একাত্তর অথবা বিশ বিষের দিনগুলি
একাত্তরে এই জনপদে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রাক্ষস নেমে এসেছিলো। নয়মাস ধরে এ নরভোজিরা মানুষ খেতে থাকে। ভিনদেশি রাক্ষসেরা পথ-ঘাট কিছুই চিনতো না এই জনপদের। পাকিস্তানি মিছওয়াকে দাঁত মাজতে মাজতে রাজাকাররা মিছওয়াকের আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিতো মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের আত্মীয়ের বাড়ি। ক’জন মানুষই আর পালিয়ে ভারতে যেতে পেরেছিলো; আতংকে আর বিভীষিকার নয়মাসের দিনরাত্রি পার করেছিলো মুক্তিকামী মানুষ।
পাকিস্তানি মিলিটারি আর দেশজ রাজাকারের আতংকে জীবন-জীবিকা সব থেমে গিয়েছিলো। নেহাত কচু কিংবা বুনো শাক খেয়ে বেঁচে ছিলো দারিদ্র্যে বিলীন রাক্ষস আক্রান্ত মানুষেরা।
পাকিস্তান জান্তা বাংলাদেশের সম্পদ লুন্ঠন করে রাওয়ালপিন্ডিতে আতশবাজি করতো; পাকিস্তান জান্তার সহমত ভাইয়েরা গরীবের হক মেরে রুলিং এলিট হয়েছিলো।
এই যে শোষণ-বৈষম্য; তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ প্রতিবাদ করলে; পাকিস্তান জান্তার সহমত ভাইয়েরা রেগে রেগে বলতো, এইসব অশিক্ষিত বাঙ্গালিকে ঘুরাইয়া চটকানা দেওয়া দরকার। এদের সঙ্গে কথা বললে, টুথপেস্ট দিয়া দাঁত মাজতে হয়।
পাকিস্তান জান্তার সহমত ভাইয়েরা দলবেধে বেরিয়ে পড়তো টুথপেস্ট আর টুথ ব্রাশ কিনতে। বাংলাদেশে পাকিস্তান জান্তার সহমত ভাইয়েরা সরকারি দায়িত্ব পালন করতো মন দিয়ে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেরা কখনো বাপের হোটেলে; কখনো মামার হোটেলে খেয়ে চকির তলায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। যুদ্ধের ফলাফল দেখে দক্ষ দেখে পক্ষ নেবে তারা।
সহমত ভাইয়ের ভাগ্নে স্বপ্ন দেখতো, এই বাঁধা বেতনের বাপের বা মামার হোটেলে আনন্দ নাই। বাইশ পরিবারের মতো সমৃদ্ধ হতে হবে।
নয় মাসের যুদ্ধে তিরিশ লাখ মানুষ খেয়ে নরভোজিরা নাকে খত দিয়ে ফিরে গেলে; চকির তলা থেকে বীরপুরুষেরা বেরিয়ে আসে; দক্ষ দেখে পক্ষ নেয়।
দক্ষিণ এশিয় নরভোজি সমাজে মানুষ খাওয়াটা একটা চেইন রিএকশান। ফলে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী আবার পাহাড়ে চলে যায় মানুষ খেতে।
আর চকির তলার বীরপুরুষেরা মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্যিক ইতিহাস লিখতে লেগে পড়ে। যার নানা পাকিস্তানি মিছওয়াকে দাঁত খিলান করতো; সে মাথায় লাল-সবুজ পতাকা বেঁধে মঞ্চে এসে তরুণদের বলে, পাকিস্তানের নাম মুখে নিলে আমার রীতিমত হড় হড় করে বমি করে দিতে ইচ্ছা করে। টুথ ব্রাশ দিয়ে দাঁত না মাজলে চলে না।
দেশপ্রেমিক কাল্টের তরুণেরা নানার পাকিস্তানি মিছওয়াক ফেলে বাংলাদেশি টুথ ব্রাশের আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয় রাষ্ট্রবিরোধীদের। সরকার বিরোধীদেরই রাষ্ট্রবিরোধী তকমা দিয়ে টুথ ব্রাশ হেলনে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয়। ক্রসফায়ারে মানুষ খেতে শুরু করে বাংলাদেশ জান্তার নরভোজিরা।
দেশপ্রেমিক গান করে, নানার বাড়ির গাছের তলায় দেখেছিলাম বায়েস্কোপ; বায়েস্কোপের নেশা আমার ছাড়ে না।
বাইশ পরিবার ঠিক ঠাক বাইশশো পরিবার হলে; মামার বাড়ির চকির তলার বীর-ইতিহাস যোদ্ধা মামুর ব্যাংকের লাইসেন্সের মহিমায় রুলিং এলিট হয়ে পড়ে।
এই রুলিং এলিটের ফ্যান ও ফলোয়াররা দেশে কোন সমস্যা হলেই জনগণকে ঘুরাইয়া চটকান দিতে চায়। পাঞ্জাবের সারমেয় আদলে বঙ্গপাঞ্জাবিরা গরীবকে ঘৃণা করতে শুরু করে।
করোনা এলে দেশের মানুষের জীবনে আবার একাত্তরের বিভীষিকা নেমে আসে। একদিকে করোনাভাইরাস; আরেকদিকে ব্যবসার মুনাফা ও জিডিপি ভাইরাস; কোথায় যাবে তারা; বিশবিশের বিষে আবার ৪৯ বছর পর মৃত্যু উপত্যকা হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
একবার গার্মেন্টস খোলে আবার বন্ধ করে আবার খোলে বঙ্গপাঞ্জাবিরা; শ্রমিক সেখানে লাটিমের মতো ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে মৃত্যুফাঁদে পড়ে।
একবিংশের রাজাকার আশার সওদাগরেরা বাতাবি লেবুর আসর জমিয়ে, কিচ্ছুটি হবে না; ও কিছু নয়; সাহস করে কাজে নেমে পড়ো; আমরা এই ফাঁকে চার্টার্ড বিমানে করে সেকেন্ড-থার্ড হোমগুলোর দরজার তালা বন্ধ আছে কীনা দেখে আসি; মিসকিন পশ্চিমারা কখন বাড়ি লুট করে তার ঠিক নেই; যাই সুইসব্যাংক থেকে চা খেয়ে আসি; টেকাটুকা গুণে আসি। তোমরা মন দিয়ে কাপড় সেলাই করো; টুপি সেলাই করো; আর হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলো। এটাই নিউ নরমাল লাইফ।
বিশ বিশের বিষে নীল হয় বাংলাদেশ। উন্নয়ন দংশন আর করোনাভাইরাস মিলে শুরু করে দোকানদারির অভিসার। বাইশ শো পরিবার ভি আই পি হাসপাতালের আইসিইউ-তে কাছিম হয়ে পড়ে থাকে। ভাইরাস যেন কিছুতেই ফেরাউনের প্রাসাদে ঢুকতে না পারে; সেটা নিশ্চিত করতে ডিস ইনফেক্টেড বাংকার হয়ে ওঠে ভাওয়ালপিন্ডি। সুতীব্র দেশপ্রেমে তাদের আতশবাজি করতে দেখে কে যেন ফিস ফিস করে বলেন, দূর হ চাটার দল; চোরের খনির বঙ্গপাল।
ক্রমশ:
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-Chief : E-SouthAsia