আমি বিশ্বাস করি, ধর্ষণ একটা সিস্টেম্যাটিক ক্রাইম। কাঠগড়ায় স্রেফ ধর্ষক কে একা উঠালে হবে না! বুঝতে ভুল করলে চলবে না যে, এর পেছনের লাইনটা বিরাট লম্বা। এবং অদৃশ্য।
◾স্রেফ একটা সাবান-পারফিউমের বিজ্ঞাপনেও বাধ্যতামূলকভাবে থাকবেন লাস্যময়ী একজন নারী। গাড়ির এক্সিবিশনে গাড়ির পাশে শরীরের সব ভাঁজ প্রকাশ করে দাঁড়ানো থাকবেন স্বল্প বসনা নারী। স্টেডিয়ামে খেলার ফাঁকে ফাঁকে নারীকেই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চিয়ার আপ করা লাগবে, নতুবা নাকি খেলাটা ঠিক জমেনা। বিলবোর্ড এ তাকান। মিলান তো, কয়টাতে নারী দেখেন? আর কয়টাতে পুরুষ?
এই পুরো প্রসেসে কই পুরুষকে তো এতোটা সেক্সুয়ালি অব্জেক্টিফাই করা হয়না! উল্টো মজার ব্যাপার হল, যাদের হাতে এই বিশাল ইন্ডাস্ট্রি তারাই ‘নারী স্বাধীনতা’ ‘নারী স্বাধীনতা’ বলে ব্যাপক মায়াকান্না করবে!যেন এই এক্সিবিশন এর প্রোডাক্ট হওয়া ছাড়া নারীর স্বাধীনতার অন্য কোন সংজ্ঞা থাকতে নেই।
‘নারী স্বাধীনতা’ আর এই ‘নারীর শরীরের ভোগবাদী ব্যবচ্ছেদ’ কিভাবে একই সাথে হাত ধরাধরি করে চলতে পারে – আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক সেটা কোন যুক্তিতেই ফেলতে পারেনা।
◾নারী চায় পুরুষ তাকে সম্মান করবে।
খুব ইনোসেন্ট সুইট একটা চাওয়া।
চলেন দেখি কি শিখছে আমাদের ছেলেরা?
পর্ণোগ্রাফি।
হাজার হাজার ল্যাপটপ, মোবাইলের মাধ্যমে পুরো সমাজে সিম্পলের ভেতরে গর্জিয়াস ম্যাসেজ আসছে যার হাত ধরে!
রিসার্চ বলে পর্ন থেকে আমরা শিখি, একটা নারীর শরীরের সাথে তো যা ইচ্ছা তাই করাই যায়! শিখি Male Dominance। শিখি সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স। Perverted sexual behaviour। হারাই Empathy।
মাত্র একটা ক্লিক! ব্যাস!! ঘন্টার পর ঘন্টা ব্রেইন ট্রেইন এর সুযোগ তৈরি হয়। পুরুষ শেখে –
নারীর শরীর = ভোগ! ভোগ! এবং ভোগ!
যত Violence তত উন্মত্ত আনন্দ!
আমরা কি জানিনা এইটা একটা সমস্যা? কই কেউ তো বলে না এই ইন্ডাস্ট্রির প্রচার প্রসার বন্ধ হোক?চোখে আংগুল দিয়ে দেখান। উল্টো শুনবেন – Who are you to judge me?
বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি এটা – হাত ও দেয়া যাবেনা! এদিকে ঘরে ঘরে কবে একজন সেন্সিটিভ মানবিকতাবোধ সম্পন্ন কিশোর কিভাবে ধীরে ধীরে ইন্সেন্সিটিভ একজন ভোগবাদী পুরুষ হয়ে উঠল – আপনি আমি হয়তো বুঝব ও না।
◾এবারে আসা যাক, ধর্ষিতার জামাকাপড় বা বয়স এর প্রসংগ। এসব টেনে এখানে জল ঘোলা করেও কোন সমাধানে পৌঁছাতে পারবেন না।উল্টো বুঝবেন এরা শুধু সেই রেপিস্ট এর ভিক্টিমই আসলে নয় বরং এই পুরো সিস্টেম্যাটিক করাপশনের ভিক্টিম!
রেপিস্টরা তাদের সেক্সের স্টিমুলেশন এই ভিক্টিমদের মাধ্যমেই পেয়েছে- এতো বোকা বোকা চিন্তা করে সুখে থাকি কি করে বলুন তো?
Arousal/Sexual Excitement এর উৎপত্তি আর সেক্স কার সাথে করা হচ্ছে – এই দু’টোর সোর্স যে একই হওয়া জরুরী না এটা ছেলেদের না বোঝার কোন কারন নেই। দূরে যেতে হবেনা। মাস্টারবেশন এর প্রসেসটাতে একটু দৃষ্টি দিলেই এর সত্যতা মিলবে।
বিলবোর্ড, ইউটিউব,পর্ণ, মুভি – এই রকম মাধ্যমগুলো যে বিশেষ করে পুরুষদের সেক্সের ব্যাপারে ফ্যান্টাসি তৈরিতে,Desire তৈরিতে এই বিশাল ভূমিকা রাখে – আপত্তি আছে কারো?
তাই হিসাব সহজে বুঝে ব্রেইন কে শান্তি দেয়া জরুরী।
বুঝে নিন, Sex কে fantasize করা যায়। আর তা থেকে arousal/excitement এ যাবার পর শিশু, বৃদ্ধা, অসহায় গৃহিণী, একা মেয়ে, বোরকা পরিহিতা, বিড়াল, কুকুর সবই চলবে। ভিক্টিম হিসেবে সব ক’টাই ভাল চয়েস। কারন কপাল ভাল থাকলে টু শব্দটাও হবেনা। চাইলে মেরেও ফেলা যাবে। প্যাড়া দিবে কম।
নারীর শরীরটাকে সেক্স অবজেক্ট হিসেবে যারা উপস্থাপন করে, আমার চোখে তারা প্রত্যেকে একেকটা রেপিস্ট। আমি ধর্ষকের বিচার চাই আমি এদের ও বিচার চাই।
এ তো গেল ধরাছোঁয়ার বাইরের এক জগতের কথা!
◾সমাজ বা রাষ্ট্রের দায় কোথায়? নারীকে কেন গলা ফাটিয়ে নিরাপত্তা চাইতে হবে?
কত ধর্ষণ এর খবর এলো গেল! কার কবে বিচার হল? বিচারক কোথায়? আইনের শাসন কেবল ধর্ষণে এসেই কেন পল্টি খায়? এর উত্তর কে দেবে?
ধর্ষণের বিচার নিজেই যেন একটা তামাশা। ভরা মজলিশে ভুক্তভোগী নারীর মুখ থেকে ঘটনা শোনার নামে আরেকদফা যৌনতৃপ্তি হাসিল। খারাপ না ব্যাপার টা। চলছে চলুক! ও মেয়েটা একটু কাঁদছে? আরেহ! মেয়েই তো!
◾বাবা-মায়েরা আমরা কি করছি? একেক টা ধর্ষক আমাদের ঘরে ঘরে বড় হল, আমরা বুঝলাম ও না! ছেলে বখে গেল, পচে গেল – আমরা এই পুরো সিনেমাতে নাই কেন?
কিশোর গ্যাং, টিকটিক গ্যাং, মোবাইল এডিক্ট একটা জেনারেশন! কিসের আমাদের ভয়? ওদের জীবনবোধ আপনি আমি না শিখালে অন্যরা যে শিখাবে এটা কি কোন রকেট সায়েন্স?
◾এই সমাজে আমাদের প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা ম্যাটার করে। নারী হই বা পুরুষ। আমরা কে কতটুকু আমাদের সেই করণীয়টুকু নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি?
আইনের শাসন নাই, যৌনতার অবাধ সুঁড়সুড়ি সব দিকে,দিন যত যাবে নারী ভোগ্যপণ্যের জায়গায় আরো পৌঁছাবে, পুরুষ চোখ নামাবে না –
তাই মানুন, আরো ধর্ষণ হবে। স্রেফ দেখে যাবেন, স্ট্যাটাস দিবেন, সয়ে যাবে। ধর্ষকের একার উপর ক্ষোভ ঝেড়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত রাখতে পারবেন এতেই আত্মতৃপ্তি। এই সিস্টেম পিছে মুচকি হাসবে।
কিছু কান্নার শব্দ প্রতিদিন এই পৃথিবীকে অভিশাপ দিয়ে যাবে!
একটা সমাজে Chaos টা তখন হয় যখন Values, morals, ethics নিয়ে কথা বলতে আমাদের বুক কাঁপে অথবা আমরা বলা বন্ধ করে দেই।
আমরা সেই যুগে পা দিয়ে ফেলছি। বাকিটা পথ ভাঙনের।
-ডাক্তার সুষমা রেজা ( এমবিবিএস,এমডি)