নারীর পোশাক নিয়ে সমগ্র বিশ্বে সবারই যেন ভীষণ মাথা ব্যথা! নারী কী পরলো, কিভাবে পরলো তা নিয়ে চলে চুল চেরা বিশ্লেষণ। নারী কী পরবে তা একেবারেই নারীর সিদ্ধান্ত। বলা হয় বটে, ‘’ইটস হার চয়েজ’’, কিন্তু আসলেই কি ব্যাপারটা তাই? সম্প্রতি নরসিংদীতে একজন তরুণী তার পছন্দের স্লিভলেস টপস ও জিন্স পরার কারণে জন আক্রোশের শিকার হয়। অর্থাৎ নারীর পোশাক হতে হবে সমাজ নির্ধারিত ও অনুমোদিত। নারীর নিজস্ব রুচি , ইচ্ছা বা চয়েজের কতখানি মূল্যায়ন হলো এখানে?
আবার যে নারী বোরকা ও হিজাব পরছেন, তিনিই বা কতখানি নিজের ইচ্ছেতে , নিজের চয়েজে পরছেন? বেগম রোকেয়ার ‘’অবরোধবাসিনী’’ বইটিতে আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগের নারীদের অবস্থা চিত্রিত হয়েছে। নারীদেরকে রীতিমতো অসূর্যস্পর্শা হয়েই সে সময়ে জীবন কাটাতে হতো। অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ দূর্ঘটনা, ডাকাতের কবলে পরা কিংবা গরমে প্রচণ্ড খারাপ লাগা কোন কিছুতেই নারীর নিজের কিছু বলার ছিলো না। আগুনে পুড়ে তারা নিঃশব্দে মারা যেতো। ডাকাতের অস্ত্রাঘাতে অঙ্গহানি হলেও টু শব্দটি করতো না। ‘’কষ্ট সহ্য করিতে না পারিলে অবরোধবাসিনীদের আর বাহাদুরি কিসের?’’ তারা মুখে বুজে কষ্ট সহ্য করে যেতো, অমন নির্মম ও কঠোর পর্দাপ্রথাতে তাদের জীবন চলে গেলেও প্রতিবাদ করতো না। অথচ গরু ছাগলও তার বিপদ টের পেলে শিং দিয়ে পালটা আঘাত করে, প্রতিবাদ করে, কুকুর বিড়ালও খামচি মারে, কামড় মেরে আত্মরক্ষা করে। সেই ২০০ বছর আগে কঠোর পর্দাপ্রথার ভেতর নারীরা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবন যাপন করতো। সমাজ ও ধর্মের নামে চাপিয়ে দেয়া এমন পর্দাপ্রথা কিভাবে একজন নারীর নিজস্ব চয়েজ হতে পারে?
২০০ বছর পর নারীদের অবস্থা খুব একটা বদলেছে বলা যাবে না। আবারও নারীদের মধ্যে কঠোর পর্দাপ্রথা জনপ্রিয় হতে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের নারীরাও বোরকা নেকাব পরতে বাধ্য হচ্ছেন। অবশ্যই নিজের ইচ্ছেয় নয়। তারা পরছেন, ভয়ে, আতঙ্কে। এদিকে বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতে কালো হাত মোজা, পা মোজা, চোখ কান মুখ সব ঢাকা পোশাক একজন নারীর জন্য নিশ্চয়ই আরামদায়ক নয়। তবুও পর্দাপ্রথার নামে নারীরা এসব মেনে নিয়েছে। নিজের ইচ্ছেয় নয়, পরিবার বার স্বামীর ইচ্ছেতে অনেকে এমন কষ্টকর পোশাক পরতে বাধ্য হচ্ছেন।
পাশাপাশি বোরকা পরার বেলায় ‘’ইটস হার চয়েজ’’ এমন দাবীও উঠেছে। যেভাবেই হোক, বোরকা পরার কারণ মূলত, নারীকে শুধুমাত্র যৌনপণ্য ভাবা। যে যত বেশি পর্দানশীল, তিনি নিজেকে তত বড় যৌনপণ্য হিসেবেই ভাবেন। যৌনপণ্য না হলে স্বাভাবিক মানুষের মতোই নিজের আরাম ও স্বাস্থ্য বিবেচনা করে পোশাক নির্বাচন করতেন। কিন্তু নিজেকে পুরুষতান্ত্রিক চোখ দিয়ে যৌনপণ্য হিসেবে দেখেন বলেই, নিজের চয়েজ হিসেবে চোখ মুখ কান ঢাকা বোরকায় নিজেকে আটকে ফেলেছেন। ইদানিং তো আবদারও করা শুরু হয়েছে, জাতীয় পরিচয় পত্রেও নিজের চেহারা তারা দেখাবেন না। তাদের আবদার মেনে নিলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিও তৈরি হবে। ইদানিং তো বোরকার ছদ্মবেশে দুষ্কৃতকারী পুরুষও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে! বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী গ্রন্থেও এমন চিত্রই আমরা দেখেছি।
হয়তো সত্যিই নারীরা এমন কষ্টকর পোশাক নিজের ইচ্ছেতেই বেছে নিয়েছেন। ঘরের পোশাকের উপরে ঝট করে একটা বোরকার আবরণ দিয়ে ফেললে সময় বাঁচে, এ কারণেও অনেকে বোরকাকে গ্রহণ করেছেন সানন্দে। ভেতরে যতই সদরঘাট অবস্থা থাকুক, কে আর এসব টের পায় বলুন?
আবার স্লিভলেস পোশাক পরতে গেলেও নারীদের মধ্যে একটা ট্যাবু রয়েছে যে, ওয়াক্সিং, ম্যানিকিউর ছাড়া এসব পরা যাবে না। এজন্য বেশ অনেকটা সময়, শক্তি ও অর্থও খরচ করতে হয় নারীদেরকে। এমন কি এসব পোশাক পরতে হলে নাকি হাত মোটা থাকলে হবে না, লম্বা আর সরু হতে হবে! বয়স্ক নারীরা পরতে পারবেন না, কারণ তাদের চামড়া ঝুলে গেছে! বহু পুরুষের মুখেই শুনেছি, কম বয়সী হলে তাও ভালো লাগে, বুড়িরা কেন এসব পরবে? অর্থাৎ পুরুষের চোখকে খুশি রেখে স্লিভলেস বা জিন্স পরতে হবে!
আবার সব সময় স্লিভলেস বা মিনি স্কার্ট পরলে রোদে স্কিনের রঙ খারাপ হয়ে যাবে। এগুলোও মাথায় রাখতে হবে। কারণ গায়ের রঙ ফর্সা রাখতেই হবে! নাহলে পুরুষতন্ত্র গোস্বা করতে পারে। মোটামুটি এই হলো আমাদের নারী স্বাধীনতার নমুনা! এখনো পুরুষতন্ত্রের মন জুগিয়ে স্লিভলেস, মিনি স্কার্ট পরতে হচ্ছে। তাহলে এগুলো নারীর নিজস্ব চয়েজ হলো কী করে? ওয়াক্সিং, ম্যানিকিওর ছাড়া স্লিভলেস পরা যাবে না, বয়স্ক নারীরা পরতে পারবেন না, এগুলাকে আমরা ট্যাবু বানিয়ে ফেলেছি।
তাই বলে আমি বলছি না যে, একজন স্বাধীন নারী রূপচর্চা করবেন না, প্যাডিকিউর, মেনিকিউর করবেন না। অবশ্যই তার ইচ্ছে হলে এগুলো করবেন, নিজেকে সুন্দর রাখা অবশ্যই শিল্প। এছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন একজন নারী চাইলে এসব রূপচর্চা করতেই পারেন, এগুলো তার স্বাধীনতারই অংশ। কিন্তু আন্ডার আর্মের লোম রেখে দিয়েই কিংবা বয়স হয়ে চামড়া ঝুলে গেছে, এমন কেউ যদি স্লিভলেস পরে, তাহলে কেন কটু মন্তব্য শুনতে হবে? এগুলোও কি নারীর স্বাধীনতা নয়? স্লিভলেস পরতে হলেও কি পুরুষতন্ত্রের মন জুগিয়ে পরতে হবে? নিজেকে যৌনপণ্য হিসেবেই উপস্থাপন করতে হবে?
নারীরা শাড়ি পরুক, স্কার্ট, টপস, স্লিভলেস, জিন্স, বোরকা, হিজাব যা খুশি তাই পরুক। তবুও যেন সে নিজের ইচ্ছেতে, নিজের রুচি ও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ ঘটিয়েই পরে। সমাজ বা অন্য কারো চাপিয়ে দেয়া ইচ্ছেতে যেন তাকে পোশাক নির্বাচন করতে না হয়। নারীরা পোশাকের জন্য যেন কারো আক্রমণের শিকার হতে না হয়, এজন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন দরকার, তেমনি প্রত্যেকের রুচির বৈচিত্রের প্রতিও সবার শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত।
– তানিয়া কামরুন নাহার, লেখক ও শিক্ষিকা