গুম হয়ে যাওয়া লাশসকল প্রতিশোধ নেবে—
বীভৎস কফিনহীন মৃতদেহ রাস্তায় রাস্তায়
মোড়ে মোড়ে
অলিতে গলিতে
অন্ধিতে সন্ধিতে
তোমাদের শান্তিশৃঙ্খলা স্থিতিশীলতার গালে
থাপ্পড় মেরে
অট্টহাসি হেসে উঠবে।
ভোরবেলা
দাঁতের মাজন হাতে ঢুকবে বাথরুমে—
সেখানে লাশ
তোমাদের প্রাতঃরাশে রুটি-মাখনের মধ্যে লাশের দুর্গন্ধ
তোমাদের ভোর সাড়ে সাতটার ডিমের অমলেটে লাশের দুর্গন্ধ
তোমাদের পানির গ্লাসে লাশের দুর্গন্ধ
তোমাদের চায়ের কাপে গলিত নষ্ট মৃতদেহের রক্ত;
লাশসকল প্রতিশোধ নেবে
লাশসকল হত্যার বদলা চায়।
রিকশায় তোমাদের পাশে যে বসে থাকবে
দেখবে সে একজন লাশ
টেম্পোবাসে তোমাদের গা ঘেঁষে যে বসে পড়বে
দেখবে সে একজন লাশ
ফুটপাতে তোমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে হাঁটছে
দেখবে সে একজন লাশ
অলিতে গলিতে
অন্ধিতে সন্ধিতে
চড়াও হয়ে
লাশসকল প্রতিশোধ নেবে।
প্রতিটি লাশের গায়ে ৩৬৫টি গুলির দাগ
(দিনে একবার করে বাংলাদেশকে বছরে ৩৬৫ বার হত্যা করা হয়)
জবাই করে দেওয়ার ফলে অনেক লাশের কণ্ঠনালী ছেঁড়া
অনেকের চোখ হাত পা বাঁধা
অনেককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে—
অনেককে হাড়মাংসসুদ্ধ কিমা বানানো হয়েছে প্রথমে
পরে থেঁতলে থেঁতলে পিণ্ডাকার দলা থেকে
তৈরি করা হয়েছে কাতারবদ্ধ সেনাবাহিনী
ওদের মধ্যে অনেককে দেওয়া হয়েছে মেজর জেনারেল পদ
একজনকে নিয়োগ করা হয়েছে
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে
তাদের সবার চেহারাসুরত বরফের মতোই ঠাণ্ডা ও নিষ্পলক
এই হচ্ছে লাশসকলের সুরতহাল রিপোর্ট।
তারা সামরিক কায়দায় উঠে দাঁড়ায়
অভিবাদন দেয়
অভিবাদন নেয়
অভিবাদন গ্রহণ করে
এবং সর্বক্ষণ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের
পরবর্তী বিক্ষোভ মিছিলকে
মেশিনগান মেরে উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা আঁটতে থাকে—
তোমরা আতংকিত হলে লাশসকল অট্টহাস্য করে ওঠে।
তারা তোমাদের সেনাবাহিনীর মতোই
নিজেদের সেনাবাহিনী গঠন করে নিয়েছে—
কারণ
লাশসকল প্রতিশোধ চায়।
লাশসকল তোমাদের অফিস করিডোরে ফাইলপত্রে
হাজির থাকবে
তারা সংবাদপত্র অফিসে নিখোঁজ সংবাদের রিপোর্টার হয়ে
বসে থাকবে
তারা রেস্তোরাঁয় হোটেলে হোটেলে
মরা মানুষের কঙ্কাল হয়ে ঝুলে থাকবে।
বিকেলে পার্কে সিনেমাহলে ঘরের সামনে
ফুলবাগানে লাশ
লাশসকল অভিনয় জানে
তারা মহিলা সমিতি মঞ্চে অভিনয় করতে চায়
তারা জীবিতদের মতো কথা বলবে
সংলাপ উচ্চারিত হবে নির্ভুল
সর্বত্র
সবখানে
সবজায়গায়
লাশসকল তোমাদের অনুসরণ করবে।
লাশসকল মনে করিয়ে দিতে চায়—
বুট ও খাকির নীচে বাংলাদেশের মৃতদেহ থেকে
পচনের আওয়াজ বেরুচ্ছে
তারা বুঝিয়ে দিতে চায়—
পাছায় রাইফেলের বাঁট মেরে শুয়োরের বাচ্চার মতো
তোমাদের খোঁয়াড়ে রাখা হয়েছে।
রাত্রিবেলা তোমাদের স্ত্রীদের ওপর
তোমাদের মেয়েমানুষদের ওপর
তোমাদের নারী ব্যবসার ওপর
চড়াও হয়ে
লাশসকল ঝুলিয়ে দেবে
তোমরা
নিবীর্য
নপুংসক
লিঙ্গহীন
উত্থানরহিত।
একদিন
জেনারেলদের মাথার খুলি লক্ষ্য করে
সমস্ত লাশ একযোগে
দ্রিম দ্রিম
ক্রাট ক্রাট
সাব-মেশিনগান
৩৬৫ বার
প্রতিদিন একবার করে বাংলাদেশকে হত্যার প্রতিশোধে
লাশসকল অট্টহাস্য করে উঠবে—
লা শ স ক ল প্র তি শো ধ চা য়
গু ম হ য়ে যা ও য়া লা শ স ক ল
প্র তি শো ধ নে বে।
(লাশ সকল প্রতিশোধ নেবে ।। ‘কাব্যগ্রন্থ: ‘আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে’)
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী মুশতাক আহমেদ (৫৩) কারাগারে লাশ হয়েছেন। মানবাধিকারের ভাষায় একে বলা হয় পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু। লেখক মুশতাক আহমেদ ডিজিটাল সিকিউরিটির এক্টের প্রথম শহিদ। বলাবাহুল্য সারা দেশে এই মৃত্যু প্রচণ্ড ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে ছিলেন।
ফেইসবুকে আইনুল হক (Aienul Hoq) মুশতাকের মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে আমার ‘লাশ সকল প্রতিশোধ নেবে’ কবিতাটি উদ্ধৃত করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। কবিতাটির একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের সঙ্গে গুম, পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু, আইনবিহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি অঙ্গা জড়িত। লাশ সকল শুধু ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ চায় না, আমাদের বিরুদ্ধেও চায়।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশে সামরিক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থদের আন্দোলন শুরু হয়। সে বছরই ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রশ্নে ছাত্র সংগঠনগুলো একমত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সচিবালয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে পুলিশ গুলি করে। বহু হতাহত হয়।
মূলত ছাত্রদের লড়াই ছিল সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে অতএব ১৪ ফেব্রুয়ারি নাগরিক ও মানবিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের দিক থেকে তরুণদের ঐতিহাসিক প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ। বাংলাদেশের রাজনীতির খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। যার কারনে ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিশাবে ঘোষিত হয়।
এই হত্যাকাণ্ড কুখ্যত হয়ে ওঠে লাশ গুম করার কারণে। যা ছাত্রদের আরও প্রতিবাদী করে। লাশগুম করার যে নজির সেদিন তৈরি হোল আজকের বাংলাদেশ তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। কবিতাটি সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছিল।
পরবর্তীতে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে তরুণদের এই অবিস্মরণীয় ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ এবং পুলিশের লাশ গুমের ঘটনা ও নজির ম্লান করে দেবার জন্য আনান মহল থেকে জোর প্রয়াস চলে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার প্রতিযোগী প্রতিটি প্রধান প্রধান জাতীয় রাজনৈতিক দল এই দিনটিকে ম্লান করে দেবার চেষ্টা করে। তদুপরি এটিকে ‘ভালোবাসা দিবস’ আকারে শাসক শ্রেণী প্রবল ভাবে প্রচার শুরু করে। এই দিনটি বাংলাদেশের তরুণদের অভূতপূর্ব বিদ্রোহের ইতিহাস থেকে পরিকল্পিত ভাবে মুছে ফেলবার চেষ্টা চলে। এর রাজনৈতিক পরিণতি একটি দেশের জন্য কি হতে পারে, কবিতাটি সেই সম্ভাব্য লাশমণ্ডিত ইতিহাসের রূপরেখা বলা যায়। এখন আমরা চতুর্দিকে হেঁটে বেড়ানো লাশের বাজারে অনিবার্য ভাবেই প্রবেশ করেছি। মানবিক ও নাগরিক অধিকার বিহীন হয়ে এরাই আবাব্র ‘ভালবাসা’ করে। মৃতের হাত ধরে মৃত হাঁটে, লাশ লাশকে চুমু খায়। তারাই ঘুরে বেড়াচ্ছে আশপাশে।
আমাদের স্মৃতি কিম্বা ইতিহাসের গহ্বরে আমরা যদি কোন জীবন্ত ঘটনাকে মৃত লাশ হিশাবে মাটিচাপা দেবার চেষ্টা করি, তখন তারা শতগুনে নতুন রূপে ফিরে আসে।
তাই, যেন সবাই বোঝার চেষ্টা করি, লাশ সকল শুধু ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ চায় না, আমাদের বিরুদ্ধেও চায়। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমরাও দায়ী।
লাশ সকল প্রতিশোধ নেবে।
ঢাকা ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১
– ফরহাদ মজহার, কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক