলতে থাকবো।
আওয়ামী লীগ কি সেক্যুলার পার্টি?
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার পার্টি বলা হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন আওয়ামী লীগের সেক্যুলারিজমের বেসিসটা কোথায়? আওয়ামী লীগ আমলে ১৯৭২- ৭৫ সালে আওয়ামী লীগ রাস্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মকে কি পৃষ্ঠপোষকতা করেনি? এটা দোষের কিছু নয়। এটা দোষ হিসেবে দেখার কিছু নেই। একটা দলের অবস্থান এমন হতেই পারে এবং ১৯৯১ এর পরে আওয়ামী লীগের ব্যাপক ট্রান্সফরমেশন হয়। ড. আলী রীয়াজ বলেন- আমি আমার মনের মধ্যে একটা স্বপ্নের আওয়ামী লীগ বানিয়ে রাখবো। তার সাথে না মিললে বিব্রতবোধ করবো এটাতো হয় না। আওয়ামী লীগ হচ্ছে সে দল যে দল গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, আবার একদলীয় শাসন ও তারা কায়েম করেছে।
লিব্যারেল স্টেটে ধর্মের ভূমিকা
ড. আলী রীয়াজ মনে করেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ বিপদটি ঘটেছে তা হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর আইডিয়া দিয়ে সেক্যুলারিজমকে বোঝার চেষ্টা করা। তিনি বলেন যে – রিলিওজিয়নের বিপরীতে সেক্যুলারিজম তিনি সেটা মনে করেন না, সেক্যুলারিজমের প্রশ্নটা হচ্ছে ইনক্লুসিভিটির প্রশ্ন। সবাইকে মিলে সোসাইটি তৈরি করতে পারছেন না কিনা সেটা বিবেচ্য। তালাল আসাদরা যে কথাগুলো বলেছেন।
এখন প্রশ্ন যেটা সেটা হচ্ছে লিব্যারেল স্টেটে রিলিওজনের রোল কি হবে? প্রসঙ্গত: এই প্রশ্ন তুলে এ বিষয়ে তিনি বলেন- সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে কার সাথে রোলের কথা বলা হচ্ছে- স্টেটের সাথে না সোসাইটির সাথে? সোসাইটিতে রিলিওজন থাকবে। অনেক থিওরী দিয়ে কেউ কেউ বলেন আমিও সেভাবে বলতে পারতাম। সে না করে আমি সরাসরি বলছি। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললে পাবলিক ডিসকোর্সটা কনফিউজড হয়। এটা সহজ ও সাধারণ বিষয় বাংলাদেশের মত দেশের সোসাইটিতে। তিনি বলেন “ এটা ইউনাইটেড স্টেটসে আছে না? ভুলে যাচ্ছেন কেন ইংল্যান্ডের রাণী চার্চ অফ ইংল্যান্ডের প্রধান। জোনাথান ফক্সের একটা বই আছে তাতে দেখানো হয়েছে কতগুলো দেশের সংবিধানের মধ্যে ইমপ্লিসিটলি এবং এক্সফ্লিসিটলি রিলিওজন আছে। এই বইটা বাংলাদেশের সকলের পড়া উচিত।”
ড. আলী রীয়াজ বলেন- স্টেটের সাথে ধর্মের কি সম্পর্ক সে নিয়ে আলোচনা করা যায়। তিনি বলেন, সে আলোচনা করার প্রথম ভিত্তি হচ্ছে আপনি লিবারেল স্টেট তৈরি করতে চান কিনা? যদি লিবারেল স্টেট তৈরি করতে চান সে লিবারেল স্টেটের শর্ত কি- এর শর্ত হচ্ছে এই যে রাস্ট্রের তিনটা অর্গান আছে সেগুলোর মধ্যে সেপারেশন করতে হবে। আপনি ধর্মকে বাইরে রাখবেন অথবা ভেতরে রাখবেন সেটা তো সেকেন্ডারি কোশ্চেন। তিন অর্গানের সেপারেশন না করে আপনি লিবারেল স্টেট তৈরি করতে পারবেন না।
তাঁর মতে, বর্তমান পৃথিবীতে লিবারেল স্টেট তৈরি করার শক্তি হচ্ছে সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা। প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন- লিবারেল স্টেট তৈরি করার জন্য প্রথমে একটা লেবেল অফ স্টেট ফাউন্ডেশন তৈরি করতে হবে। ধর্মের প্রশ্নটা ঐ জায়গায় আটকে গেছে। এখন কি হয়েছে লোকে বলে যে এ সুবিধা নেয় ও সুবিধা নেয়। নির্বাচন আসলে এদের কাছে নেয় ‘নির্বাচন শেষ হলে তাদের ডিভোর্স হয় না সেপারেশন হয়’।
জাসদের রাজনীতির সাথে এক সময় যুক্ত থাকা প্রসঙ্গে
জাসদের রাজনীতির সাথে এক সময় সংশ্রব থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন- মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কিছু আকাংখার তৈরি হয়েছিল। যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এক ধরণের সাম্য তৈরি করার কথা বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেটা পুরো অর্জন হয়নি। তথন মনে হয়েছে জাসদ সে অপূর্ণ আকাংখা পূরণের কথা বলছে।
উল্লেখ্য, ড. আলী রীয়াজকে নিয়ে সোয়া দুই ঘন্টার হক কথা’র এই লাইভ অনুষ্ঠান অসংখ্য দর্শক বিমোহিতভাবে উপভোগ করেন।