ভারতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ। তীব্র অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টায় সনাক্ত হয়েছে সাড়ে তিন লাখ করোনা রোগী। ঠিক এই সময়ে বাংলাদেশে ঈদের কেনাকাটা করার জন্য সরকার লকডাউন শিথিল করে দোকান পাট ও শপিং মল খুলে দিয়েছে। এসব দেখে আতংকিত হয়ে লণ্ডন থেকে একবন্ধু কল দিয়েছে তার ঢাকাবাসী বন্ধুকে।
: হ্যালো দোস্ত!
: হ্যাঁ বল
: কেমন আছিস?
: এইতো আছি।
: কী করছিস? ভারতের অবস্থা দেখে তোকে কল দিলাম। খুব চিন্তা হচ্ছে।
: হ্যাঁ ভাল আছি। বসুন্ধরা মার্কেটে যাচ্ছি ঈদের কেনাকাটা করতে। আরে শোন আমাদেরকে নিয়ে ওত ভাবিস না। আমাদের অবস্থা ভারতের মত না। সরকার তো মার্কেট-টার্কেট সব খুলে দিয়েছে।যা করেছে নিশ্চয় চিন্তা ভাবনা করেই করেছে।
: নারে দোস্ত! এটা বলিস না। সরকার খুলে দিয়েছে কারণ সরকারের নানা হিসাব নিকাশ আছে। অর্থনীতি, রাজনীতি নানা ঘটনা আছে। কিন্তু ভারত থেকে তো আমরা বেশী দূরে না। তোকে পর্তুগালের কথা বলেছিলাম না? ব্রিটেন পর্তুগালের ভয়াবহ অবস্থা দেখেও লকডাউন দেয়নি শুরুতে। যে কারণে ব্যাপকহারে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। আমার তো মনে হচ্ছে বাংলাদেশেও ভারতের অবস্থা সৃষ্টি হবে!
: আচ্ছা আমরাতো এখানে সবাই মাস্ক পরি তারপরও করোনা কিভাবে আমাকে আক্রমণ করবে? আমরা তো নিরাপদ, তাইনা?
: না রে দোস্ত, তোরা নিরাপদ না। কারণ করোনা শুধুমাত্র হাচি-কাশিতে ছড়ায় না। হাচি-কাশি ছাড়াও করোনা আরো অনেক ভাবে ছড়ায়
: কী সেটা? একটু বলতো শুনি! আমাদের এইখা তো এসব নিয়ে তেমন আলোচনাও হয়না।
: শোন তাহলে। আমি এক এক করে বলছি তোকে করোনা কিভাবে ছড়ায়—
১. করোনা ছড়ায় আক্রান্ত রোগীর হাতের স্পর্শে
২. করোনা আক্রান্ত রোগীর জামা-কাপড় থেকে
৩. করোনা আক্রান্ত রোগীর শরীরের যে কোন অঙ্গের ছোঁয়ায়
৪. করোনা আক্রান্ত রোগী কোথাও বসলে সে স্থান অ্যাণ্টিব্যাকটেরিয়াল দিয়ে ভাল করে জীবানুমুক্ত না করে বসলে
৫. করোনা আক্রান্ত রোগী কোনও টাকা স্পর্শ করলে সে টাকা অ্যাণ্টিব্যাকটেরিয়াল দিয়ে ভাল করে জীবানুমুক্ত না করে স্পর্শে করলে
৬. করোনা আক্রান্ত রোগী কর্তৃক ব্যবহৃত গ্লাস, প্লেট, চামচ বা অন্য কিছু জীবানুনাশক দিয়ে না ধুয়ে ব্যবহার করলে
: বলিস কিরে! এতো দেখছি মহা সমস্যা। এতোটাই ছোঁয়াছে নাকি করোনা?
:হ্যাঁ দোস্ত! এটা এক অদৃশ্য শত্রু! এই রোগ কল্পনাতীতভাবে ছোঁয়াছে। ছোঁয়াছে বলেই আমেরিকা, জার্মানী, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালীর উন্নত দেশগুলো রক্ষা পেতে করোনার বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে? এসব দেশ কী ব্যবস্থা নিয়ে শুনবি?
: কী ব্যবস্থা নিয়েছে? বলতো শুনি।
: আচ্ছা বলছি। শোন তাহলে—
– তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের সীমান্তে সীলগালা মেরে দিয়েছে
– তারা বিশেষ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া নাগরিকদের ঘর থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে
– মানুষ বাজারে যাওয়ার পরিবর্তে অনলাইনে শপিং করে হোম ডেলিভারী অর্ডার করা শুরু করেছে
– যাদের অনলাইনে অর্ডার করার সুযোগ ছিলনা তারা সবরকমের সুরক্ষা নিশ্চিত করে নূন্যতম দুই মিটার দূরত্ব মেনে বাজার করেছে
– বিশেষভাবে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব রকমের দোকানপাট, অফিস, কলকারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে
– গণপরিবহনে ভ্রমনে কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছে
: বলিস কী! এ তো দেখছি রীতিমত যুদ্ধকালীন অবস্থা।
: হ্যাঁ দোস্ত! ঠিকই বলেছিস! এটা শুধু যুদ্ধ না, এক মহাযুদ্ধ। এই যুদ্ধে শত্রুকে দেখা যায়না। শত্রু অদৃশ্য, অশরীরি। কিন্তু ভয়ংকর শক্তিশালী। একেবারে মরণঘাতী। তোকে বলি, শুধু ব্রিটেন নয় সব বড় বড় দেশে যেখানে দুনিয়ার সেরা সেরা ডাক্তাররা কাজ করেন, যাদের হাসপাতাল ও স্বাস্হ্য সেবা অনেক উন্নত তারা করোনার বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাহলে এবার নিজেকে প্রশ্ন কর- বাংলাদেশের মত নাজুক অবকাঠামো যেখানে সেখানে বসবাস করে নিজেকে নিরাপদ মনে করা কতটা যৌক্তিক!
: হ্যাঁ, তোর কথা শুনে তো ভয়ই লাগছে রে! আশ্চর্য মাস্ক পরেও আমরা নিরাপদ নয়!
: না, মোটেই নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় নিজের জন্য এবং পরিবারের জন্য। এমনকি নিরাপদ নয় সহকর্মী বা আশেপাশের অন্য যে কোন মানুষের জন্য।
: তাহলে আমাদেরকে কী করতে হবে বলতো দোস্ত?
: আচ্ছা, কী করতে হবে তা জানতে চাচ্ছিস? উত্তর খুব সহজ। পরিস্কার কথা হলো করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। যুদ্ধ ঘোষণা করে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। এতে কোনরুপ আপোষ করা চলবে না।
: আচ্ছা এই যে স্বাস্হ্যবিধির কথা বলছিস, স্বাস্থ্যবিধিগুলো কী? তোরা কিভাবে চলতি?
: খুব ভাল প্রশ্ন করেছিস। আমি তাহলে এক এক করে তোকে বলি। তুই মনযোগ দিয়ে শোন। এটা দোস্ত হেলাফেলার বিষয় না। মানুষের জীবন নিয়ে কথা। যেসব স্বাস্থ্যবিধি আমরা লণ্ডনে মেনে চলেছি সেগুলো হলো—
১. ঘরের বাহিরে অবশ্যই অবশ্যই এবং অবশ্যই ভালভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে হবে। মনে রাখতে হবে মাস্ক নাক-মুখ ঢাকার জন্য, থুতনীর নীচে বা কপালে রাখার জন্য নয়।
২. যেহেতু কভিড অত্যন্ত ছোঁয়াছে একটি রোগ সেহেতু সুরক্ষা পেতে হলে বাসার বাহিরে সর্ব অবস্থায় যতটা সম্ভব একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এই দূরত্ব কমপক্ষে দুই মিটার হওয়া বান্ছনীয়।
৩. বাহিরে যে কোন কিছু স্পর্শ করার পর স্যানিটাইজার দিয়ে ভালভাবে হাত স্যানিটাইজ করতে হবে। কারণ আমরা জানি না আমার আগে এখানে যার স্পর্শ লেগেছে তিনি করোনা ভাইরাস বহন করছেন কি না।
৪. বাহির থেকে ঘরে আসার পর জামাকাপড় ধুয়ে পরিস্কার করতে হবে এবং গোসল করে নিজে পরিস্কার হতে হবে
৫. বাজার থেকে কেনা জিনিসপত্র বাসায় এনে যতটা সম্ভব স্যানিটাইজিং ওয়াপস দিয়ে পরিস্কার করতে হবে। কারণ তুই যে জিনিসটি কিনেছেন সেটি তোর আগে এমন কেউ স্পর্শ করে থাকতে পারে যে করোনা ভাইরাস বহন করছে।
৬. শপিং ট্রলি ভাল করে অ্যাণ্টিব্যাকটেরিয়াল দিয়ে মুছে নিতে হবে।
৭. সবসময় পকেটে হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। মাস্কের মত এটাও বাধ্যতামূলক মনে করতে হবে। যে কোন কিছু ধরার আগে ও পরে ভালভাবে হাত স্যানিটাইজ করে নিতে হবে।
৮. যে কোন মূল্যে জনসমাগম বর্জন করতে হবে যদিনা সেখানে একে অপরের মধ্যে নূন্যতম দুই মিটার দূরত্ব নিশ্চিত করা যায়।
৯. পারিবারিক ও বন্ধু-বান্ধবের আড্ডা সাময়িকভাবে সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। কারণ পারিবারিক পরিসরে দুই মিটার দূরত্ব রক্ষা করা সম্ভব হয়না।
১০. সম্ভব হলে নগদ টাকা লেনদেন এড়িয়ে চলতে হবে কারণ টাকার মাধ্যমে করোনা ছড়ায়। আর সম্ভব না হলে গ্লাভস ব্যবহার করে টাকা ধরতে হবে। টাকা পকেটে না রেখে আলাদা ব্যাগে বহন করতে হবে।
: বলিস কী! এতো দেখছি একেবারে অসম্ভব জীবন পদ্ধতি! এত সতর্কতা কিভাবে মানা সম্ভব।তোরা কিভাবে মেনেছিস এত কিছু?
: শোন এটা অসম্ভব নয়। খুবই কঠিন কিন্তু অপরিহার্য। বাস্তবতা হলো হ্যাঁ জীবন বাঁচাতে হলে এই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে। এখানে কোন দাড়ি কমা নাই। করোনা তোমার সীমাবদ্ধতা, সুবিধা- অসুবিধার তোয়াক্কা করেনা!
: হ্যাঁ বুঝলাম। কিন্তু এই যে আমাদের সরকার লকডাউন শিথিল করেছে, তাহলেও কি এসব মেনে চলতে হবে দোস্ত? তারা তো নিশ্চয় জানে পরিস্হিত কতটা ভয়াবহ, কী করতে হবে?
: এর উত্তর খুব সহজ দোস্ত। হ্যাঁ মেনে চলতে হবে। কারণ সরকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে বাধ্য হয়। সুতরাং তোমাদের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমাদেরকেই নিতে হবে। এখানে একবিন্দু আপোষ করেছো তো মরেছো। সরকার তোমাদের জীবনের নিরাপত্তা দিবে না। উন্নত দেশগুলোও দিতে পারেনি। আর বাংলাদেশ তো কোন ছার। মানো আর না মানো এটাই নির্মম সত্য, এটাই বাস্তবতা।
: আচ্ছা দোস্ত আমিতো অনেক দোয়া কালাম পড়ে, বড় খতমের দোয়া পড়ে ঘর থেকে বের হই। তাহলেও কি আমি আক্রান্ত হবো?
উত্তর: শোন, বোকার মত কথা বলিস না। করোনা কোন ধর্ম, বর্ণ, বয়স, জাতি মানেনা। দোয়া দরুদ সুরক্ষা করে এরকম কোন বৈজ্ঞানিক প্রমান আছে? সুতরাং দোয়া দরুদের পাশাপাশি সবরকমের স্বাস্হ্য বিধি মেনে চলতে হবে।
: আচ্ছা আরেকটা কথা, আমিতো ভ্যাকসিন দিয়েছি, তাহলেও কি আমি অনিরাপদ মনে করছিস তুই?
: হ্যাঁ তুই এখনো অনিরাপদ। কারণ হলো প্রথমত ভ্যাকসিন কাজ করে একুশ দিন পর থেকে। দ্বিতীয়ত কোন ভ্যাকসিনই একশ’ ভাগ নিরাপত্তা দেয় এটা দাবী করা হয়নি। ভ্যাকসিন করোনা রোগ যাতে মারাত্মক না হতে পারে সেটা থেকে মানুষকে রক্ষা করে। কিন্তু সমস্যা কী জানিস? সমস্যা হলো যেহেতু ভাইরাসটা তার রুপ বদল করছে প্রতিনিয়ত, সে কারণে যে ভ্যাকসিনটা দেয়া হয়েছে সেটা নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে আদৌ কার্যকর কিনা সে ব্যাপারে তো কোন নিশ্চয়তা নেই।
: এতো দেখছি আরো ভয়ের কথা রে! আমি তাহলে আজ আর মার্কেটে না যাই। এখন দোস্ত কী করতে হবে এটা একটু খুলে বলতো শুনি?
: শোন, সরকারের ওপর নির্ভর না করে নিজেকে নিজের এবং নিজের পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা মোকাবিলায় একেবারে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এটাই সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা।এবং উন্নত দেশগুলো তাই করেছে এবং এখনো করছে। মনে রাখবি করোনা মোকাবিলায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্য বিধি মানা ছাড়া আর কোন শর্টকাট নাই। এখন জীবন তোমার, পছন্দও তোমার! সিদ্ধান্ত নাও, মানবা না নিজেকে মৃত্যুর মুখে সঁপে দেবা! আমি রাখি আজ।
: অনেক ধন্যবাদ দোস্ত। তোর কাছ থেকে অনেক কিছু জানলাম। তুই রীতিমত চোখ-কান খুলে দিয়েছিস। আমি আর মার্কেট যাচ্ছিনা।
: না,যাস না। কারণ তুই তো জানবি না ঈদের পোশাকের সঙ্গে শপিং ব্যাগে করে বাসায় করোনা চলে আসছে কিনা! আর মার্কেট ভিড় দেখেছিস? মানুষের গায়ে মানুষ লেগে আছে। করোনা তোমার ঈদ, ধর্মীয় অনুভূতি এসবের ধার ধারেনা।
: হ্যাঁ দোস্ত সেটা দেখেছি। মানুষ তো মনে করছে সরকার যেহেতু খুলে দিয়েছে তাহলে সব তথ্য প্রমান যাচাই বাছাই করে নিরাপদ মনে করেই খুলে দিয়েছে।
: মানুষের ধারণা মোটেই ঠিক না। ইণ্ডিয়ার দিকে তাকা। রীতিমত মহা-মানবিক বিপর্যয়। অক্সিজেন নেয়া হচ্ছে পুলিশ পাহারা দিয়ে। আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়া হয়েছে।সে তুলনায় আমরা কী বলতো! কে আছে আমাদের! মুখে হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা বললে করোনা শুনবে? মেরে সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে যাবে না! সতর্ক নাহলে দেখবি আল্লাহ না করুক কলোরা মহামারির মত রাস্তায় রাস্তায় মানুষ মরে পড়ে আছে। লাশ দাফন করার লোক নেই। একবার ভাব তো আমরা কোথায় পাবো এতো অক্সিজেন? কোথায় পাবো আইসিইউ? কয়জনেরই বা সামর্থ আছে এসব খরচ বহন করার? মুখে মুখে বাহাদুরী ঝাড়লে করোনা শুনবে?
: তুই একদম ঠিকই বলেছিল দোস্ত।অনেক ধন্যবাদ তোকে। আমি পরিবারের সবার সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে এখনই কথা বলছি। ভাল থাকিস।
: তোরাও ভাল থাকিস। নিরাপদে থাকিস। মনে রাখিস আমরা প্রবাসে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে দেশে, দেশের আত্মীয়-স্বজনের জন্য খুব চিন্তা হয়!
: বুঝতে পারি দোস্ত। আবারো কৃতজ্ঞতা তোকে। ভাল থাকিস!
– সারওয়ার ই আলম