‘…অনেকে ভাবেন যে, সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামের জন্য বামফ্রন্টকে মূল্য দিতে হল। সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রাম নিঃসন্দেহে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের কাজটা করেছে, যা থেকে বামফ্রন্ট বিরোধী দাবানল সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ৩৪ বছর পর বামফ্রন্টের ক্ষমতা হারানোর প্রক্রিয়া হঠাৎ করে শুরু হয়নি। ‘৭৭ সালের ক্ষমতাসীন হবার সময় থেকেই সমগ্র প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করলে এই সত্য উঠে আসে।
আসলে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর থেকেই বাম সরকারের কাজকর্মে দু’টি প্রক্রিয়া পাশাপাশি চলতে থাকে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হল কয়েকটি ভাল কাজের প্রক্রিয়া। যেমন, দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক বন্দির নিঃশর্ত মুক্তি, শিক্ষাসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে নৈরাজ্য হটিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার। আমূল ভূমি সংস্কারের নীতি অনুযায়ী খেতমজুর দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে খাস জমি বন্টন, বর্গা অপারেশন চালু করা, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সমাজের সর্বস্তরে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কায়েম করা ইত্যাদি। দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি হল, সমাজের সর্বস্তরে দলীয় আধিপত্য কায়েম করার প্রচেষ্টা। যত দিন গেছে, ততই প্রথম প্রক্রিয়াটি দুর্বল হতে হতে ১৯৮৫ সাল নাগাদ পরিত্যক্ত হয়েছে, যদিও তার রেশ রয়ে গেছে ‘৮৭, ‘৮৮ সাল পর্যন্ত, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে। এবং সর্বস্তরে দলীয় আধিপত্য কায়েম করার কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে নব্বই-এর দশক থেকে সমানে মানুষজনের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ক্রমেই বেড়েছে। এই দলীয় আধিপত্য কায়েম করার পাশাপাশি পার্টির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠীবাজি ইত্যাদি সমানে বেড়েছে। কিন্তু হাতের কাছে কোনও বাস্তবক্ষম বিকল্প না থাকায় বাম সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ গিলে নিয়ে, উপায়ান্তর না থাকায়, মানুষজন বাম সরকারের সমর্থনে থেকেছে। কৃষিজমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে, এই বিক্ষোভ পাহাড়প্রমাণ হয়েছে। এবং এই বিক্ষোভের পাহাড়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে। এই বিশ্লেষণ দেখিয়ে দেয় যে, বাম সরকারের অপসারণে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম বা মমতাদেবীর ভূমিকা নিমিত্ত মাত্র। রেজিমেন্টেড পার্টির শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের বহু বৎসরের ক্ষোভ বাম সরকারের অপসারণের কারণ।’ (নকশালবাড়িনামা: অসীম চট্টোপাধ্যায়, দেশ ২ ডিসেম্বর ‘২১)
এই বিশ্লেষণ সংক্ষিপ্ত ও কিছুটা সরলীকরণ হলেও, অনেকাংশেই সহমত হওয়াই যায়।
যদিও বাম নয়, আসলে সিপিএম পরিচালিত সরকার। তথাকথিত বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলো মূলত ক্ষমতার ভাগীদার। সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে শরিক দলগুলোর নেতাদের ব্যক্তিগত ‘শ্রীবৃদ্ধি’, দলীয় তহবিল পূর্ণ করাও। ফ্রন্ট আমলে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল প্রধানত শরিক দলগুলোই। রাজনৈতিক গুরুত্ব আগেও ছিল না, সংসদীয় ক্ষমতা চলে যেতেই ওগুলো সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে সত্যি, কিন্তু সিপিএম যে আজকে নিশ্চিহ্নপ্রায়, তার মূল কারণ, দলটির ‘বামপন্থী’ চরিত্র হারিয়ে ফেলা।
– কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, কলকাতা থেকে