ফ্যাসিজম একরাতে ক্যু-এর মাধ্যমে সমাজে আসে না। এটা আসে সমাজের বৃহত্তর মানুষের সাথে দীর্ঘদিন ছলনার পথ ধরে। এই বৃহত্তর মানুষকে ছলনার জন্যে দুটি উপাদান খুবই জরুরীঃ (১) দূরের অতীত নিয়ে গৌরবোজ্জ্বল গাঁথা বা মিথ্ নির্মাণ (২)নিকট-অতীত নিয়ে ভিক্টিম-নাটক। এই দুই উপাদান যখন বৃহত্তর মানুষকে কাঁদিয়ে ফেলে, এই বৃহত্তর মানুষ তখন বীরের বেশে ফাসিজম-এর ভিত্তি গেথে দেয়।
ঠিক আছে, এটি না হয়, ফ্যাসিজমের অভ্যুদয়ের উপাদানের কথা হল। বৃহত্তর মানুষই সকষ্টে, সানন্দে ফ্যাসিজম ডেকে আনে। কিন্তু, যখন তারা বুঝতে পারে, এটি ঠিক হয় নি, তখন কিভাবে তাদের বিরোধিতা-বিক্ষোভ সত্বেও ফ্যাসিজম টিকে যায়, শেকড় বিস্তার করে, ডাল-পালা ছাড়ায়?
তখন ফ্যাসিজম এই অসম্ভব কাজটি করে দুরের অতীতের গৌরব, নিকট-অতীতের ভিক্টিম-গেম-এর সাথে বর্তমান-ভবিষ্যতের রিডেম্পশনের প্রতিশ্রুতি যোগ করে এই তিন উপদান দিয়ে ধর্ম-প্রবর্তন করে। এখানে একজন ঐশ্বরিক ব্যক্তি থাকবে। সবকিছু তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হতে হবে। এখানে একজন ধর্মাবতারও থাকবে। তিনি সব জানেন, সব দেখেন। জনগণের সব খোজ-খবর রাখেন। কিন্তু যদি কোন খারাপ কিছু ঘটে যায়, তাহলে বুঝে নিতে হবে, উনি জানতেন না, তাকে জানানো হয় নি। অতি-উতসাহী অতি-ভক্ত মুরীদেরা এগুলো করে ফেলেছে। হিটলার-মুসোলিনীর বেলায় এটিই ঘটেছিল। এস এস এফ-এর কর্মীরা কাউকে মেরে ফেললো। পত্রিকায় বদনাম উঠলো। আর সাথে সাথে এটিও পরিষ্কার হল যে, হিটলার এটি জানতেন না। জানার পরে উনি এস এস এফ-এর কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ধর্মাবতারের দোষ থাকতে পারে না। দোষ তাকে কোনদিন চাইলেও ছুতে পারবে না। জার্মান জাতি আগে খুবই শ্রেষ্ঠ ছিল, মাঝখানে অন্যায়ভাবে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মান জাতিকে ভিক্টিম করা হয়েছে, আর নতুন করে বর্তমান ও ভবিষ্যত গড়তে হলে হিটলারের রিডাম্পশন ছাড়া গতি নেই। উনার কোন দোষ নাই। উতকৃষ্ট রক্তের গডেরও দোষ নাই।
সত্যিকারের ধর্মের সাথে টেক্কা দিয়ে টিকিয়ে থাকার জন্যে ফ্যাসিজম-এর ঐ ধর্মটির কিছু ধর্মীয় বিধি-বিধান তৈরি করতে হয়। সেটির নাম হল “আইন”। এই আইন অন্যান্য সভ্য রাষ্ট্রের আইনের মত না এই কারণে যে, অন্যান্য রাষ্ট্রের আইনে এমন কিছু থাকে না যা অন্তর্নিহিতভাবে মানা কঠিন। দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক কিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলি। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বলি। সংসারের শান্তি রক্ষার্থে অহোরহ মিথ্যা বলি। বিশ্বে সভ্য রাষ্ট্রে এমন কোথাও এই আইন পাবেন না যে, মিথ্যা বললে জরিমানা বা কারাদন্ড। হ্যা, প্রতারণার অপরাধ আছে। কিন্তু মিথ্যা বলার অপরাধ নাই। কথা বলতে পারা, চিন্তা করা -এগুলো কোথাও অপরাধ নয়। কিন্তু, ধর্মে এটি পাপ। মিথ্যা বলা পাপ। ফ্যাসিজম যেহেতু নতুন একটি ধর্ম বানায়, তার কাছে তাই মিথ্যা বলা পাপ নয়, অপরাধ। ফ্যাসিজম ঠিক করে দেবে, কোনটি সত্য, কোনটি অসত্য। এর বাইরে কিছু বলা, কিছু চিন্তা করা মানেই ঈমান নষ্ট। তাদের সৃষ্টিকর্তার , তাদের ধর্মাবতারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ। তাই এটি অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি দেয়াটাও ফাসিস্ট রাষ্ট্রের ঈমানী দায়িত্ব।
ফ্যাসিজম দূর হবে কিভাবে? আমি জানি না। হিটলার-মুসোলিনীরা দূর হয় নি। ছয় কোটি লোকের জীবনহানি হতে হয়েছে এদের তথাকথিত গৌরবোজ্জ্বল গাথা, ভিক্টিম-থিয়োরি আর হিটলার-মুসোলিনীর কোন দোষ থাকতে পারে না- এই বয়ানের কারণে। এই দুঃস্বপ্ন বয়ান দূর না হলে, হি।হিটলার-মুসোলিনীকে দূর করতে পারবেন কিভাবে?
– সায়নুল হোসেন