রাজনীতির কেন্দ্রটাকে সরিয়ে দিতে পারলে মোসাহেবদের দারুণ সুবিধা, নূরুল হক নূরের এর একটা বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ঠিক সেই কাজটাই তারা করছেন।
খেয়াল করুন, বড়জোর প্রতারণার বা বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ হতে পারে যা, সেটাকে ধর্ষণের সাথে তুলনা করে, গণমাধ্যমে সেটা নিয়ে শোরগোল তুলে তারা গুণ্ডাতন্ত্রের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে যে বীভৎস অপরাধগুলো ঘটে চলেছে, সেটাকে আড়াল করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
তারপর আসলো নূরের এই বক্তব্য, প্রতারণার অভিযোগ করা নারীটি সম্পর্কে (এই নারীটি কিন্তু খুবই অন্যায় ভাবে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে কার্যত সরকারের গুটি হিসেবে কাজ করছেন)। নূরের বক্তব্যকে সমর্থন করার কোন সুযোগ নেই। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এই বক্তব্যকে আমরা নারীর প্রতি অমর্যাদাকর হিসেবে প্রত্যাখ্যান করি। এবং মনে করি তার উচিত তার বক্তব্যের ভুল স্বীকার করে তা প্রত্যাহার করা।
কিন্তু এই বিষয়টা রাজনৈতিক আলাপের কেন্দ্র হতে পারে না, গুরুত্ব কিছুটা দাবি করতে পারে। এবং ঠিক এই কাজটিই গণমাধ্যমের একাংশ এবং গুণ্ডাতন্ত্রের খুদকুঁড়ো খাওয়া মোসাহেবরা করে যাচ্ছেন।
রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গুণ্ডাতন্ত্রের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে যে নারকীয় পরিস্থিতি দেশে সৃষ্টি হয়েছে, তারই প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংগ্রামটিকে এগিয়ে নিতে হবে। রাতের আঁধারে ডাকাতির একটা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের যে রাজত্ব আওয়ামী লীগ তৈরি করেছে, সেই জনস্বীকৃতিহীন সরকার ব্যবস্থার বদল ঘটাতে হবে। এবং এই অবৈধ সরকার যে গুণ্ডাতন্ত্রের ওপর ভর দিয়ে দেশব্যাপী তার লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে, অবৈধতার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামকে তৃণমূলে নৃশংস কায়দায় দমন করছে, সেটার বদল ঘটাতে হবে। এইগুলোই হতে হবে রাজনীতির কেন্দ্র।
রাজনৈতিক কর্মীর বাইরে সমাজ সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদে কিছু পর্যবেক্ষণের কথাও বলতে পারি। চলমান ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের একটা বড় অর্জন হলো মূলধারায় বেশ শক্তিশালী ভাবে থাকা অনেকগুলো বদ্ধ ধারণাকে এবার অনেক সরাসরি আঘাত করা গেছে। অনন্ত জলিল যে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন, সেটা এই প্রতিরোধের শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ। এটা আসলে গত বিশ-তিরিশ বছরে নারীর শিক্ষায় অগ্রগতি, সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতিতে তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বৃদ্ধির একটা ফল। উলটোদিকে আমাদের সমাজের বহু পুরুষতান্ত্রিক উপাদান সম্ভবত নারীর এই অংশগ্রহণ বৃদ্ধিরই প্রতিক্রিয়া। নারীর উপস্থিতি ও আত্মপ্রকাশকে মেনে নিতে তার প্রবল আপত্তি।
এবারের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে এই অগ্রগতিটা আর একধাপ ঘটেছে, ধর্ষণ বা যৌননিপীড়নের জন্য পোষাককে দায়ী করা মনোবৃত্তিগুলো টিকে আছে সত্যি, কিন্তু সেগুলো সামনে আসতে পারেনি অতীতের মত। এবং অনেকেই তাদের বক্তব্য থেকে পিছু হটতে, অথবা মনের ব্যাথা মনেই চেপে রেখে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের চাইতে অনেক জোরদার হয়েছে নারীর স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার।
নারীর এই অগ্রগতির একই ঘটনা কোটা সংস্কার আন্দোলনেও দেখতে পাবেন। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সূচনাকালে এমনকি সংগঠকদেরও অনেকের বক্তব্যে পুরুষতান্ত্রিক উপাদানগুলো যথেষ্টই শক্তিশালী ছিল। নেতৃত্বের বড় অংশটাও ছিলেন পুরুষ শিক্ষার্থীরা। এবং ‘প্রগতিশীল’ সংগঠনগুলোর একটা বড় অংশ এই্ আন্দোলনকে এড়িয়ে যাওয়াতে এই বিষয়গুলো আরও সুনিশ্চিত হয়। নারীদের পায়জামা কেন্দ্রিক একটা বক্তব্য এখনও কোটা আন্দোলনের প্রসঙ্গে ঘুরেফিরে আসে। অথচ প্রগতিশীলদের শক্তিশালী অংশগ্রহণ এই আন্দোলনের সাংস্কৃতিক মান নির্ধারণে শুরু থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারতো, অনেকদূর প্রভাবিত করে এমনকি নিজেরাও নেতৃত্বের জায়গাতে বেশ খানিকটা আস্থা অর্জন করতে পারতো।
প্রগতিশীলরা ততটা অংশ না নিলেও কিন্তু পুলিশের লাঠির বাড়ি এবং ছাত্রলীগের নির্যাতন আসলে কোটা সংস্কারের এই পুরুষান্ত্রিক উপাদানটিকে (পুরোটা নিশ্চয়ই না) অনেকখানি দূর করেছে। নারীর সাথে মিছিল করতে হয়েছে, এবং দেখা গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মিছিলগুলোতে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের চাইতে ন্যূন নয়। এবং খুবই সঙ্কটময় দিনগুলোতে নারীদের উ্পস্থিতি আসলে ছাত্রলীগ-পুলিশের সাঁড়াশি আক্রমণ থেকে আন্দোলনকে রক্ষা করেছে। নারীর অবস্থানকে কৌশলগত কারণে হোক, বাধ্য হয়ে হয়ে হোক, মেনে নেয়াটাকে অভ্যাস করতে হয়েছে। প্রগতিশীলতা আসলে বহু পথে আসে, মিষ্টিভাষী পুরাতন প্রগতিশীলরা দাবনব সরকারের বন্ধু হলেও সত্যিকারর নতুন গতিশীলতার জন্ম রাস্তার আন্দোলনে তৈরি হয়।
আসলে একটা সমাজে নারীর উপস্থিতি-অগ্রসরতাকে মেনে নেয়ার মনোবৃত্তি তৈরি হবার একটা ইতিহাস থাকে। কোরীয় ও জাপানী সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা ৯০ দশক পর্যন্ত অতি শক্তিশালী ছিল, এখনো বেশ খানিকটা আছে। কোরীয় সরকার উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে এই বিষয়ে বিশেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। তাদের সাফল্য কিছুদূর। জাপান আরও দেরিতে এই কাজটি শুরু করেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মাঝে জাপানে এখনো নারীর উচ্চশিক্ষা ও কর্মংস্থানে অংশগ্রহণ কম। কিন্তু খেয়াল করুন, এই সব জায়গাতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থে, প্রতিযোগিতায় টিকতে জনশক্তির পুরোটা ব্যবহারের তাগিদে। অন্যদিকে মার্কিন বা বৃটিশ সমাজে দীর্ঘ নারীবাদী আন্দোলন এই অর্জনগুলোতে ভূমিকা রেখেছে। আমাদের দেশের বহু সামাজিক ধারণা ও উপাদান নারীকে সহজে মেনে নেয়, অনেকগুলো আবার জটিল সব বাধা তৈরি করে। জাপান বা মার্কিন কোন সমাজের মতই তা নয়।
কিন্তু ক্রমাগত নগরায়নের চাহিদা, কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ আশির দশকেও যা অসম্ভব ছিল, সেই বিষয়গুলোকে সম্ভব করেছে। চাকরি-নিজের বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহ আরও বহু বিষয়ে আমাদের সমাজে বিপুল বদল এসেছে। এটা নিয়ে অস্বস্তি যেমন সব মহলে আছে, এটার অনিবার্যতাও ক্রমাগত স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।নারীর প্রশ্নে আজকে যে সব বিষয় নিয়ে আমরা তর্ক করছি, হয়তো দশ বা বিশ বছর পর তা হাসির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
একটা ভুল কিংবা অন্যায্য বক্তব্য বা ভুল কাজের জন্য আমি তাই কাউকে চিরতরে ফেলে দিতে আগ্রহী নই। দীর্ঘমেয়াদে তারা রাজনীতিতে কতখানি থাকবেন, নাগরিক নারীরা তাদের প্রতিনিধি হিসেবে তাদেরকে কতখানি গ্রহণ করবেন, তারা নিজেরা জনগণের এই অংশেরও প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারবেন, এগুলো নির্ভর করবে ক্রমাগত তারা কতদূর এই সব কিছুর প্রয়োজনে নিজেদের বদলে নিতে পারবেন। কিন্তু সফল হতে গেলে এই কাজটা না করে তাদের উপায় নেই। বিবাহপূর্ব সম্পর্ক বিষয়ে যে ছুৎমার্গ তারা দেখিয়েছেন, তাদের সংগঠনের অনেকেরই তেমন বিষয়ে সংযুক্তি তো খুব পরিস্কার ভাবেই উঠে এসেছে, যেটা আবার সত্যিকারের ডানপন্থীদের দিক থেকে তীব্র আক্রমণের শিকার হয়েছে!
আমাদের সমাজে রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি এই সাংস্কৃতিক লড়াইটাও খুব শক্তিশালীভাবে অগ্রসর হচ্ছে। খুবই প্রয়োজন শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে তোলা, যারা বিচ্ছিন্ন এবং ছত্রভঙ্গ নয়, এবং যারা সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদপুষ্ট নয় বলে সকলের আস্থাভাজন এবং যারা নারীর প্রশ্নে, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে একাট্টা। এই রকম একটা শক্তিকেন্দ্র আমাদের এইখানে একদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিন্তু সংখ্যায় বিপুল প্রগতিশীল উপাদানগুলোকে একত্রিত করবে, অন্যদিকে নগরসমাজে যে উপাদানগুলো নিত্যনতুন যুক্ত হচ্ছে, সেগুলোর ওপরও প্রভাব বিস্তার করবে, তার থেকে নারীবিদ্বেষী উপাদানগুলোকে দূর করবে।
বিখ্যাত একজন মানুষের কথা বলি, মহিউদ্দীন আহমেদ। মুসলিম লীগের উগ্র দাঙ্গাবাজ ছিলেন খুব তরুণ বয়েসে। বরিশাল শহরে ৪৭ সালের পরও কিছুদিন হিন্দু বিদ্বেষী নানান উৎপাত তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন, কারণ মনেই করতেন মুসলিমদের দেশ পাকিস্তান, হিন্দুদের ভারতে চলে যেতে হবে। রীতিমত বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগ সরকার তাকে আটক করে রাখে। কারাবাসের সময়ে অন্যদের সংস্পর্শে তার এই অনুভূতিটি হয় যে, সমস্যাটা হিন্দু-মুসলিমের নয়, সমস্যাটা এখন জাতিগত নিপীড়নের। কৃষকের মুক্তির। আওয়ামী লীগে এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এ এবং শেষ জীবনে বাকশাল মহিউদ্দীন হিসেবে তিনি রাজনীতি করেছেন, কোনদিন আর সাম্প্রদায়িক কোন বক্তব্য কেউ তার মুখে শোনেনি। পাকিস্তান বিরোধী জাতীয় আন্দোলন বহু সাম্প্রদায়িক তরুণকে (যার মাঝে কমবেশি মাত্রায় প্রায় সকল জাতীয় নেতাই আছেন) বদলে দিয়েছিল।
বিদ্বেষ ছড়িয়ে সরকারের গুটি না হয়ে ভুলকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করুন, অন্যায্য ও অবমাননাকর বক্তব্যকে অবমাননাকর বক্তব্য হিসেবেই বিবেচনা করে সেটার প্রতিবাদ করুন। কিন্তু সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে এমন কিছু যিনি করবেন যার ফলে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ঐক্য হওয়া সম্ভব এমন শক্তিগুলো বিভাজিত হয়, তিনি আসলে এই ভয়াবহ গুণ্ডাতন্ত্রকে আরও দীর্ঘমেয়াদ দেবেন। প্রতিরোধের শক্তিগুলোকে আরও বিভাজিত করায় ভূমিকা রাখবেন।
আমরা যেন সেই ভুলটা না করি।
– ফিরোজ আহমেদ, রাজনৈতিক সংগঠক, বিশ্লেষক