মাওলানা ভাসানী ছিলেন এ দেশের কৃষক-শ্রমিক খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের পক্ষে তার নিজস্ব চেতনার গন্ডিতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা।কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম যাদের নিয়ে তিনি দল গঠন করেছিলেন তাদের অনেকের কাছেই জনস্বার্থ বড় বিষয় ছিল না,রাষ্ট্রক্ষমতায় যেনতেন প্রকারে অধিষ্ঠিত হওয়াই ছিল তাদের আসল লক্ষ্য। এই কারণে তাদের সঙ্গ বাধ্য হয়েই ত্যাগ করতে হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে।
পৃথিবীর যে অংশটি নিয়ে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ভৌগোলিকভাবে তার স্বতন্ত্র সত্তার উদ্ভব ১৯৪৭ সালে। বাংলাদেশ কেন্দ্রিক রাজনীতির সূচনা প্রচ্ছন্নভাবে তখনই ঘটেছিল। দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্টার পরপরই ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র প্রতষ্ঠিার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হতে শুরু করেছিল-রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সে সাক্ষ্যই বহন করে।
মওলানা ভাসানী ও শামসুল হকের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় আওয়ামী মুসলিম লীগ তিনটি প্রধান দফার কথা ঘোষণা করে। এ তিনটি দফা ছিল:
১. পূর্ণ গনতন্ত্র,
২. পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং
৩. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি।
পরবর্তী পর্যায়ে মওলানা ভাসানী ও শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচী হিসেবে ২১ দফা গৃহীত হওয়ায় ভাসানীর ৩ দফা আলাদা অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। কারণ ২১ দফার মধ্যেই এর মর্মকথা অর্ন্তভূক্ত ছিল। পাকিস্তানের অবহেলিত প্রদেশ পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ৫৪ সালের নির্বাচনে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শেরেবাংলা একে ফজলুল হক একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন ৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে। এতে গণতন্ত্রী দল, নেজামে ইসলাম পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি এবং খেলাফতে রব্বানী পার্টি যোগদান করেছিল। যুক্তফ্রন্টের তৃতীয় নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। হক-ভাসানী সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন এই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচী হিসেবেই ঘোষিত হয়েছিল ২১ দফা।
ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে মুসলিম লীগের দূর্নীতি ও দুঃশাসন এবং স্বায়ত্তশাসনের অধিকার বঞ্চিত পূর্ব বাংলার প্রতি শোষণ,বৈষম্য আর নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত ২১ দফা এত অভাবনীয় জনসমর্থন পেয়েছিল যে, ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৭টিতেই জিতেছিলেন যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীরা। ৭২টি অমুসলিম আসনেও যুক্তফ্রন্ট সমর্থিতরাই জয়লাভ করেছিলেন, ফলে ৩০৯ আসনের প্রাদেশিক আইন পরিষদে ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগের ভাগে জুটেছিল মাত্র ১০টি আসন।
এরপর পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছে-গঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের সরকারও। কেন্দ্রেীয় মন্ত্রিসভায়ও যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যোগদান করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন; কিন্তুু ২১ দফা বাস্তবায়িত হয়নি।
অবশ্য স্বীকার্য, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের শাসনকালে ১ নং দফাটি বাস্তবায়িত হয় এবং আরও বাস্তবায়িত হয় ১৪ নং দফাটির অংশবিশেষ। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মধ্যে ১ নং দফাটি ছিল ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে। ‘আর ১৪ নং দফাটি ছিল, ‘জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করত: বিনাবিচারে আটক বন্দিদের মুক্তি দেয়া হইবে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যাক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হইবে এবং সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হইবে। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা স্বীকৃত পেয়েছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমী । এদিকে রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ১৪ নং দফার আংশিক প্রতিশ্রুতি পালন করলেও সরদার ফজলুল করিমসহ কমিউনিস্ট বন্দিদের অনেকেই মুক্তিলাভ থেকে বঞ্চিত থেকে গিয়েছিলেন। তাছাড়া সভা-সমিতি করার ‘অবাধ ও নিরঙ্কুশ’অধিকারও আওয়ামী লীগ শাসনকালে ভোগ করা যায়নি। কালাকানুন রদ করতে নেতারা তখনও উৎসাহিত হননি, পরেও না। এই দিক থেকে হিসাব মেলাতে গিয়ে বলা যায়, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগ ২১ দফার দেড় দফা বাস্তবায়ন করেছিল। আর বাকি সাড়ে ১৯ দফার দামে মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে পূর্ব বাংলাকে যথেচ্ছ শোষণ করার অখন্ডনযোগ্য দাসখতে সিল-সই মেরেছিল মারী চুক্তি সম্পাদন ও যুদ্ধজোটের পক্ষে ওকালতি করে।
এক্ষেত্রে পাঠক সমাজকে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মধ্যে ১৯ নং দফাটি স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। এ দফায় বলা হয়েছিল,লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় (অবশিষ্ট্যত্মক ক্ষমতাসমূহ) পূর্ব বঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনীর হেড কোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌ বাহিনীর হেড কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মানের কারখানা নির্মান করত: পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ন করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে। ২১ দফার এই ১৯ নং দফাটিকে এই সময় মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে দাফন করা হলেও ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী ৬ দফার ঘোষণা এসেছিল মূলত এই ১৯ নং দফাকে ভিত্তি করেই।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনোত্তর ঘটনা প্রবাহ ছিল ওই বিজয়ের চেয়েও বিষ্ময়কর। ক্ষমতা লাভের আগেই মন্ত্রিত্বের প্রশ্নে যুক্তফ্রন্টে ভাঙন ধরেছিল। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্টের সভায় শেরেবাংলা ফজলুল হককে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়। সমঝোতার সে চমৎকার পরিবেশে সোহরাওয়ার্দী শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভায় গ্রহনের প্রস্তাব উত্থাপন করলে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ফজলুল হক শেখ মুজিবকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হন। এই বিতর্ককে কেন্দ্র করেই যুক্তফ্রন্ট বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পরিণামে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়েই ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল শেরেবাংলা ফজলুল হক যুক্তফ্রন্টের নামে গঠন করেছিলেন নিজ দলীয় সরকার।
কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের ব্যর্থতা ও বিশ্বাস ঘাতকতার পর ক্ষমতাসীন হয়েছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন করেন, আর সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ১২ সেপ্টেম্বর। আওয়ামী লীগ সরকারও ২১ দফার একটির অংশ বিশেষ মাত্র পূরণ করেছিল। অধিকাংশ রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। তবে সায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি উপেক্ষিত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলতে শুরু করেন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলাকে শতকরা ৯৮ ভাগ সায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহম্মদ এবং শেখ মুজিবুর রহমান সহ আওয়ামী লীগ দলীয় ক্ষমতাসীন নেতাদের প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষাবলম্বন করেন।
সে অবস্থায় সংগঠনের সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী দলীয় কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করেন। ১৯৫৭ সালের ৭/৮ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত এবং কাগমারী সম্মেলন নামে পরিচিত অধিবেশনটিতেও সোহরাওয়ার্দী তার শতকরা ৯৮ ভাগ সায়ত্ত শাসনের তত্ত্বই পেশ করেছিলেন। জবাবে মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি “আসসালামু আলাইকুম।”
কাগমারী সম্মেলনে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে সুষ্পষ্ট সিদ্ধান্ত পাশ হয়ে যায়; কিন্তু কাগমারী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকার সায়ত্ত শাসনের প্রশ্নে নিরব ভূমিকা রাখতে থাকে। এর প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেন ১৮ই মার্চ, ১৯৫৭ সালে। উল্লেখ্য, ২১ দফা আদায়ের ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানীর অনমনীয় চাপের মুখে এর আগেই আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির ২ মার্চের সভায় অবিলম্বে প্রাদেশিক পরিষদে সরকারিভাবে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য দলীয় সদস্যদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। প্রাদেশিক পরিষদে গৃহীত স্বায়ত্তশাসনের সর্বসম্মত প্রস্তাবটিকে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ‘বিবেচনার অযোগ্য এক রাজনৈতিক চমক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোলাম আলী তালপুরও একে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করে ‘কঠোর হস্তে দমন করার’ হুমকি উচ্চারণ করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে এরপর ১৩-১৪ জুন ঢাকায় আয়োজিত হয়েছিল এক ‘কাউন্সিল অধিবেশন’। এতে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধজোটমুখী পররাষ্ট্রনীতিসহ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সব নীতি ও ঘোষণাকেই অনুমোদন দেয়া হয়।
দলীয় নীতি বিচ্যুতির অভিযোগে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। ২৫ জুলাই তার উদ্যোগে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। এ পর্যন্ত উপস্থাপিত ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে বলা যায়, ১৯৫৪ সালের বিজয়োত্তরকালে পূর্ব বাংলার জননেতাদের গরিষ্ঠ অংশই ক্ষমতালিপ্সার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। এর ফলে জনগণের মঙ্গল ভাবনা উপেক্ষিত হয়েছে, স্থায়ী সর্বনাশ হয়েছে পূর্ব বাংলার। ২১ দফা কিংবা স্বায়ত্বশাসন দূরে থাক, শোষণ-নির্যাতনই অব্যাহত থেকেছে, এতে জনগণ হয়েছে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ। ২১ দফার পরিণতি সম্পর্কিত পর্যালোচনার পর রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্য দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ৬ দফা এবং ১১ দফার বিষয় আলোচনায় আনা দরকার।
৬ দফা পেশ করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত হয়েছিল ১১ দফা কর্মসূচি ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনুসারী হিসেবে পঞ্চাশের দশকে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে প্রতিকুল অবস্থান গ্রহণের পর স্বায়ত্তশাসনের একই দাবি নিয়ে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের উত্থান ঘটে। ৬ দফার মাধ্যমে তিনি মূলত নতুন কোনো কর্মসূচি উপস্থাপিত করেননি। বস্তুুত, ২১ দফার ১৯ নং দফার সম্প্রসারিত রূপই ছিল শেখ মুজিবের ৬ দফা।
প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ মুজিব এই ৬ দফা কোথায় পেলেন? এ কথা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য এবং আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব কর্তৃক স্বীকৃতও যে, আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের কোনো সভায় বা বৈঠকে ৬ দফা কর্মসূচি আলোচিত বা গৃহীত হয়নি-পাকিস্তান আওয়ামী লীগে তো নয়ই, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনো ফোরামেও নয়। কথিত আছে শেখ মুজিব গেলেন করাচি হয়ে লাহোরে। লাহোরে তিনি পকেট থেকে বের করলেন ৬ দফা। ঢাকা-করাচি-লাহোর পথে অপরাপর যে সব আওয়ামী লীগ নেতা তার সহযাত্রী ছিলেন তারা পর্যন্ত কিছু জানতে পারেননি এক মুহূর্ত আগেও। অতঃপর লাহোর থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করলেন। পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ শেখ মুজিব ঘোষিত ৬ দফা অনুমোদন করে। ৬ দফা নিয়ে নানা কথা থাকলেও এর মূলে যেতে হলে ৬ দফার প্রেক্ষিতটাও আলোচনা করা দরকার।
শেখ মুজিব ৬ দফা দিয়েছিলেন ১৯৬৬ সারের ৫ ফেব্রুয়ারি। এর আগে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৭ দিনের একটা যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধের ফলাফলটা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের জন্য আনন্দদায়ক ছিল না। ফলে, তাসখন্দ চুক্তি করে তিনি দেশে ফিরলে প্রচন্ড প্রতিবাদের মুখোমুখি হন। কাগমারী সম্মেলনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত পাস হয়ে যায়; কিন্তুু কাগমারী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে নীরব ভূমিকাই রাখতে থাকে। এর প্রতিবাদে মওলানা ভাষানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেন ১৮ মার্চ, ১৯৫৭ সালে। এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আইয়ুব খানকে বিশেষভাবে পীড়িত করে। পাকিস্তান আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধজোটে আবদ্ধ। ভারত তখন জোট নিরপেক্ষ দেশ। সে ক্ষেত্রে আইয়ুব খানের স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন করবে; কিন্তুু কার্যত যুক্তরাষ্ট্র সযত্নে এমন ভূমিকা থেকে বিরত থেকেছে, যা ভারতের অসন্তুুষ্টির কারণ হতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৬২’র চীন-ভারত যুদ্ধের অজুহাতে এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র সরবরাহ করে আসছিল।
এই অস্ত্রও স্বাভাবিক কারণেই পাক-ভারত যুদ্ধে ভারত ব্যবহার করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আইয়ুবের ক্ষোভের কারণ হয়েছে। ক্ষুব্ধ আইয়ুব খান অতঃপর, আমেরিকার সেই সময়কার জানি দুশমন, চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন্ পিকিংয়ে তাকে বিশ্ব নায়কোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, এরই সূত্র ধরে পরবর্তীকালে আইয়ুব খান ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস’ নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে মার্কিন ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছিল। এসব ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকেও ক্ষুব্ধ করেছিল। স্বাভাবিক কারণে, যুক্তরাষ্ট্রেরও প্রয়োজন পড়েছিল আইয়ুব খানকে কিছুটা ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার। ৬ দফা কি আইয়ুব খানকে সেই ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার দফা হতে পারে না? এ ক্ষেত্রে ধারণাটিকে আরও পরিষ্কার করার জন্য যে সংযোগ সূত্রগুলো স্মরণ করা দরকার তা হচ্ছে : ১.মার্কিন রাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলী যখন উড়ে এসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আসনটিতে জুড়ে বসেছিলেন, তখন মার্কিন মদতপুষ্ট সে মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবের আদর্শিক নেতা সোহরাওয়ার্দীরও একটি সম্মানজনক আসন ছিল। ২.এই সোহরাওয়ার্দীই আবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার দল আওয়ামী লীগ প্রধান মওলানা ভাসানীর প্রচন্ড বিরোধিতার মুখে যখন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি ও বিভিন্ন যুদ্ধজোটের পক্ষে ওকালতি করেন,শেখ মুজিব গ্রুপ তখন দলের নেতা মওলানা ভাসানীর পরিবর্তে মার্কিনি ইচ্ছার বাহক ও ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকেই সমর্থন দিয়েছিলেন। ৩. পঞ্চাশের দশকে শেখ মুজিব সংখ্যাসাম্য, এক ইউনিট ও জাতীয় সংহতির প্রবক্তা। ৬ দফার বক্তব্য তার সম্পূর্ণ বিপরীত-স্বাধীনতার একেবারে কাছাকাছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সাম্জ্যরাজ্বাযদ সম্পর্কেও কিন্তুু ৬ দফা সম্পূর্ণ নীরব। ৪. রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে শেখ মুজিব চাকরি করতেন আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নামক একটি বীমা প্রতিষ্ঠানে এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক ছিল পাকিস্তানের ২২ পরিবারের অন্যতম হারুন গ্রুপ। আইয়ুব খান আবার ছিলেন এই হারুন গ্রুপের জানি দুশমন। ১৯৫৮ সালে ক্ষমতায় এসে আইয়ুব খান এই হারুন গ্রুপের প্রধান ব্যক্তিকে সামরিক আদালতের বিচারে বেত্রাঘাত দিয়েছেন, তাদের কোটি টাকার ব্যবসা নষ্ট করেছেন। ৬ দফাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শেখ মুজিবের রাজনীতির উত্থান আগেই উল্লিখিত হয়েছে।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতান্ত্রিক কাঠামোগত প্রস্তাব, যাতে কেন্দ্রের হাতে কেবলমাত্র দুটি বিষয়-দেশ রক্ষা ও বৈদেশিক নীতি রাখা হয়েছে (২ নং দফা)। অন্য দফাগুলো এই মূলনীতিরই ব্যাখ্যা। সুতরাং কোনো এক দফাকে বাদ দিয়ে অন্য দফার অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু এই শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে বিরোধ যখন একেবারে তুঙ্গে, তখন শেখ মুজিব পাকিস্তানকে রক্ষার চেষ্টা হিসেবে ৬ দফা বিসর্জন দিতে কিন্তুু কার্পণ্য করেননি। ৬ দফাকে বাদ দেযার কথা বলা ৭০-৭১ এর সেই গণ অভ্যূত্থানের সময়কালে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা সহজেই অনুমেয়। অর্থচ সে ঝুঁকিও শেখ মুজিব নিয়েছিলেন ১ মার্চ। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির দেয়া এক সংবর্ধনার জবাবে তিনি এদিন ঘোষণা করেন : ‘৬ দফা কারও ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে না।’
মজার ব্যাপার হলো : এ খবরটি অতি কৌশলে পূর্ব পাকিস্তানি পত্র-পত্রিকায় ছাপতে দেযা হয়নি। এটা ছেপেছিল করাচির ‘দৈনিক ডন’। উল্লেখ্য, আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নামে যে বীমা প্রতিষ্ঠানে শেখ মুজিব চাকরি করতেন তার মালিক ২২ পরিবারের অন্যতম হারুন গ্রুপ এই ‘ডন’ পত্রিকার মালিক। যে ৬ দফার জন্য শত শত ছাত্র-জনতা আত্মাহুতি দিযেছে, হাজার হাজার মানুষ মামলা-মোকদ্দমা-জেল-জুলুম ভোগ করেছে, অতঃপর সেই ৬ দফা নিয়েই কিনা এই নীরবতা! ওয়াদাভঙের এমন রাজনীতি ইতিহাসে বিরল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে ৬ দফার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দ্বিমুখী।
জামায়াতে ইসলামী এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগসহ ডানপন্থীরা একে ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কর্মসূচি’ হিসেবে চিহ্নিত করে সর্বাত্মক বিরোধিতার পন্থা গ্রহণ করেছিল, অন্যদিকে বামপন্থীদের মতে, ৬ দফা ছিল একটি অসম্পূর্ণ কর্মসূচি।
এ সময় ৪-৭ জুন, ১৯৬৬ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ঘোষণা করেছিল ১৪ দফা। পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়, পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা, পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বিলোপ এবং যুদ্ধজোট ও সামরিক চুক্তি বাতিল করে স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণসহ জনগণের আশু ও দীর্ঘমেয়াদি প্রধান দাবিগুলোর অর্ন্তর্ভূক্তির কারণে ১৪ দফা একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় কর্মসূচির চরিত্র অর্জন করেছিল।
এই জাতীয় চরিত্রের ফলে ১৪ দফাকে একদিকে ৬ দফার মতো ঢালাওভাবে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আখ্যা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে, অন্যদিকে শোষণের প্রতিটি উৎসের বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্যও সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে।
এই প্রতিক্রিয়ার ফলে ডানপন্থীদের আনুষ্ঠানিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। কাউন্সিল মুসরিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি, এনডিএফ এবং আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সমন্বয়ে ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল গঠিত হয় ‘পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক মুভমেন্ট’ বা পিডিএম। এর পক্ষ থেকে ৮ দফার একটি কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়।
মওলানা ভাসানীর ন্যাপ কর্তৃক ঘোষিত ১৪ দফাকে কেন্দ্র করে ন্যাপের মধ্যে অন্তর্বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে কোনো ফলপ্রসূ আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ৬ দফার প্রশ্নে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে ন্যাপে ভাঙন ধরে, তার পরিণতিতে ১৯৬৭ সালের ১৬-১৭ ডিসেম্বর ৬ দফার পক্ষে অবস্থানকারীরা গঠন করেছিলেন ‘মস্কোপন্থী ন্যাপ’।
এই বিভক্তির ফলে ১৪ দফার ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক কোনো গণআন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এ পর্যায়ে ম্রিয়মাণ গণআনেদআলনে প্রাণপ্রবাহের সূচনা করেছিলেন মওলানা ভাসানী। স্বায়ত্তশাসন ও মৌলিক অধিকারসহ দাবি আদায়ের জন্য ‘প্রয়োজনে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করার’ হুমকি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি ‘ঘেরাও আন্দোলনে’র সূচনা করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দান থেকে জনসভার মানুষকে তিনি নিয়ে যান গভর্নর ভবন ঘেরাও করতে। এভাবেই মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে আইয়ুববিরোধী অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল। ১৯৬৯ সারের ২ জানুয়ারি ভাসানী-ন্যাপ এক প্রস্তাবের ৮ থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘গণহত্যা ও দলননীতিবিরোধী সপ্তাহ’ পালনের আহ্বান জানালে দেশের সর্বত্র আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। এর প্রেরণা বিভক্ত ছাত্রসমাজকেও ঐক্যবদ্ধা হতে সহায়তা করেছিল। ৫ জানুয়ারি গঠিত সংগ্রামী ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে ১৪ জানুয়ারি ঘোষিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি। এর প্রতি সর্বান্তকরণে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি মওলানা ভাসানী ১১ দফার আন্দোলনকে সর্বব্যাপী করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিরামহীন সফর, ভাষণ এবং ঘেরাও-মিছিলে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তিনি দাবি প্রতিষ্ঠাকে প্রায় অনিবার্য করে তুলেছিলেন।
লক্ষণীয়,৬ দফার আন্দোলন করতে গিয়ে সরকারি নির্যাতনে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ ১১ দফা প্রশ্নে তখনও ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। কিন্তুু সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে আগত সে গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করেছিল অন্য একটি দফা। পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে চিরদিনের বিরোধী পক্ষ ডানপন্থীরা এ সময়টিতে এগিয়ে এসেছিল। আরও একবার : পিডিএমের উদ্যোগে ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি গঠিত হয়েছিল নতুন একটি জোট ‘ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি’ বা ড্যাক। পিডিএমভুক্ত পাঁচটি দলের (যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীও ছিল) সঙ্গে বিস্ময়করভাবে এতে যোগ দিয়েছলি ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী ন্যাপ। অষ্টম দলটি ছিল জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম।
উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী এই জোটে অংশ নিতে সম্মত হননি। বিস্ময়ের বড় কারণটি হচ্ছে ড্যাকের ৮ দফা। ৮ দফার কোথাও স্বাত্বশাসনের প্রশ্নটি ছিল না, ছিল না সংখ্যাসাম্য কিংবা এক ইউনিট বাতিলের দাবিটিও। বড় কথা, শেখ মুজিবের মুক্তির কথা বলা হলেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত দাবিটিকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আওয়ামী লীগ তথাপি ড্যাকে যোগদান করেছিলেন। ৬ দফার আন্দোলন করে নির্যাতনে ভুগে আওয়ামী লীগ ৬ দফার একেবারে বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ড্যাকের ৮ দফায় শরিক হলো কেন? ঘটনাটির মধ্য দিয়ে রাজনীতির কোন প্রবণতাটি ফুটে ওঠে? বিষয়টি পরিষ্কার।
এর মধ্য দিয়ে ৩টি প্রশ্নের গ্রন্থি খুলে গেছে:১.আওয়ামী লীগ ৬ দফা দিয়েছিল ৬ দফা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়, কেন্দ্রের সঙ্গে দরকষাকষির জন্য। সুতরাং বিপর্যস্ত অবস্থায় ৬ দফার সম্পূর্ণ বিপরীত ৮ দফায় শরিক হয়েছিল।
২. পুর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ উদগ্রীব নয়, যদি স্বায়ত্বশাসনের সে আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকে মওলানা ভাসানী বা বামপন্থীদের হাতে। কেননা, সে ক্ষেত্রে তো ক্ষমতা পেয়ে ‘৯৮ ভাগের তত্ত্ব’ চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হতো না এবং
৩. মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ড্যাকের অন্যান্য শরিক দলের কোনো পার্থক্য নেই।
লক্ষণীয়, এই আওয়ামী লীগই আবার পরবর্তী সময়ে ১১ দফার আন্দোলনের ফলে প্রাপ্ত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ৬ দফাকে পুনর্বাসিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানের প্রচন্ড চাপে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে মাথানত করতে হয়েছিল। ১৯৬৯’র ১ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। চলমান অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করা ছিল প্রস্তাবটির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ওই আন্দোলনের গতিবেগ অব্যাহত থাকলে পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান বিপন্ন হবে। শেখ মুজিবও সেটা উপলব্ধি করেছিলেন।
আর সে জন্যই মওলানা ভাসানীর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেছিলেন। সার্বিক মুক্তির সুতীব্র আকাংক্ষায় যে ১১ দফা জন্ম, যে ১১ দফা শেখ মুজিবকে কেবল বন্দিদশা থেকেই ছিনিয়ে আনেনি-দিয়েছে অকল্পনীয় জনপ্রিয়তাও, সেই ১১ দফাকে ‘গোলটেবিলে’র চোরাবালিতে দাফন করা হয়েছিল এবং তারপর যখন ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন চেপে বসেছিল, আওয়ামী লীগ নেতারা সেটাকেই বরণ করে নিয়েছিলেন। মেতে উঠেছিলেন সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচন নিয়ে। যেন এত আন্দোলন, এত রক্তক্ষয় শুধু আইয়ুবকে অপসারণের জন্য আর কোনো উদ্দেশ্যই এর ছিল না। সম্ভবত এ কারণেই ১৯৭১ সালের শুরুতে স্বাধীন বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় এ দেশের জনগণ যখন ফেটে পড়েছিল তখন এর পরিণতি সর্ম্পকে শেখ মুজিব তার আকাংক্ষার বিপরীত ধারাটি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে এই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিজ হাতে নেন নি। নিজ বাড়িতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
জাতির সৌভাগ্য এই সময় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য একজন অকুতোভয় নেতৃত্ব এগিয়ে এসেছিল, যার নাম ‘তাজউদ্দিন আহমদ’। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব তথা আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসৃত জাতয়িকরণ নীতির মধ্যে যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সামান্যতম উদ্দেশ্যও ছিল না, তার আর এক বড় প্রমাণ হলো সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি ও শিল্পের দিকটি। সাম্রাজ্যবাদী সর্বাত্মক বিরোধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির শোষণ-লুণ্ঠনের বিনাশ ব্যতীত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলার অর্থ অবশ্যই প্রতারণা করা, জনগণকে ধাপ্পা দেয়া। আওয়ামী লীগ সরকার ঠিক এই পন্থাটিই নিয়েছিল। সমাজতন্ত্রের নামে পাকিস্তানি ও বাংলাদেশী মালিকানার শিল্প, ব্যাংক ও বীমা জাতীয়করণ করা হয়েছিল; কিন্তু ব্রিটিশ, মার্কিন কিংবা অন্য কোনো দেশের পুঁজি এবং কোনো একটি শিল্পপ্র্রতিষ্ঠানকেই তারা জাতীয়করণ করেনি। শুধু তাই নয়, এদের স্বার্থে যাতে কোনো রকম আঘাত না লাগে সেদিকটিতেও সরকাররের সযতœ সতর্কতা ছিল। এর ফলে ব্রিটিশ, মার্কিন স্বার্থ পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও পেয়েছিল সম্পূর্ণ নিরাপত্তা।
দ্রঃ এই লিখায় তথ্য সহযোগিতা নেয়া হয়েছেঃ ২১ দফা থেকে ৫দফা নামক প্রকাশিত বই থেকে । এই লিখাটি আমি লিখেছিলাম ২০০৯ সালে।
– মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন, লেখক, মুক্তিযোদ্ধা