করোনাকালে জনমানুষের বিপন্নতার ট্র্যাজেডিকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা তাদের রুটিন সময় কাটাচ্ছেন। কেউ সেকেন্ড হোমে যাচ্ছেন; কেউ চক্ষুর নজর এমনি কইরা একদিন যাতে ক্ষয়ে না যায়; তাই লন্ডনে যাচ্ছেন; যাবার পথে পদমর্যাদা রক্ষায় প্লেনের যাত্রীদের তাদের নির্ধারিত আসন থেকে তুলে দিয়ে নিজে সেখানে বসে ভি আই পির বিজয় নিশান ওড়াচ্ছেন। বিএনপি-জামাত বিষয়ক মন্ত্রীরা করোনার সমস্যার জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে জামায়াত-বিএনপিকে দায়ী করছেন।
ক্ষমতাসীনের দলীয় ইতিহাস রচনায় সাফল্য পেলে ব্যাংক লাইসেন্স-পদক-প্রকল্প মিলে যায়। তাই করোনাকালে ফেসবুকের করোনা-সংবাদ ঢেকে যায় ইতিহাসের বিজ্ঞাপনে। তা ছাড়া মুজিব বর্ষের মেলাতে পাপড়-বাতাসা বিক্রির মতো করে ইতিহাসের হাটুরেরা বই প্রকাশ করে স্টল সাজিয়ে বিক্রি করতে চেয়েছিলো; কিন্তু করোনা এসে দিয়েছে সব পণ্ড করে দিয়েছে। এতে জাতির জনকের আত্মা শান্তি পেয়েছে। তিনি তার দলের এইসব “চাটার দল” ও “চোরের খনি”-র মাধ্যমে দ্বিতীয় মৃত্যুর আশংকা করেছিলেন জীবদ্দশায়। তিনি ত্রিকালদর্শী ছিলেন, তিনি ঠিকই জানতেন, তার দল আইয়ুব খানের মতো উন্নয়নের “বেহুদা ঢোল” বাজাবে; নেপোয় দই মেরে নেপোটিজমের নরক রচনা করবে।
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম; করোনা-অব্যস্থাপনার মৃত্যু উপত্যকায় বসে আওয়ামী লীগের নেতা বিসর্জনের কালে অর্জনের আলাপ করছেন। উনার ভাষ্যমতে সব অর্জন আওয়ামী লীগের। এই ভাষ্যে বঙ্গবন্ধু নামের অলংকার লাগিয়ে ভাষ্যটিকে পোক্ত করতে চেয়েছেন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ থেকে সেদিনই সরে গেছেন; যেদিন উনি দেখেছেন পাকিস্তানের চোরের দলকে সরিয়ে দেশকে রাহুমুক্ত করার পর এবার স্বদেশী চোরের খনি সব কিছু খেয়ে ফেলছে। জাতির জনক কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেছেন, আমি ভিক্ষা করে যা নিয়ে আসি; সব খেয়ে ফেলে চাটার দল আর চোরের খনি।
তাই চাটার দল যতই বঙ্গবন্ধুকে অনভিপ্রেত চাটার চেষ্টা করুক ; আমরা জানি এই চোরের খনির রাজনীতি উনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কৃষক-শ্রমিককে নিয়ে “বাকশাল” নামের নতুন দল খুলেছেন। এই কৃষক দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে; শ্রমিক প্রবাসে কাজ করে রেমিটেন্স পাঠিয়েছে; নারী শ্রমিক উপহার দিয়েছে গার্মেন্টস শিল্প। বাংলাদেশের জিডিপি ম্যাজিকের কারিগর কৃষক-শ্রমিক। আর লুন্ঠনের কারিগর এইসব বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াত-আওয়ামী লীগ হয়ে লুন্ঠক মিডলম্যান বা ঠগীরা।
বঙ্গবন্ধুর বাকশাল কিউবা বা চীনের মতো সমাজ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা; যেখানে সম্পদের সুষম বন্টন ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতীতী ছিলো। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার জন্য বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এক চ্যালেঞ্জ; যে লোক একই সঙ্গে সাম্যবাদ চর্চা করেন, আবার ইসলামি সম্মেলন সংস্থাকে সুগঠিত করে অনগ্রসর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যেতে চান। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়; মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ)-র মদিনা সনদে সব ধর্ম-বর্ণ-অর্থনৈতিক গোত্রের মানুষকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছিলো। মদিনা সনদের মতো ধর্ম নিরপেক্ষ ঐতিহ্য অস্বীকার করে জামায়াত-হেফাজত-ওলামা লীগ যত্রতত্র মানুষকে নাস্তিক-কাফের ইত্যাদি ফতোয়া দিয়ে বেড়ায়।
যারা সম্পদের সুষম বন্টন চায়না; ধর্ম নিয়ে ব্যবসার মনোপলি ছাড়তে চায়না; এরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা প্রয়োজনীয় মনে করেছে। তার মানে চোরের খনি আর চাটার দলই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর খুনি।
ফেসবুকে চোরের খনি ও চাটার দলকে দেখি বঙ্গবন্ধুর ছবি কাভার পেজে লাগিয়ে মরা-কান্দন জুড়ে দেয়; যেন জাতির জনকের প্রতি প্রেমে দিওয়ানা মদিনা হয়ে পড়েছে তারা। অথচ এই যে করোনাকালে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে ফুটবল খেলা, শ্রমিক ছাঁটাই, পাটকল বন্ধ করে দেয়া; এর মাঝ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রাণের মানুষ শ্রমিকদের সিসটেমেটিক ক্লেনজিং-এর মানবতা বিরোধী অপরাধ করছে এরা।
বাংলাদেশকালের ইতিহাস আমার চোখের সামনে ঘটা ঘটনাবলী নিয়ে। কাজেই আমরা দলীয় ইতিহাস বা ইতিহাসের বিকৃতিকে পাত্তা দিইনা। ইসলামকে বুঝতে যেমন “কুরান পড়ি”; ধর্ম-ব্যবসায়ীর ফতোয়া গ্রহণযোগ্য নয়।
সুশাসনের দাবিতে ১৯৭২-৭৫ সালে সক্রিয় মানুষেরা বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধাহত দেশ পুনর্গঠনে একেবারেই সময় দেয়নি। তারা ম্যাজিক সলিউশান চেয়েছেন; যা পৃথিবীর কোন দেশেই সম্ভব হয়নি। এই দেশসচেতন অথচ অধৈর্য্য নাগরিক সমাজের নিষ্ক্রিয়তা; চোরের খনির শয়তানদের বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় প্রলুব্ধ করেছে। অথচ বঙ্গবন্ধু শাসন-ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন; কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়ে। আওয়ামী লীগ চোরের আখড়া হয়ে যাওয়ায় তিনি বাকশাল নিয়ে আসেন। এ ব্যবস্থা সফল না হলে একদল থেকে বহুদলের সামাজিক গণতন্ত্রী প্রথায় ফেরা যাবে এমন ফ্লেক্সিবল মনোভঙ্গিও দেখান বঙ্গবন্ধু।
১৯৭৫ সালের প্রতিবিপ্লবে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে; বিপ্লবীরা চোরের খনির অপেক্ষাকৃত আর্থিকভাবে সৎ লোক খুঁজে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। জিয়া পেশাদার সেনা-কর্মকর্তা; তাই প্রতিবিপ্লবীদের হত্যা করে শাসন ব্যবস্থা সুসংহত করতে চেষ্টা করেন। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মাচরণ না থাকলেও বিসমিল্লাহ ব্র্যান্ডিং করে জনপ্রিয়তার সিঁড়ি খোঁজেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দায়মুক্তি দেন ক্ষমতা সুসংহত করতে।
জিয়া যেহেতু রাজনীতির মানুষ নন; ফলে সেনা-প্রশাসনের জানাপথে দেশ চালান। বঙ্গবন্ধু গৃহীত কৃষিনীতি, শিশু ও নারী নীতি, পরিবার পরিকল্পনা নীতি; এগুলো সচল থাকে। বঙ্গবন্ধুর আইকনকে আড়াল করলেও দেশের উন্নয়ন নীতিতে বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করার সুযোগ ছিলো না। ফলে আরেক সেনা শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়েও বঙ্গবন্ধুর পথ মানচিত্রেই দেশ চলে। সেনা-প্রশাসনের লোক; জনগণের পালস বোঝার ক্ষমতা নেই; তাই ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে টিকে থাকার চেষ্টা করেন তিনি। রান্নাঘর থেকে রাজনীতিতে ছুটে আসা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া তখন, এরশাদকে স্বৈরাচারী শাসক তকমা দিয়ে তরুণ ফুটসোলজারদের লেলিয়ে দেন তার পতন ঘটাতে।
এরশাদের সময়ে যে “শিক্ষা-নীতি” প্রচলনের চেষ্টা করা হয়েছিলো; তা হুবহু ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি। এ সময় যে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়; তা-ও জনবান্ধব। ডাক্তারদের লাগাম ছাড়া প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধের চেষ্টা; ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোতে ব্যাপারটা যেরকম।
এরশাদ সেনা শাসক; দেশ শাসনে আসাটাই বে-আইনি তার জন্য; সে কারণে তাকে সরানোর রাজনৈতিক আন্দোলন খুবই যৌক্তিক। কিন্তু তার উত্থাপিত যে শিক্ষা নীতি ও স্বাস্থ্যনীতিকে হত্যা করা হয়েছে; তা আজকের বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।
তার মানে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার চিন্তায় “দেশের ভালো’-র চেয়ে “নিজের ভালো”; “নিজেরটুকু বুঝে নেবার” আত্মকেন্দ্রিকতা কাজ করেছিলো। যাদের নাতি-নাতনি বিদেশে পড়ে; যারা চোখের ছানি কাটতে লন্ডনে দৌড়ে যেতে হয়; তাদের কাছে দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য কোন ব্যাপার নয়।
রাজনীতিতে ক্ষমতার লড়াই চিরন্তন একটি বিষয়; কিন্তু সেটি সভ্য উপায়ে না হয়ে; ক্রসফায়ারের বিনিময়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা হয়ে দাঁড়ালে; তা মানবতা বিরোধী অপরাধ। এই মানবতা বিরোধী অপরাধের দায় থাকার পরেও আওয়ামী লীগ আর বিএনপি কোনমুখে আদর্শের আর নৈতিকতার দাবি করে তা অজানা।
দলীয় ইতিহাসবিদেরা; আজকের মৃত্যু-অবিচার-অসাম্যের বর্তমানকে ঢেকে দিতে টাইম মেশিনে করে আমাদের বার বার ১৯৪৭-৭১-৭৫ সালে নিয়ে যেতে চান। ভি আই পি সহমত ভাইয়েরা বড় গলা করে বলেন, অতীত বিস্মৃত হয়ে রাজনীতির আলোচনা অসাড়। উন্নয়নের চর্বি লেগে আয়েশ করে অতীতের আলাপ করার এই বিলাসিতা; নরভোজ শেষে পান চিবিয়ে “বর্তমান” অস্বীকারের ভাঁওতা। করোনাকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রক্ষা কবচ হীন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তাহীন জনমানুষের সঙ্গে প্রতারণা এইসব আধাসামন্ত ও গ্রাম্য টাইমমেশিন ভ্রমণ।