পৃ
থিবীর আদিমতম পেশা পতিতাবৃত্তি। এ পেশার জন্ম পুরুষের হাত ধরে, পুরুষের স্বার্থে। নারীদেরকে পতিতা বানিয়ে পুরুষ তার শয্যায় গিয়ে আনন্দ করেছে । তারপর বাইরে বের হয়ে এসে, “*শ্যা, মা*, **কি” বলে গালি দিয়ে নিজে সাধু সেজেছে। এ ধরনের নারী বহুগামী ও ছলনাময়ী বলে কোনদিন পুরুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারে নি। অথচ এমন বহুগামী হবার পাঠ কিন্তু নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের থেকেই নিয়েছে। বহুগামী নারী যদি এতই ঘৃন্য হয়ে থাকে, তবে একই সমাজে বহুগামী পুরুষেরা ‘এত ‘পূত পবিত্র’ থাকেন কী করে? বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সব সময় পুরুষের বহুগামিতাকে শক্তিমত্তা, ক্ষমতা ও পৌরুষের প্রতীক হিসেবে বাহবা দিয়েছে। তাই নারীও মেনে নেয় পুরুষের বহুগমনকে। ভাবে, ‘’পুরুষ মানুষ একটু আধটু অমন তো হবেই।‘’ যেন বহুগামী না হলে পৌরষত্বই প্রকাশ পায় না।
কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি মেয়ের ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ে। তার প্রেমিকই এ কাজটি করে। মেয়েটির অপরাধ ছিলো, সে ছয় তরুণের সাথে প্রেম চালিয়ে দামী দামী উপহার নিচ্ছিলো। স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটির গায়ে “*শ্যা, মা*, **কি”তকমা লেগে যায়। এখন কথা হচ্ছে, মেয়েটি এভাবে ছয় তরুণের সাথে প্রতারণামূলক সম্পর্কে গড়ে তোলার ধারণা কিভাবে পেয়েছিলো? মেয়েটি জানে, বস্তুগত পৃথিবীতে এখন কেউ আর কাউকে ভালোবাসে না। শুধু সময় কাটায়। এমন কি সেই ভাইরাল হওয়া ভিডিওতেও ঐ প্রেমিককে বলতে শোনা যায়, “আমরাও টাইম পাস করছি ভাই।” সুতরাং মেয়েটিরই বা কী দায় ঠেকেছে ভালোবাসার? পুরুষের দূর্বলতার জায়গাগুলো অল্প বয়সেই সে আবিষ্কার করে ফেলেছে। সেই সুবিধা কি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আউটপুট এই চতুর মেয়েটি ভোগ করবে না? শুধু এই মেয়েটিই বা কেন? নিজের দৈহিক রূপ ও সৌন্দর্য ব্যবহার করে যেসব নারী তাদের চেয়ে যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিদের ( ব্যক্তিই বলছি, এ ব্যক্তি নারী বা পুরুষ যে কেউ হতে পারে) সহজে সফলতা পেয়ে ফেলেন, তারাও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই আউটপুট। আপনারা পুরুষের বহুগামিতাকে পৌরুষ ও শক্তিমত্তার প্রতীক বলে হাততালি দেবেন, আর সে বিবাহিত হয়েও অন্য নারীকে তার বিছানায় আহবান জানাবে না? এখন অন্য নারীও যদি সেই অন্যের স্বামীর সাথে একান্ত সময় কাটিয়ে দামী উপহার হস্তগত করে, ক্যারিয়ারে সাফল্য অর্জনের সুবিধা নিয়ে থাকে, তবে দোষটা কাকে দেবেন? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এভাবেই নারীদেরকে চতুর করে তুলছে। নারী আজ জেনে গেছে, এ সমাজ তার মেধা, যোগ্যতা ও হৃদয়ের মূল্যায়ন করতে জানে না।
কিছুদিন আগে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম, যেখানে প্রতারক ও বহুগামী এক প্রেমিককে তার প্রতিহিংসাপরায়ন প্রেমিকা খুন করে ফেলে। নিসন্দেহে বেশ নৃশংস গল্প। গল্পটি লিখেছিলাম একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এক পাঠক এটি পড়ে মন্তব্য করেন যে, এতে আবহমান বাংলার নারী চরিত্র ফুটে ওঠে নি। আহা, আবহমান বাংলার পুরুষ! তারা নিষ্ক্রিয় ক্লীব লখিন্দর হয়ে মৃত হয়ে পড়ে থাকবে আর তার জন্য নারীকে বেহুলা হয়ে একক লড়াই করতে চালিয়ে যেতে হবে! কী সুন্দর প্রত্যাশা! অথচ এই লখিন্দরকে উদ্ধার করতে গিয়ে বেহুলাকে দেবতাদের (মানে সমাজপতিদের) সামনে অশ্লীলভাবে নাচতে হয়েছে, যৌন হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। এতকিছুর পরেও আপনারা আবহমান বাংলার সেই সহজ সরল বেহুলাকে প্রত্যাশা করেন কিভাবে? এ সমাজ বেহুলাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে বদলে দিয়েছে। হুমায়ুন আজাদ একটি কবিতায় লিখেছিলেন যে, বর্তমানে নারীদের ঠোঁট, স্তন ইটের মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। নারীদের দেখলে শক্ত দেয়াল বলে মনে হয়। সত্যিই তাই, এ সমাজ নারীদের এমন ভাবে বদলে দিয়েছে যে তার ভেতর থেকে কোমলতা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। রূক্ষ্ণ কঠিন পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তাকেও কঠিন কর্কশ হতে হচ্ছে। বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে ১০৮ টি নীলপদ্ম খুঁজে এনে দিলেও তাই, বরুনার বুকে আজ শুধুই মাংসের গন্ধ পায় সুনীলেরা।
– তানিয়া কামরুন নাহার, লেখক ও শিক্ষক