রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অধিকাংশ গল্প-কবিতাই নারীকে ভালোবাসা ও বুঝতে পারার গুণে অনন্য। ‘এক রাত্রি’ ছোট গল্পে ‘স্বামীর মন ভালো থাকলে স্ত্রীর স্বর্গ; আর স্বামীর মন খারাপ থাকলে নারীর নরক; এইরকম নির্ভরশীল চলক হিসেবে নারী জীবনের ট্র্যাজেডিকে নিখুঁত দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে দেখে বিস্ময় জাগে; তার কী ‘নারীর মন দিয়ে ভাবার’ ক্ষমতা ছিলো; তার মাঝে কী নারী বসবাস করতো; এমন সমানুভূতি নইলে কোত্থেকে আসে; এমন প্রশ্ন জাগে। ‘পণ্ডিত মশাই’ গল্পেও কুসুম চরিত্রটির অসহায়ত্ব হেনরিক ইবসেনের ডলস হাউজের ‘নোরা’-র বিপন্নতার সমান্তরালে পাঠকের মনে জায়গা করে নেয়।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস ও ‘চারুলতা’ (নষ্টনীড়) ছোট গল্প চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সত্যজিৎ রায় যখন বেছে নেন; তখন এটা খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে; পুরুষ রবীন্দ্রনাথের তার উত্তর পুরুষদের জন্য রেখে যাওয়া উপদেশগুলোর মাঝে ‘নারী অবিশ্বস্ত’ বা স্বৈরিণী এই বার্তাটিই থিতু হয়েছে দর্শকের মনে।
ঘরে বাইরে উপন্যাসে অবশ্য ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার আগেই “স্বদেশী নামে যারা দেশপ্রেমের খৈ ফুটাচ্ছে; তারা কালক্রমে দেশ লুন্ঠনের বৃটিশের চেয়ে বড় স্যার আর লুন্ঠক হয়ে উঠবে;” সেই আভাষ স্পষ্ট হয়ে ওঠায়; রবীন্দ্রনাথকে আমার ত্রিকালদর্শী মনে হয়। আজকের মানবতা বিরোধী অপরাধের হোতা অধিকাংশ স্বদেশী রাজনীতিকের চেয়ে বড় শত্রু তো আর ইহজনমে দেখিনি দক্ষিণ এশিয়ায়।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প ‘নষ্টনীড়’ এই চিন্তা থিতু করেছে মনে; একজন দার্শনিক-কাজপাগল-নিপাট ভদ্রলোক স্বামীর চেয়ে চারুর কাছে বেশি আকর্ষণীয় ‘শাহরুখ খান’ স্টাইলে হেলিকপ্টার থেকে ঝড় উড়িয়ে নেমে আসা। প্রেমদেবতা ‘দেবর’টিকেই বেশি ভালো লাগে চারুর; যার কাজই হলো প্রেম করা। বেজিং নারী সম্মেলনের ডিক্লারেশান অনুযায়ী ‘শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার’। সুতরাং চারুর মানবিক অধিকার আছে যাকে খুশি পছন্দ করার।
বিমলা; ইন্টারনেট যুগেও স্বদেশীর মুখে ‘দেশপ্রেমের’ কথা শুনে মুগ্ধ হয়; স্বামীর উপার্জিত অর্থ ফেসবুক স্বদেশীর হাতে তুলে দেয়, স্বদেশ মুক্তির যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে। দেশ কিন্তু এখন স্বদেশী ঔপনিবেশিক ক্ষমতাসীনদের কারাগারে আবদ্ধ। এইখানে প্রতিদিন গুম হয়ে যায় ভিন্নমতের মানুষ; অন্যেরা ভয়ে ভয়ে বাঁচে। আর ইন্টারনেট স্বদেশী স্বনির্মিত টাইম মেশিনে করে সবাইকে নিয়ে যেতে চায় বিদেশী উপনিবেশের যুগে। লোডস অফ সুইফট ডেভেলপমেন্ট (এলএসডি) গল্প শুনিয়ে এই ন্যারেটিভ স্থাপন করতে চায়, এই যে দেখো আমরা কত মুক্ত এখন। অথচ ভেবে দেখো বিদেশী উপনিবেশ কত নিষ্ঠুর ছিলো। রঙ্গিন পতাকার টি-শার্ট পরে হাতে গাদা গাদা ইতিহাস বা টাইম মেশিন শাস্ত্রের বই নিয়ে কফি শপে আসে স্বদেশী। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে বিমলা। বিমলাকে সে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সভ্য হবার স্বপ্ন দেখায়। মক্ষীরাণী বিমলা হাসতে হাসতে বলে, ইতিহাস আমিও জানি গো; এই যে দেখো কফি শপের জায়গাটা দখল করেছি; এটা অতীতের মক্ষীরাণীর বাড়ি ছিলো। আমি এই দেশপ্রেমের সুনামিকালে; অতীতের মক্ষীরাণী হিসেবে চিহ্নিত করে তার বাড়ি দখল করে কফিশপ বানিয়েছি। এটা কী উন্নয়নের সূচক নয় গো!
চারুলতা আর বিমলা রবীন্দ্রযুগে প্রেম-বিরহ নিয়ে ঘরে রয়ে গেলেও ইন্টারনেটের মুক্তি আলোয় আলোয় পৌঁছাতেই; ক্ষমতা-কাঠামোর মক্ষীরাণী হয়ে উঠেছে। সে পুলিশের সঙ্গে কানেকশান ধরে রাখতে ফেসবুকে গিয়ে সুপারকপের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। তার পোস্টে লাভ ইমো দিয়ে পুলকিত হয়। তাকে কোন ধর্ম-হুজুর ইনবক্সে প্রেমের প্রস্তাব দিলে সে সংস্কৃতি হুজুরকে রিপোর্ট করে। সংস্কৃতি হুজুর তখন হারকিউলিসকে দিয়ে ধর্ম হুজুরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আনে। ‘কেমন ক্ষমতা দেখালাম বলে চারুলতা ও বিমলারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
ঐদিকে চারুলতার স্বামী ও বিমলার স্বামী; যারা স্ত্রীর অবহেলায় ম্রিয়মাণ; তাদেরও ইনবক্সে এসে পড়ে সোশ্যাল ক্লাইম্বার রেড স্প্যারো। বলাই বাহুল্য এরা সবাই পুলিশের ইনফর্মার ও গোয়েন্দা সংস্থার স্টিং অপারেশানের লাল চড়ুই।
লাল চড়ুইদের রক্রুট করা হয়; মিলনকন্ঠের পাঠক ফোরাম থেকে; রুপালী পর্দার চলচ্চিত্র বন্ধু সুপারকপ হয়ে কিংবা শো’বিজের কালচারাল ভটভটির আসর থেকে। এই লাল চড়ুইয়েরা সচিবালয়ে গিয়ে বিভিন্ন টেন্ডারে দশ পার্সেন্ট ফেয়ার এন্ড লাভলি ক্রিম দিয়ে সরকারি নেসাকে লালচড়ুই-এর মতো গ্ল্যামারাস বানিয়ে দেবার লোভ দেখায়। আর যৌন অবদমনে তারুণ্যে নারীসঙ্গ বঞ্চিত পুং লিঙ্গম; লাল চড়ুই দেখলেই তার লেট ইয়ুথ বা দেরিতে আসা যৌবনের দোলায়; গায়িকা মিলার ‘দে দোলা’ গানের সিঁড়ি বেয়ে ‘গোট ক্লাবে’র বাবু খাইসো’র আসরে মাতোয়ারা হয়।
ক্ষমতার কেল্লায়; কেউ কারো নয়। ফলে গোট ক্লাবে এনে গোট বা বাকরা বানানো ক্ষমতা কেল্লার শত বর্ষের ঐতিহ্য। বৃটেনে যখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছিলো; ভারতবর্ষের মুসলমান শাসক ও হিন্দু রাজারা তখন স্থাপন করেন ‘হারেম’ আর ‘বাইজিবাড়ি’-র রূপশালা।
শরৎচন্দ্রের পার্বতী এ যুগে এসে পূজা-আর্চা করতে করতে বিজেপিকে ভোট দেয়ার জন্য অস্থির। চন্দ্রমুখী লিবেরেল দাদুদের সঙ্গে মেলামেশায়; খানিকটা শাশী থারুরের স্ট্যান্ড আপ কমেডিতে ইতিহাস বা টাইম মেশিনের গল্প শুনে; ভোটটা কংগ্রেসে না দিলেও তৃণমূল কংগ্রেসে দেবে; এমন একটা ভাব তার।
রাজনীতির পরম মমতায় পরিবারতন্ত্রের পুত্রের যে ‘অভিষেক’ ঘটে সেইখানে দশপার্সেন্টের টেন পার্সেন্টের ব্যবসায়; রাজলক্ষীর রূপচর্চার পার্লার খুব কাজে দেয়। শরতের মাথায় জ্বরের জলপট্টি দেবার সময় আর রাজলক্ষীর নেই। সে এখন ক্ষমতার রাজলক্ষী; সেকেন্ড হোম তৈরির ডেমোক্রেটিক ওয়ান স্টপ সলিউশান।
পার্বতীর স্বামী ‘দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকিনা’ বলে টুপ করে, দাদা আমি শুধু অমিত শাহ’র সঙ্গে’ থাকি বলে; হাতে ত্রিশূল তুলে নেয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লার লালসালুর মজিদ এখন মডেল মসজিদের খতিব। লাইলাতুল ইলেকশানের সভ্য ব্যাপারীর ধর্মীয় অনুভূতির টেন পার্সেন্ট ব্যবসার লোকাল এজেন্ট মজিদ। তারো ইচ্ছা করে ব্যাপারীর সঙ্গে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার শাকা মহানগরীতে গিয়ে একটু ফূর্তি-ফার্তা করা। টেকাটুকার দুর্জয় উন্নয়নের সংস্কৃতি-মামার পাপিয়া শিখরে যাবার শখ ধর্ম-মামারো আছে। কিন্তু সেক্যুলার ধারাপাত তাকে ‘ও মজিদ তুই রাজাকার’ বলে তাচ্ছিল্য করলে ব্যাপারী সাহেব মজিদকে সোনারগাঁর জান্নাতি রিসর্টে পাঠিয়ে দেয়। ক্ষমতার কেল্লায় ওরা কেউ কারো নয়। তাই খেলা হবে দাদা নারীসহ গ্রেফতার করে মজিদকে। আর ব্যাপারীকে চলচ্চিত্রবন্ধু গ্রেফতার করেন তার নিজ বালাখানা গোট ক্লাব থেকে; যথারীতি নারী ও সেক্যুলার বোতলসহ।
ন্যায়বিচার আর নারী স্বাধীনতার দাবীতে তৃষ্ণার্ত লিভিং রুম ওয়ারিয়র’স প্রতিদিন ইস্যু ধরে ধরে পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের মন্ত্র পাঠ করে। খিলাফতের স্বপ্নে বিভোর নিউমদিনার ‘সূর্যের চেয়ে গরম বালু’ মিডিয়ার খবরের লিংকে নারীকে গালাগাল করে চারটি বিবাহ ও বাহাত্তরটি হুরের কল্পনায় কলতলা বিনির্মাণ করে; সেইখানে যৌবন জ্বালা নিউ ওয়েভের শিয়ালেরা এসে ক্রিপি গ্যাং-এর খিস্তিনামা পেশ করে বলে, এইটা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। অন্যদিকে খিলাফতের সিক্সপ্যাক জোনাকী বলে, এইটা জিহাদ; কাফের মারার কাল।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া