আমরা আমাদের শিশু-কিশোর-তরুণদের প্রচন্ড স্নায়ুচাপের মাঝে রাখি। তাদেরকে সারাক্ষণ জীবনে ‘সফল’ হতে হবে এই হিতোপদেশ দিয়ে বর্তমানকে উপভোগ করতে দিইনা।
দক্ষিণ এশীয় সমাজ হচ্ছে একটা ভ্রান্ত ইঁদুর দৌড়ের জীবন। অভিভাবকেরা তাদের সন্তানকে একটা ইঁদুর বানিয়ে ছাড়েন ক্রমে ক্রমে। ইঁদুর জন্মানোর আগেই স্কুলে তার নাম রেজিস্ট্রেশান করে ফেলেন আম্মু। প্লে গ্রুপ নামের কী যেন একটা ঘোড়ার ডিম নাম দিয়ে তিন-চার বছর বয়েসী শিশু ইঁদুরকে খুব ভোর বেলা কাঁচা ঘুম থেকে জোর করে উঠিয়ে স্কুলে নিয়ে যান আম্মু। সেইখানে আবার হোমটাস্কও থাকে। শিক্ষা সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণা ছাড়াই বিভিন্ন রকম স্কুলের দোকান খুলে বসে থাকে ইঁদুর দৌড়ের ব্যর্থ প্রশিক্ষকেরা। এরা ধীরে ধীরে শিশুর পিঠে ঝোলানো বইয়ের ব্যাগে বইয়ের ভার বাড়াতে থাকে।
এই একটা ছোট্ট ইঁদুরের বাচ্চার পড়ালেখা নিয়ে মায়ের টেনশান দেখলে মনে হয়; সে যেন অনার্স ক্লাসের ছাত্র। এই যে শিশুর পিঠে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়; এ আসলে প্রত্যাশার চাপের ভারবাহী পশুতে পরিণত করার নিষ্ঠুর আয়োজন।
এইসময় ছোট্ট ইঁদুরের বাচ্চাটিকে কবিতা আবৃত্তি-গান শিখিয়ে ছবি আঁকিয়ে প্রতিবেশীদের সামনে নিজের বাচ্চার পারফরমেন্স দেখানোর এক ঘোড়া রোগ অভিভাবকদের মাঝে দেখা যায়। ইদানীং স্কুল ক্লান্ত শিশুকে ধমক দিয়ে ফেসবুক লাইভে নিয়ে এসে পারফর্ম করান বাবা- মায়েরা। বলিউডের চলচ্চিত্র “সিরিয়াস ম্যান” ছবিতে এরকম অভিভাবকের দেখা পাই আমরা। বাচ্চাকে পারফর্ম করার চাপ দিয়ে; তোমাকে সফল হতে হবে; এই প্রত্যাশার চাপে ধীরে ধীরে অপ্রকৃতস্থ করে ফেলা হয়।
কাকতালীয়ভাবে আমার এস এসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে ফিরে আব্বা বলেছিলেন, পুরোটা সময় সিরিয়াস গার্জেনদের সঙ্গে কাটিয়ে রীতিমত টেনশানে পড়ে গেলাম। তুমি ঠিক ঠাক পরীক্ষা দিচ্ছো তো; প্রিপারেশান ঠিক আছে তো! অন্যদের প্রিপারেশান তো খুবই ভালো মনে হচ্ছে। আম্মা তখন আব্বাকে বললেন, তুমি সিরিয়াস গার্জেনদের মতো ছেলেটার মধ্যে টেনশান ঢুকিয়ে দিওনা। আম্মা বললেন, যা পড়ার সারাবছর পড়েছো; এখন টিভি দেখো। পরীক্ষার দুঃশ্চিন্তা একদম নয়। “সিরিয়াস ম্যান” মুভিটা দেখার সময় আমি বার বার আমার আব্বা-আম্মার প্রতি কৃতজ্ঞ হচ্ছিলাম। যারা এই একই নন- সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাদের নাতিকেও হাতে খড়ি দিয়েছেন। জগত-সংসারের প্রত্যাশার চাপ থেকে মুক্ত করে দেবার এই পদ্ধতিটিই আসলে জীবনদায়ী কৌশল। আজকের অভিভাবকদের এটা শিখতে হবে; তাদের সন্তানের জীবন বাঁচাতে।
জিপিএ ফাইভ কেন পেতে হবে! কেন পরীক্ষার ফলাফলের চাপে শেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হবে শিশুদের। কী হয় জিপিএ ফাইভ না পেলে। আসল তো হচ্ছে শেখা; আনন্দের মাঝ দিয়ে শেখা। আমি আমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী শেখাতে হবে একটা শিশুকে? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, বাংলা-ইংরেজি-অংক; এই তিনটি বিষয়ে পাকাপোক্ত ভিত্তি থাকলে; বাকিটা ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই শিখে নিতে পারে। একই প্রশ্নের উত্তরে আম্মা বলেছিলেন, ক্লাসের বইয়ের বাইরে অনেক বই পড়তে হবে। সিলেবাসের বাইরেই থাকে আসল সিলেবাস।
আমরা আমাদের সন্তানদের তাদের পছন্দের বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে দিইনা। “ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং-এমবিএ-কম্পিউটার সায়েন্স”; এই হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় অভিভাবকদের পছন্দ তালিকা। এই বিষয়গুলোতে ভর্তি না হতে পারলে জীবন বৃথা যাবে; এমন একটা অনুসিদ্ধান্ত নিয়ে অভিভাবকেরা গ্যাট হয়ে বসে আছেন। এর ফলে চল্লিশ বছর পর্যন্ত ইঁদুর দৌড় দিয়ে তারপর আপাতঃ সফল লোকেদের অফিস সময়ের পরে বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। নিজের পছন্দের বিষয়ে না পড়লে; নিজের পছন্দের কাজটি না করলে; জীবন একসময় রেশমি বস্ত্র থেকে জীর্ণ ত্যানায় পরিণত হয়।
বাবা-মা’র পাশাপাশি দক্ষিণ এশীয় একটি অভিভাবক সমাজ থাকে; যারা “সাফল্যের গাইড” বুকের ভূমিকা পালন করেন। তাদের কাছে রাজ্যের সফল ছেলে-মেয়ের খোঁজ। অমুকের ছেলে সেরা হয়েছে; তমুকের মেয়ে দেখিয়ে দিয়েছে; অমুকের ছেলে সিক্স ডিজিট বেতন পায়; অমুকের মেয়ে ক্যানাডায় বাড়ি কিনেছে। এদের ফিরিস্তি শুনলে যে কোন অভিভাবক দিশেহারা হয়ে পড়তে বাধ্য। তাদের মনে হয়, আমার পোলাডাই কিছুই করতে পারলো না!
ফেসবুকে পাশের বাড়ির ছেলেটির সাজানো প্রশস্ত অফিসের ছবি দেখে, গাড়িতে বসে পাশের বাড়ির মেয়েটিকে ঠোঁট বাঁকিয়ে “পাউট” সেলফি দিতে দেখে; অমুকের ছেলেটিকে ইটালির ক্যাপ্রি দ্বীপে সানগ্লাস পরে ছবি দিতে দেখে; পত্রিকায় তমুকের মেয়েটির “সফল যারা কেমন তারা” ইন্টারভিউ দেখে; হায় হায় আমার পোলা-মাইয়া ব্যর্থ হইলো; এই ক্রন্দনে ফোঁস ফোঁস করে দক্ষিণ এশীয় সমাজ।
মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে পাশে মুসল্লি যখন বলে, জানেননি হারেস সাহেবের পোলা বিরাট গার্মেন্টস-এর মালিক; সে তার আব্বা-আম্মারে সতেরো লক্ষ টাকা খরচ কইরা হজ্ব করাইয়া আনছে; বলেন আলহামদুলিল্লাহ। এরপরেই মুসল্লি দাড়িতে আদরের পরশ বুলাতে বুলাতে বলে, আন্নের পোলা জানি কী করে! খোঁজ-খবর লয়তো! আন্নেরে দেকি একা একা ঘুরেন; আহারে চুক চুক চুক।
অভিভাবক সমাজের মাত্র কয়েকটি চাকরি পছন্দ। বিসিএস; বিশেষতঃ প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্সেশান, অডিট এন্ড একাউন্টস। মুরুব্বি চাচা পান খাওয়া দাঁত বের করে বলে, উফরি কিমুন! অভিভাবক সমাজের আর পছন্দ কর্পোরেট চাকরি; যেখানে সিক্স ডিজিট বেতন-গাড়ি-গুড়ি আছে; মাঝে মাঝে বাঞ্জি জাম্পিং করা যায়। ইদানীং সরকারের সহমত ভাই হওয়া অভিভাবকদের পছন্দের পেশা হিসেবে হাজির হয়েছে। পাড়ার চোর-ছিনতাইকারী ছেলেগুলো গত এক দশকে উন্নয়নের সোনার ধূলো ঝেড়ে দোতলা-তিনতলা-বহুতল ভবন করেছে; কেউ কেউ বিদেশে বেগম পাড়ায় বাড়ি কিনেছে! সুতরাং পোলারে আম্লিগে ভিড়াইয়া দ্যান!
এইভাবে প্রত্যাশার এয়ার টাইট কম্পার্টমেন্টে আমাদের তারুণ্য আজ ব্রিদিং প্রবলেমে ভুগছে। দম আটকে মরার দশা তাদের। এইভাবে জীবনের প্রাইম টাইম; চল্লিশ পর্যন্ত আমরা আমাদের সন্তানদের প্রত্যাশার কারাগারে বন্দী করে রাখছি। তারা ভেতরে ভেতরে হাহাকার করে, হারেরেরেরেরেরে আমায় ছেড়ে দেরে দেরে। তারুণ্য এই প্রত্যাশার পাথর বুকে নিয়ে হাঁস ফাঁস করে; গলায় ফাঁস দিলে; তখন আবার নব্যশিক্ষিত সাফল্যের গাইড বুক মোটিভেশনাল স্পিকার মামারা এসে পড়ে। গালি দিয়ে বলে, কাপুরুষ কোথাকার!
যে সমাজে তারুণ্যের নিজের জীবন নিয়ে ফ্রিডম অফ চয়েস বা ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই; সেখানে তাদের সুস্থ জীবনদায়ী বিকাশ প্রত্যাশা করা অলীক এক কল্পনা। অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন বলেছেন, একজন ভিক্ষুক আর একজন উপোসী সন্ন্যাসীর পার্থক্য হচ্ছে; ভিক্ষুকের ফ্রিডম অফ চয়েস নেই; আর উপোসী সন্ন্যাসীর ফ্রিডম অফ চয়েস আছে।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
এডিটর-ইন-চীফ, ই-সাউথ এশিয়া