উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী ছিলাম আমি তখন।ছাত্র রাজনীতির স্বাদ পেয়েছি মাত্র। যত প্রতিবাদ যত মিছিল কোন কিছু বাদ দেইনি। ছাত্র ইউনিয়নের দশম প্রাদেশিক সম্মেলনের জন্য আমরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছি চাঁদা তুলতে। আমরা কজন গিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিবাসে। মুনির চৌধুরী স্যারের ফ্ল্যটে নক করতেই স্যার স্বয়ং এসে দরজা খুললেন। হাসিমুখে বললেন “কি ব্যাপার তোমরা? ভিতরে এসো। ” যেন তিনি আমাদের কত চেনেন। আমরা তাকে আমাদের আসার উদ্দেশ্য জানাতেই তিনি নির্দ্বিধায় আমাদের বেশ বড় অংকের একটা চেক লিখে দিয়েছিলেন। আমরা সবাই খুব উৎফুল্ল হয়েছিলাম। আমাদের জন্য ভিতর থেকে ঠান্ডা লেবুর সরবত এসেছিল। আমাদেরকে দেখতে লাগছিল ছন্নছাড়ার মত ধূলিধূসরিত চেহাড়া। স্যারের ছিমছাম বসবার ঘরটিতে। আমি অভিভূত হয়েছিলাম আমি সবে রক্তাক্ত প্রান্তর পড়ে শেষ করেছি তাই না বলে থাকতে পারলাম না । বলেই ফেললাম যে রক্তাক্ত প্রান্তরের শেষটা খুব কষ্টের। তিনি মিষ্টি করে হাসলেন। তাকে এত কাছে থেকে দেখাটা একটা বিরাট ব্যপার ছিল আমার কাছে। ছাত্র ইউনিয়ন বরাবরই অনেক সেমিনার করেছে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে ও বিপ্লবীদের নিয়ে।
মুনীর চৌধুরী স্যার সেখানে বক্তা হিসেবে এসেছেন।
আমার স্পষ্ট মনে আছে তাঁর বলার ভঙ্গী, কন্ঠ স্বরের ওঠা নামা। মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ও কমুনিস্ট পার্টির পৃষ্টপোষক ছিলেন।
তারপর তাঁর সাথে আমার আবার দেখা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ইন্টারভিউর সময়। ডক্টর আহমেদ শরীফ, মুনীর চৌধুরী এবং ডক্টর আব্দুল হাই স্যার ছিলেন। আমাদের ইনটারভিউ নিতে। (হাই স্যার আমাদের সেশনের শুরুতেই আত্মহত্যা করেন)। এতসব জ্ঞানী গুনীজনদের সামনে বসে আমার বুক দুরুদুরু করছিল। সবাই মিলেই প্রশ্ন করেছিলেন। আমি ভীরু কন্ঠে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছি। মুনীর স্যার প্রশ্ন করেছিলেন আমার সব চাইতে প্রিয় লেখক কে? সংগে সংগে উত্তর দিলাম রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথের কি তোমার সবচেয়ে ভাল লাগে। সে উত্তরটাও সহজেই দিলাম। তিনি আমাকে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বললেন। আমি নার্ভাস কন্ঠে বললাম, “গান জানি তবে গাইতে পারি না”।
ইনটারভিউর শেষে বেরিয়েই তালেব ভাইয়ের সাথে দেখা। এতক্ষণ কি বললেন আপা! স্যারেরা অনেক প্রশ্ন করছে আপনাকে। মুনীর স্যারের বাগ্মীতা, বৈদগ্ধ ও অসাধারন স্টাইল আমাদের মুগ্ধ করেছে ধরে রেখেছে ক্লাস রুমে।
প্রতি ক্লাসে তাঁর কথা শুনেছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। তাকে সবসময় পাব দরকার হলেই তাঁর অফিসের দরজায় গিয়ে বলতে পারব, “স্যার আসতে পারি”? তিনি চশমার ভিতর থেকে চোখ তুলে বলবেন, “আরে এসো এসো”
এমন একটি মানুষকে কেন প্রান দিতে হল ঘাতকের অস্ত্র? আমাদের এত মূল্য দিতে হয়েছে স্বাধীনতার জন্যে।
দেশ স্বাধীন হবার আনন্দ ও ইউফোরিয়াটুকু উবে গেল আমার মন থেকে। ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস শোকের মাস। আমরা কোনদিনই আপনাকে ভুলতে পারব না স্যার।
– নীনা হাসেল, কবি অধিকার কর্মী কানাডা প্রবাসী