বাংলা সেই প্রবাদটা মনে আছে তো, এক কান কাটা রাস্তার এক ধার দিয়ে যায়, দুই কানকাটা যায় রাস্তার মাঝখান দিয়ে? নির্লজ্জতার সীমা অতিক্রম বোঝাতে ব্যবহার করা হয় এই প্রবাদটি। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মুরুব্বীদের একটা বড় অংশের জন্যই এই কথাটা প্রযোজ্য দেখা যাচ্ছে।
কেবলমাত্র অল্প কয়েকটি পত্রিকা এই যে পরিস্থিতিতে তারা এই স্পর্শকাতর প্রসঙ্গটি নিয়ে যে কথা বলতে পারছে না, সে সম্পর্কে পাঠকদের কাছে কৈফিয়ত দিয়েছে, আভাসে ইঙ্গিতে কিংবা সংক্ষিপ্ত আকারে বিষয়টা তুলে ধরেছে, অভিযোগগুলোর বিস্তারে না যেয়ে। ডেইলি নিউ এজ, প্রথম আলো, ডেইলী স্টার, ঢাকা ট্রিবিউন এই দলে যাবে যারা পাঠকদের আলোচ্য বিষয় জানাতে চেয়েছে, নিজেদের অপরাগতা প্রকাশ করেছে।
বাকিরা কেউ কেউ এটুকু সাহস হয়তো দেখাতে পারেনি, কিন্তু অন্তত নীরব থেকে নিজেদের নির্লজ্জতাকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেনি। কিন্তু তেমন ঢোল পেটানো অনেকগুলো মানুষও আমরা দেখতে পেলাম। এদের মাঝেও আবার তিন স্তরের আছেন।
এক স্তরের লোকেদের বেহায়াপনটা এমন যে, আরে এগুলা আবার এমন কী প্রতিবেদন, যেন জানতেন না আগে?
দ্বিতীয় স্তরের মোসাহেবরা আল জাজিরার বক্তব্যের কী কী খুঁত আছে, সেই দিকে মনোযোগ দেয়ার গুরুগম্ভীর আয়োজন করার চেষ্টা করছেন। এবং আল জাজিরার প্রধান প্রমাণগুলো নিয়ে টু শব্দটি করছেন না। বাংলাদেশের বাস্তবতা যদিও এমনই যে, চাক্ষুশ ঘটনা নিয়ে কথা না বলে ঘটনার প্রমাণ নিয়ে আলাপের মত নির্বোধ বুদ্ধিজীবিতা ফলানো যায়।
তৃতীয় স্তরের মোসাহেবরা আরও দুর্দান্ত! এদের উদয় ঘটলো সবার শেষে, কারণ এরা প্রথম দুই দলের মত নিজেদের নিতান্তই বেশরম হিসেবে পরিচিত করতে চান না। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হলো দেশের সেই পত্রিকাগুলো যারা নিজেদের অপরাগতা ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে কতটা আতঙ্কের পরিবেশে বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে কাজ করতে হয়, সেই দিকটা তুলে ধরেছেন। এদের যুক্তির সারমর্ম হলো: কোথায় ছিলেন ৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পরের দিন, সেইদিন খবর তো ঠিকই সরকারের পছন্দমত ছাপতে হয়েছিল, আজকে এত কথা বলেন আবার!
সত্যই তো, কে অস্বীকার করবে গণমাধ্যম সেদিন একদম সেই খুনীদের সুরে সুর মিলিয়েছিল। এ বিষয়ে দুটো কথাই বলবার আছে। প্রথম, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে শুরু হয়নি। সেটা হয়েছে একদম ১৯৭২ সালে, তখনকার সবচাইতে জনপ্রিয় হক কথাকে নিষিদ্ধ করবার মধ্য দিয়ে। এরপর গ্রেফতার হয়েছেন গণকন্ঠের সম্পাদক। ১৯৭৩ সালে মতিউল-কাদেরের হত্যাকাণ্ডের পর বুলেটিন প্রকাশের দায়ে শাস্তি দেয়া হয়েছে হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়াব খানের মত সাংবাদিককে। তোয়াব খান ক্ষমা পেয়ে রেহাই পান, কিন্তু হাসান হাফিজুর রহমান দীর্ঘ মেয়াদে এর পরিণাম ভোগ করেছিলেন। নির্মল সেনের মত কীর্তিমান সাংবাদিকের সম্পাদকীয় স্তম্ভকে আর লিখতে না করে দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, এককথায় বলতে গেলে প্রথম কয়েকবছরেই বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বিকাশের সম্ভাবনাকে একদম ধ্বংস করে ফেলা হয়। এরপর তারই জের অব্যাহত থাকে কম আর বেশি।
বাংলাদেশের যে পত্রিকাগুলো নিজেদের অপরাগতা প্রকাশের এই দায়িত্বটুকু অন্তত পালন করেছে, তাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। এটা যেমন সত্যি যে, বাংলাদেশে অজস্র মোসাহেব গণমাধ্যম আছে, তেমনি এমন বিরূপ পরিস্থিতিতেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে কারও কারও চেষ্টাও আছে ন্যূনতম দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করবার। সেইখানে অকৃত্রিম শ্রদ্ধাই তাদের পাওনা। বিজ্ঞাপন আটকে শুধু না, কতভাবে যে যে এইখানে গণমাধ্যমকে বেয়নেটের ডগায় কিংবা এক পা কারাগারে রেখে কাজ করতে হয়, সেটা তারাই জানেন যারা ভুক্তভোগী।
এবং জনগণের সামনে নিজেদের এই অপরাগতা প্রকাশ যারা করেছেন বিনয়ের সাথে, তারা না বললেও আমি তাদের পক্ষে সবচাইতে বড় যে যুক্তিটা বলতে পারি, সেটা এই যে: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এককভাবে গণমাধ্যমের কাজ না, এটা একক ভাবে তাদের পক্ষে সম্ভবও না। একটা দেশের জনগণের দায় স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিস্থিতি নিশ্চিত করা, সাংবাদিকরা সেই লড়াইয়ের সহযোদ্ধা কিংবা প্রভাবক হতে পারেন বড়জোর।
সাংবাদিকদের চাইতেও জনগণেরই বেশি প্রয়োজন স্বাধীন গণমাধ্যম। ফলে সেই দিক দিয়ে এটা একটা সামষ্টিক ব্যর্থতা, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনগুলোর অনুপস্থতিতি ও শক্তিহীনতার সাথে এটা অনেক বেশি সম্পর্কিত। তেমন একটা পরিবেশ নিশ্চিত করার সংগ্রামটা জারি রেখেও অবশ্য আমরা গণমাধ্যম কর্মীদের এই প্রশ্নটার মাঝে রাখতেই পারি: আপনি গণমুখী সাংবাদিকতা করছেন নাকি ওই তিন স্তরের কোন এক পর্বের অন্তর্ভূক্ত থেকে গুণ্ডাতন্ত্রের মোসাহেবি করছেন, সেই হিসেব ইতিহাস টুকে রাখবে।
– ফিরোজ আহমেদ, রাজনৈতিক সংগঠক ও বিশ্লেষক