ফেব্রুয়ারী ২০২৩ এর মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল আগের মতই উদ্বেগজনক। দেশে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বন্দুকযুদ্ধ, তাদের পরিচয়ে অপহরণ ও অপহরণের চেষ্টা, গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মৃত্যু, নির্যাতন, অপতৎপরতার অভিযোগের মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের উপর সহিংসতার ঘটনা কিছুটা নিম্নগামী হলেও তা এখনও উদ্বেগজনক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অপব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকদের বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা ও নির্যাতন করার মত ঘটনা বন্ধ হয় নি। রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা বেড়েছে। অধিকন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানের বদলে রাষ্ট্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বন্দুকযুদ্ধ
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ এ বন্দুকযুদ্ধের ২টি ঘটনা ঘটেছে। কথিত গোলাগুলির দুটো ঘটনার মধ্যে একটিতে র্যাব ও অপরটিতে পুলিশের সম্পৃক্ততা ছিল। দুটো ঘটনাতেই কোন হতাহতের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলেও ২ জনকে র্যাব ও পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
৭ ফেব্রুয়ারী, সকালে বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় র্যাবের সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ ও নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার সদস্যদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ১জনকে আটক করলেও হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেছে কি-না তা র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়নি। ২১ ফেব্রুয়ারী নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আমানউল্যাহপুর ইউনিয়নের গোবিন্দেরখিল গ্রামে পুলিশের সঙ্গে কথিত ডাকাতির প্রস্তুতিকালে অস্ত্রধারীদের গোলাগুলির পর অভিযান চালিয়ে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও অপহরণের চেষ্টা
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ মাসে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৬ জন নাগরিককে তুলে নিয়ে যাওয়া ও অপর একটি ঘটনায় দুইজনকে তুলে নেয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে।
৩১ জানুয়ারী অপরাহ্নে রাজধানীর মতিঝিলের ফকিরাপুলে হেরার জ্যোতি ডিজাইন অ্যান্ড প্রিন্টিংয়ের মালিক মমিনুল ইসলাম ও ছাপাখানার ডিজাইনার সাইফুল ইসলামকে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেছে তাদের স্বজনেরা। দুই দিন ধরে পল্টন, মতিঝিল, ডিবি কার্যালয়ে ঘুরেও তাঁদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ থাকার দুই দিন পর বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী মমিনুল ইসলামকে গ্রেফতার করার কথা স্বীকার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ।
২ ফেব্রুয়ারী, যশোর শহরের খড়কি এলাকায় নিজ চেম্বার থেকে মো. সেলিম হোসেন (৪৫) নামের এক পল্লিচিকিৎসককে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে ৭ ফেব্রুয়ারী, সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন পরিবারের সদস্যরা। সেলিমের স্ত্রী নাজমা খাতুন পরদিন কোতোয়ালি থানায় একটি অভিযোগ করেন। যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে তাঁর কিছুই জানা নেই।
২০ ফেব্রুয়ারী, রাত ৮টার দিকে রাজধানীর রামপুরার নিজ বাসার সামনে থেকে ডিবি পরিচয়ে একটি কনসালটেন্সি ফার্মে চাকরিজীবী মো. রোকনুজ্জামান রকসি নামে এক যুবককে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ এনে বাড্ডা থানায় জিডি করেছে পরিবার। সাদা পোশাকে তাঁকে কয়েকজন লোক একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আর তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
১ ফেব্রুয়ারী, কুমিল্লার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাধাইয়া সামিট পাওয়ার গেট এলাকায় ঢাকামুখী একটি মাইক্রোবাসের গতিরোধ করে একটি প্রাইভেটকার। এসময় ডিবি পরিচয়ে মাইক্রোবাস থেকে দুই যাত্রীকে নামিয়ে প্রাইভেটকারে উঠানোর চেষ্টা করে। স্থানীয় জনতার সন্দেহ হলে তারা ফরিদ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে। তার কাছ থেকে হাতকড়া, ওয়াকিটকি, খেলনা পিস্তলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারী রাত সাড়ে ৮টার দিকে সাভার পৌর এলাকার তারাপুর মাঠ থেকে সাদা গাড়িতে ৫/৬ জন সাদা পোশাকে এসে নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে পোশাক শ্রমিক তুষার মিয়া (২০), রাসেল মিয়া (১৯) ও স্বপন মিয়াকে (২০) তুলে নিয়ে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে ডিবি অফিসে গিয়ে খোঁজ নিলে সেখান থেকে জানানো হয় তারা সাভার থেকে এরকম কাউকে তুলে আনেননি। অথচ ২৭ ফেব্রুয়ারী সকালে তারা ঢাকার মিন্টু রোডে ডিবি কার্যালয়ে আছে বলে জানা যায়।
এমএসএফ মনে করে, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের নামে যে অপতৎপরতা চলছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং নাগরিক জীবনে চরম উৎকন্ঠা ও আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে।
আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মৃত্যু, নির্যাতন, অপতৎপরতার অভিযোগ
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ মাসে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে পালানোর চেষ্টায় পানিতে ঝাপ দিয়ে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া পুলিশের কিছু সদস্যের অনৈতিক কাজের পাশাপাশি তাঁদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, ক্রসফায়ারের হুমকি, অশোভন আচরণ, নির্যাতন ও ছিনতাইসহ বেশ কয়েকটি অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
৩ ফেব্রুয়ারী ভোররাতে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের গোয়েন্দা সদস্যরা বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার শহীদ নগর এলাকায় চুরির মামলার আসামিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর সময় মো. নাসির উদ্দিন (৫৫) এর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। পুলিশের দাবি, পুলিশ দরজা ভাঙতে গেলে মো. নাসির উদ্দিন জানালা দিয়ে পালিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দেন। পরে পাশের পুকুর থেকে নাসিরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে মো. সোলায়মান নামের এক যুবককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন স্ত্রী নাছিমা। নাছিমা জানান, পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) উজ্জ্বল সরকার কিছুদিন আগে মো. সোলায়মানকে তার সোর্স হওয়ার প্রস্তাব দেয়। তিনি এ প্রস্তাব মেনে নেননি। এজন্য তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে।
৮ ফেব্রুয়ারী, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য আইনজীবী আমিনুল গণী টিটোকে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক নাজমুলের বিরুদ্ধে। কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক নাজমুলের দাবি, আইনজীবী আমিনুল গণী টিটোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। তিনি কাউকে হুমকি দেননি। তবে মোকাররম নামের ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে মারধর করার অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় এক কলেজছাত্রীকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ধর্ষণ করিন সিলেট পুলিশ লাইনসে কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত শিবলু মিয়া। একাধিকবার ধর্ষণের অভিযোগে ভূক্তভোগী ছাত্রীটি চুনারুঘাট থানায় মামলা করলে উক্ত পুলিশ সদস্যকে সিলেট থেকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারী সিলেটের একটি আবাসিক হোটেলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার ডাকাতি মামলার আসামির সঙ্গে নামের মিল থাকায় এক কৃষক বিনা অপরাধে তিন সপ্তাহ ধরে জেল খাটছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় পুলিশের গাফিলতিকে দায়ী করেছেন পরিবার ও এলাকাবাসী। স্থানীয় এবং জনপ্রতিনিধিরা জানান, পুলিশের কাছে বারবার প্রমাণ দিলেও পুলিশ বিষয়টির তোয়াক্কা করেনি।
১৮ ফেব্রুয়ারী রাতে পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইকারী চক্র সায়েদাবাদ থেকে একটি অটোরিকশা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। হতদরিদ্র চালক মোহাম্মদ আলী গেন্ডারিয়া থানায় মামলা করেন। মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে তিনজনকে গ্রেফতার করেন। তাদের একজন হলেন ওমর ফারুক (৩৯), যিনি লালবাগ থানার পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক ও অপর দুজন হলেন শাইহান (২৮) ও কবির হোসেন (৩৮)। গেন্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, পুলিশের এএসআই ওমর ফারুকই সেদিন দিনাজপুরের দরিদ্র মোহাম্মদ আলীর অটোরিকশাটি ছিনিয়ে নেন। পরে সেটি বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
৮ ফেব্রুয়ারী কক্সবাজারের রামুতে নিজেদের স্বত্ব দখলীয় বসতভিটার বাগানে পূর্বনির্ধারিত পারিবারিক পিকনিকের আয়োজন চলছিল। এমন সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে রামু থানা পুলিশ সদস্যরা সেখানে গিয়ে তাদের পিকনিক পণ্ড করে নারীদের হেনস্তা করে চার নারীকে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায়। এরপর ওসি (তদন্ত) অরূপ কুমার চৌধুরীর নির্দেশে সিসি ক্যামরাবিহীন একটি রুমে নিয়ে গিয়ে দুজন পুরুষ পুলিশ তাদের লাঠি দিয়ে শরীরের লজ্জা স্থানে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে। পুলিশের দাবি আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কিছু মানুষ সেখানে জায়গা দখলের উদ্দেশে অবস্থান করছিল।
নির্বাচনী পরিস্থিতি
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ মাসে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত কম। নির্বাচন কমিশনের সূত্রমতে ভোটার উপস্থিতি ছিল ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। তেমন সহিংসতার ঘটনা না ঘটলেও ভোট কারচুপি, আওয়ামী লীগ- বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, আওয়ামী লীগ ও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও বিভিন্ন ধরণের অনিয়ম ও আচরণবিধির লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবু আসিফের নির্বাচনের বেশ কয়েক দিন আগে থেকে নির্বাচন পর্যন্ত নিখোঁজ অবস্থায় থাকা এবং বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে আশরাফুল হোসেন আলম ‘হিরো আলম’ নামে পরিচিত এর অল্প সংখ্যক ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়া, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-উত্তর সময়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেভাবে সরকারি দলের সার্বিক প্রচেষ্টা এবং তত্ত্বাবধানে ভোট হয়েছে, সে ধরনের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফের নিখোঁজ থাকার ঘটনাটি দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এই প্রথম প্রত্যক্ষ করা গেছে যা আগামী নির্বাচনগুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সহিংসতা
রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকার দলীয় ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহিংসতা, হানাহানি হতাহতের ঘটনাসহ নাগরিক জীবনে উৎকন্ঠা বেড়েছে। ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
১১ ফেব্রুয়ারী ইউনিয়ন পর্যায়ে ৪০ টি ইউনিয়নে ও ১৭ ফেব্রুয়ারী ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণে দুটি পদযাত্রা, ১৮ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ ১১টি মহানগরে ও ২৫ ফেব্রুয়ারী ৬৬টি সাংগঠনিক জেলায় বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচি চলাকালে বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও তাঁর সহযোগী সংগঠনের সাথে যুবলীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, মারামারি, লাঠিপেটা ও সমাবেশ চলাকালে এবং সমাবেশের আগে ও পরে সমাবেশকে সফল না করতে দেওয়া, বাধাগ্রস্ত করা ও বিএনপি কর্মীদের ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটেছে ।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ মাসে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতার ৫১ টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৬৯১ জন। জানুয়ারি মাসে এর সংখ্যা ছিল ৩৭টি, হতাহতের সংখ্যার মধ্যে ৩ জন নিহত, ২ জন নিখোঁজ ও ২২০ জন আহত হন । ফেব্রুয়ারী মাসে গণমাধ্যমে সূত্র অনুযায়ী নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সহিংসতায় মোট ৬৯০ জন আহত ও আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে ১ জন কিশোর নিহত হয়েছেন।
২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় সকালে দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের চরকাছিয়া গ্রামে মিয়ারহাট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জেরে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ছুরিকাঘাতে রাসেল হোসেন (১৪) নামের এক কিশোর নিহত হয়েছে।শান্তিপূণ সভা, মিছিল ও র্যালীতে হামলা
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ বিরোধী দল বিএনপি’র পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী বাস্তবায়নে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বল প্রয়োগ, বাধাদান, শান্তিপূর্ণ সভা, মিছিল ও র্যালীতে হামলার ৮টি ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলোতে ১২৩ জন আহত হয়েছেন।
রাজনৈতিক হয়রানি, গায়েবি মামলা ও গ্রেফতার
বিরোধী দলীয় কর্মকান্ডকে বাধাগ্রস্ত করার অন্যতম উপায় হিসেবে হয়রানিমূলক মামলা ছাড়াও গায়েবি মামলা দায়ের, গ্রেফতার ও বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভয়-ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর এহেন প্রয়াস নাগরিক জীবনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। এ মাসে ৪২টি রাজনৈতিক মামলার মধ্যে বিএনপি’র বিরুদ্ধে ৩৩টি, জামায়েত ইসলামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৮টি এবং গণঅধিকার পরিষদের বিরুদ্ধে ১টি মামলা করা হয়েছে। মোট ৫৯৪ জন রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জানুয়ারী মাসে রাজনৈতিক মামলার সংখ্যা ছিল ১৩টি, যার মধ্যে বিএনপি’র বিরুদ্ধে ৬টি ও জামায়েত ইসলামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৭টি। মোট ৪৯২ জন রাজনৈতিক কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। এ মাসে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলমান অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় ৫০৮ জন নেতাকর্মীকে অপরদিকে আদালতে জামিন প্রার্থনাকালে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে ৮৬ জন বিএনপির নেতাকর্মীকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৪৮০ জন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের, ১১২ জন জামায়েত ইসলামী এবং ২ জন গণঅধিকার পরিষদের কর্মী।
শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক সহিংসতা
শিক্ষাঙ্গনে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা সমর্থকদের দ্বারা ছাত্রছাত্রীদেরকে শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক ও যৌন নির্যাতনেরও অভিযোগ উঠেছে যা জনমনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এ ধরণের ঘটনা শিক্ষাঙ্গন ক্যাম্পাসে অহরহই ঘটে চলেছে অথচ এর কোন সুবিচার হচ্ছে না।
১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ মাসে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফুলপরী খাতুন নামে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রীকে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীরা চার ঘণ্টা ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, অশালীন ভাষায় গালাগালসহ নানাভাবে হয়রানি করেছে যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। ৮ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৪ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা, ১২ ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে কৃষ্ণ রায়কে হলকক্ষে আটকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও শিক্ষার্থীকে শিবির সমর্থক আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকি প্রদান, ১৬ ফেব্রুয়ারী ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীনিবাসে আসন দেওয়া নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো ও শিক্ষার্থীকে বঁটি দিয়েও মারতে উদ্যত হন ছাত্রলীগ নেতা নেত্রীরা। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনার সাথে ছাত্রলীগের জড়িত থাকার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধমূলক এসব কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার পরেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে এ ধরণের কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে।
অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার
এ মাসেও উদ্বেগ-আতঙ্কের বিষয় অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩ জন নারী ও ১২ জন পুরুষ, মোট ১৫ জনের অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে যা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত এবং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ। গত মাসে এর সংখ্যা ছিল ৩১জন, যার মধ্যে ৮জন নারী ও ২৩জন পুরুষ। এমএসএফ মনে করে, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। এসব ঘটনার জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। কাজেই সরকারকেই এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে কিন্তু আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে সম্পুর্ণ নির্বিকার।
এসব অজ্ঞাতনামা লাশ বেশীর ভাগ নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়কের পাশে, রেললাইনের পাশে, বিল বা ফসলী ক্ষেতে রশি দিয়ে হাত পা বাধা বা বস্তাবন্দি অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের বয়স ২৫ থেকে ৫০ বৎসরের মধ্যে।
এমএসএফ মনে করে, শুধুমাত্র অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা যত ক্ষমতাবানই হোক, সব অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
কারা হেফাজতে মৃত্যু
এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী ২০২৩ মাসে কারা হেফাজতে একজন ভারতীয় নাগরিকসহ মোট ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এর সংখ্যা ছিল ২০ জন। এ মাসে ৪ জন হাজতি ও ১ জন কয়েদির মৃত্যু হয়েছে।
এমএসএফ মনে করে, কারাগারের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি, হেফাজতে মৃত্যুর সঠিকভাবে তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।
সীমান্তে হত্যা ও পরিস্থিতি
সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ বিএসএফ কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্বেও সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ হয়নি। এ মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ২ জন বাংলাদেশী নিহত ও ১ জন আহত হয়েছেন। অপরদিকে বিএসএফ কর্তৃক ছোঁড়া সাউন্ড গ্রেনেডে আহত হয়েছেন একজন বাংলাদেশী কৃষক। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে দুই বাংলাদেশিকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে। সীমান্ত এলাকায় ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন ১ জন, ভারতীয় দুর্বৃত্তদের হাতে অপহরণ হয়েছেন বাংলাদেশি কৃষক, বান্দরবনে শূণ্যরেখায় স্থলমাইন বিস্ফোরণে পা বিচ্ছিন্ন হয়েছে এক বাংলাদেশীর। অপরদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তমব্রু সীমান্তের শূণ্যরেখায় ২৭ দিন বন্ধ থাকার পর আবারও মিয়ানমার থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। এতে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
৮ ফেব্রুয়ারী সকালে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার শ্যামকুড় সীমান্তে গরু আনতে যাওয়া আরিফুল ইসলামসহ ৫/৬ জনকে লক্ষ করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলেই আরিফুল নিহত হয়। মহেশপুর ৫৮ বিজিবির সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল পারভেজ জানান, ঘটনা শুনেছি। বিএসএফ এর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কিছু জানায়নি। সে বাংলাদেশি কিনা তদন্ত চলছে।
১৭ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে হিলি সীমান্তের ২৮৫ নম্বর মেইন পিলারের ২৫ নম্বর সাবপিলার-সংলগ্ন ফকিরপাড়া এলাকা দিয়ে সাহাবুল হোসেন বাবু নামের বাংলাদেশী নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় বিএসএফ সদস্যরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। পরে বিএসএফ সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে ভারতের হিলি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ঘটনার তিন দিন পর সাহাবুল হোসেন বাবুর লাশ ফেরত দিয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার/অপব্যবহার
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবলভাবে সমালোচিত হওয়া সত্বেও এ আইনে মামলার নামে হয়রানি কমেনি বরং এর যথেচ্ছ অপব্যবহারের বিষয়টি এ মাসে নতুন মাত্রায় ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫ টি মামলা হয়েছে এবং ১২ জন গ্রেফতার হয়েছেন। জানুয়ারি মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৭টি মামলায় ১৯ জন আসামির মধ্যে ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
এ সময়ে ২ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ১টি মামলা হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি সাংবাদিক আরিফুজ্জামান খান রিয়াদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক ভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন পিকু। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৫ জন বিএনপি, ১ জন জামায়াত, ৩ জন সাধারণ যুবক ও ৩ জন ব্যাংক কর্মকর্তা রয়েছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্ট/শেয়ার/মন্তব্য করার অভিযোগে ৩টি মামলা, মেয়েদের ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল এর জন্য ১ টি মামলা ও অপর ১টি মামলা হয়েছে জমিসংক্রান্ত বিরোধের অভিযোগে।
নাজিরপুর উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবু হাসান খানসহ ৫ জনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন খানএর করা মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। এছাড়া ৩ জন ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে মামলা, সুনামগঞ্জ-২ আসনের (দিরাই-শাল্লা) সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তাকে নিয়ে কটূক্তি করায় এস এম শামীম (৪৫) নামের জামায়াতের কর্মী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের আশকার পাইন ওরফে আশকারুল (৩৮) নামের ১ যুবক এবং নোয়াখালীর হাতিয়ায় জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে ১ জন ও ঢাকায় দারাজ অনলাইন শপের পণ্য ডেলিভারী দিতে গিয়ে কৌশলে গোপন মুহূর্তের ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগে ১ জন যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এমএসএফ মনে করে, বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনে মামলা না করে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করা হয়রানিমূলক ও অগ্রহণযোগ্য।
সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশে হামলা
দৈনিক দিনকালের ঘোষণা বাতিল করেছে সরকার যা স্বচ্ছ গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ। এমএসএফ মনে করে, একটি সংবাদপত্র বন্ধ করা গণতান্ত্রিক নীতির লঙ্ঘন। এ ছাড়া এ মাসে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানবাধিকার লংঘনের চিত্র ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী মাসে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় অন্তত ২৫ জন সাংবাদিক নানাভাবে অপমান, নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১০ জন সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত- আক্রমনের শিকার হন ৪ জন, ৪ জন হয়রানির শিকার,হত্যার হুমকির সম্মুখীন শিকার হন ৪জন এবং ৩ জন এর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। এছাড়াও রংপুরে আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা ও হুমকি প্রদান করেন পিপি রফিক হাসনাইন। এ সকল ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও পুলিশ এর সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা ও স্বাধীনভাবে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করছে যা শুধুমাত্র অনাকাঙ্খিতই নয় বরং এভাবে বাধার সৃষ্টি করে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে সংকুচিত করা হচ্ছে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী ২০২৩ মাসে দেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা যেমন: ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতই অব্যাহত রয়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী মাসে ৩১৭টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৪৩টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৩টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৩টি। এর মধ্যে ৩ জন প্রতিবন্ধি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী গত মাসে ২৭৫টি নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে ধর্ষণের শিকার ৪৩ জনের মধ্যে ৬ জন শিশু, ১৬ জন কিশোরী রয়েছে, অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন কিশোরী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ১ জন শিশু ও ২ জন নারী। ধর্ষণের চেষ্টা ২৪টি, যৌন হয়রানি২৩টি ও শারীরিক নির্যাতনের ৪৯টি ঘটনা ঘটেছে। এসময়ে একজন শিশু, ৩০ জন কিশোরী ও ৪২জন নারীসহ মোট ৭৩ জন আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে দুই জন প্রতিবন্ধি নারী রয়েছে।
অ্যাসিড নিক্ষেপে আক্রান্ত হয়েছেন ১ জন নারী। এ মাসে ১জন শিশু, ৩জন কিশোরী ও ২জন নারী অপহরণের শিকার হয়েছেন। অপরদিকে ৩জন শিশু, ১জন কিশোরী ও ১জন নারী নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়াও ফেব্রুয়ারী মাসে ৪ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ৬৩ জন শিশু, কিশোরী ও নারী হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ২৩ জন শিশু ও কিশোরী রয়েছেন। গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিশোধ, পারিবারিক বিরোধ, যৌতুক, প্রেমঘটিত ইত্যাদি কারণে এ হত্যাকান্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে। এ মাসে শারীরিক নির্যাতন ও পারিবারিক কলহের বিষয়ে ২টি ঘটনা সালিশে মীমাংসা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারী মাসে ১০জন মৃত ও ২জন জীবিত মোট ১২জন নবজাতক শিশুকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে যা অমানবিক ও নিন্দনীয়। এ সমস্ত শিশুদেরকে কি কারণে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা নিরূপনের চেষ্টা করছে না।
এমএসএফ মনে করে, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতারোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভুমিকা লক্ষ্যণীয় নয়।
সংখ্যালঘু নির্যাতন
গণমাধ্যমসূত্রে পাওয়া ও এমএসএফ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মাসে বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ৬ টি ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ৫ টি ঘটনা জাতিগত ও ১ টি ঘটনা ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় এক রাতে হিন্দু ধর্মাম্বলীদের উপাসনালয় ১২টি মন্দিরের ১৪টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
বান্দরবানের লামা উপজেলায় এক মারমা নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে কায়সার (৩৫) নামের এক বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, মামলার জন্য ভিকটিমের পরিবারকে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের রাঙ্গেমারী এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখল, হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। হামলায় ৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে কাটাবাড়ী ইউনিয়নের বেতারা গুচ্ছগ্রামের সাঁওতাল পরিবারের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় ও গুচ্ছ গ্রামের ঘরগুলোর সংস্কারের অভাবে, কোনো কোনো ঘরের চালের টিনে মরিচা ধরে ছিদ্র হয়ে গেছে, কোনোটির ভিটের মাটি ধসে যাচ্ছে। ফলে অনেকেই ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। গুচ্ছগ্রাম কমিটির সভাপতি যিশায়েল হেমরম জানান, তাদের পুনর্বাসনসহ আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে জীবিকার তাগিদে কেউ পূর্বস্থানে, আবার কেউ ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করছেন। বর্তমানে ২৫টি পরিবার রয়েছে। এখানে সরকারিভাবে তেমন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁরা অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের নলুয়া গ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনন্ত কোচ আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পরও পৈতৃক সম্পত্তির দখল নিতে পারছেন না। দীর্ঘদিন আদালতে মামলা চলার পর অবৈধভাবে দখলকৃতদের দখল ছেড়ে দিতে আইনগত নোটিশ দিলেও জোরপূর্বক ভুয়া দলিলের মাধ্যমে দখলে আছে তিন দখলদার।
এছাড়া রাজধানীর ধলপুরের তেলুগু সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পক্ষ থেকে তেলুগুভাষী সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করতে যাওয়ার ঘটনায় নারীসহ ২ জন আহত, যাত্রাবাড়ী থানায় ডেকে নিয়ে কলোনি ছাড়ার হুমকি এই সকল ঘটনায় তেলুগু সম্প্রদায়ের প্রায় ১২০০ থেকে ১৩০০ বাসিন্দা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এছাড়া এই কলোনিতে একটি প্রাচীন মন্দির, একটি গির্জা ও একটি স্কুল রয়েছে।
গণপিটুনি
গণমাধ্যমসূত্রে পাওয়া এমএসএফ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ মাসের উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা। প্রচলিত আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনির ঘটনাগুলোকে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড হিসেবেই গণ্য করা যায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মাসে অন্তত ১২টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৭জন নিহত, ১০জন গুরুতরভাবে আহত ও ৪জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। সন্দেহজনক চুরি বা ডাকাতির কারণে গণপিটুনির ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে। এমএসএফ মনে করে, আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা অবশ্যই ফৌজদারী অপরাধ। গণপিটুনির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।
১ ফেব্রুয়ারী, ফরিদপুর পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের মোড়ালিদাহ নামক এলাকায় চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে আবুল কালাম (৩৮) নামক এক যুবকের মৃত্যু হয়। ২ ফেব্রুয়ারী, রাজশাহীর সপুরা এলাকায় মডার্ন ফুডের মালিকের বাড়িতে দুই শ্রমিক কাজে এসেছিলেন। উক্ত বাড়িতে থেকে ১০ লাখ টাকা চুরির অভিযোগে রেজাউল করিম (৪৫) ও রাকিবুল ইসলাম (৩৫) কে বেঁধে পিটাতে থাকে। দফায় দফায় নির্যাতনের ফলে গুরুতর আহতবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ হাসপাতালে নিলে জরুরি বিভাগেই একজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। অন্যজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৪ ফেব্রুয়ারী, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ভাটেরা ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামে ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশা চুরির চেষ্টায় জড়িত সন্দেহে অজ্ঞাত এক যুবক (৩৫) কে স্থানীয়রা আটক করে মারধর করে। গুরুতর আহত যুবকটি ৫ ফেব্রুয়ারী রাতে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১২ ফেব্রুয়ারী ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের খামিনারবাগ গ্রামে অটো ছিনতাইয়ের অভিযোগে এক যুবক গণপিটুনিতে নিহত হন। ২০ ফেব্রুয়ারী পটুয়াখালীর গলাচিপায় উপজেলার পানপট্টি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তুলারাম গ্রামের নজরুল গাজীর বাড়িতে চুরির অভিযোগে লিটন নামের এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
২৪ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনার ঘোষঘাটা এলাকায় একজন চোরকে আটক করে গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে আটককৃত ব্যক্তিকে সড়কের পাশের একটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বেঁধে গণপিটুনি দেয় এবং ফলে তার মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, দি ডেইলি ষ্টার, নিউএইজ, কালের কন্ঠ, যুগান্তর, সংবাদ, জনকন্ঠ, আমাদের সময়, বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক মানবজমিন, সমকাল, ইত্তেফাক, আজকের পত্রিকা, ঢাকা ট্রিবিউন, বিডি নিউজ ২৪, বাংলাদেশ জার্নাল, যায়যায় দিন, জাগো নিউজ ও অন্যান্য জাতীয় দৈনিকসমূহ প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে উপরোক্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়াও প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই স্থানীয় হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারদের মাধ্যমে ভেরিফাই করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার ভিত্তিতে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।
– প্রেস রিলিজ