পুরান শাকা নগরীর গোয়ারি তল্লাটে চতুরী পরিবারকে সবাই এক নামে চেনে। এই চতুরীদের বাড়িতে দেশপ্রেম আর উদারতার গোলাভরা ধান; পুকুর ভরা মাছ; আর গোয়াল ভরা গরু। গত সাতটি দশক ধরে স্বাধীনতা দিবসে পতাকা ওড়ে এ বাড়ির ছাদে। বসার ঘরে জাতির জনকের ছবি শোভা পায়। পতাকা যায় নতুন পতাকা আসে; কায়েদে আজম যায়; জাতির জনক আসে; কিন্তু চতুরী বাড়ির দেশপ্রেমের গরুগুলো নিয়ম করে দুধ দেয়।
নতুন চতুরীরা এই গরুগুলোকে ক্যাশ কাউ বলে। এই গরুর গরম দুধ খেতে সাতদশক ধরে সাতরঞ্জ কি খিলাড়িরা এ বাড়িতে এসেছেন। জামবাটিতে ফুঁ দিয়ে গরম গরম দুধ খেয়েছেন। কী বৃটিশ আমল-কী পাকিস্তান আমল-কী বাংলাদেশ আমল; সাতরাঞ্জ কী খিলাড়িরা এইখানে খুশিদুধ খেয়ে কচ্ছপের মতো উপুড় হয়ে পড়ে থেকেছে নক্সী কার্পেটে। চতুরীর বাড়ির বসার ঘরে দাবা খেলার নিয়মিত চল। মেপে মেপে চাল দিয়ে ঘোড়া দিয়ে আড়াই ঘর চাল দিয়ে কিস্তি মাত করতে ওস্তাদ চতুরীরা। জাতীয়তাবাদ-ধর্ম-দেশপ্রেম আর সহমতের অক্সিজেনে ঠাসা এই সানকাট ডায়ামন্ড তৈরির জলসাঘর।
চতুরীদের রক্তে সহমতের নীল রক্ত বহমান; সুতরাং ক্ষমতায় যে রহমানই থাকুক; চতুরীদের মনের লতা অঙ্গ বেয়ে ঠিকই পাওয়ার প্ল্যান্ট জড়িয়ে ধরে। ঐ যে ক্যাশ কাউগুলোর গরম দুধ; তা জাম বাটিতে ফুঁ দিয়ে খেলে পাওয়ার প্ল্যান্ট গান করে, জাদু হ্যায় নেশা হ্যায় মাদহোশিয়া। ম্যায় খুদকো ছুপাহু কাঁহা!
চতুরী বাড়ির ছেলেদের ছোট বেলা থেকেই ধারাপাত মুখস্ত করানো হয়। একেক কে এক, দুই একেক কে দুই; মেমোরাইজ করতে করতে চতুরীরা রাইজ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের রাজ্যে। ভোর বেলা মৌলানা সাহেব এসে কুর আন তেলাওয়াত শেখান, তারপর দিনময় ধারাপাত শিক্ষা, বিকেলে ফুটবল ও ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দেয় চতুরী বালকেরা। ক্যাশকাউয়ের দুধ খেয়ে শরীর কিছুটা ভারী হয়ে যাওয়ায়; খেলার সাথীরা বলে, খেলার স্পিডের চেয়ে তোর ধারাভাষ্যের স্পিড বেশিরে চতুরী। ঐখানেই লেগে থাক।
এই মেদভুঁড়ি কী করির খোঁটা শুনে এক গোয়ারি বালক চতুরী নৃত্য শিক্ষা শুরু করে। বাতাবি লেবু টিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নেচে চতুরী দ্য জুনিয়রের নর্তক ও নট জীবনের শুরু। সেই নাচ দেখে বিরক্ত হয়ে চতুরী দ্য সিনিয়র বলেন, শুধু নাচ শিখলেই হবে! সিস্টেমটাকে নাচাতে শিখতে হবেরে ‘কুমড়ো পটাশ”। এই নৃত্যটা হচ্ছে সেক্যুলার ব্যাপার। পাওয়ার প্ল্যান্টে; ধর্ম-নৃত্য-ধারাপাত এই তিনেরই সমারোহ। ফলে সান কাট ডায়ামন্ড হয়ে ওঠে চতুরী বালকেরা।
পাওয়ার প্ল্যান্ট সেটা চানতারার হোক; লাল সবুজের হোক; চতুরীরা সেখানে ঠিকই ফিট করে যায়। ক্যাশ কাউয়ের হেডকোয়ার্টার হাওয়া রাতে; কিংবা সুবাতাস দুপুরে; পুরান শাকার গোয়ারীর চতুর বাড়িতে রয়ে যায় ঠিকই।
চতুরীরা সতত খাদক; খায় ও খাওয়ায়; যাকে বলে খাওইন্যা বাড়ি। কিন্তু শর্ত একটাই; শুধুই সুনাম করতে হবে; সুনাম করলে তেহারির ডেকচিতে কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার জিয়াফত। কিন্তু দুর্নাম সহ্য করতে পারে না; চতুরীরা। যদি তুমি সহমত হও; তবে তুমি বেশ; যদি তুমি ভিন্নমত হও; তবে তুমি শেষ।
সেই একবার চানতারার রাজাকার বলায়; দুই উদ্ধত তরুণকে পাইক বরকন্দাজ পাঠিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে এনে হাড্ডিহুড্ডি ভেঙ্গে গুঁড়া করে দেয়া হয়েছিলো। সিনিয়র চতুরী গর্জন দিয়েছিলেন, বাঘে-মহিষে চতুরীর ঘাটে একত্রে ক্যাশকাউয়ের দুধ খায়; আর কোথাকার কোন ফকিন্নির পুত্র কীনা রাজাকার বলে!
রাজা যায় রাজা আসে; রাজাকার যায় রাজবদর আসে; কিন্তু চতুরী বাড়ির ক্যাশ কাউ তেরো দুগ্ধ নদীকে ঠিকই সাত সমুদ্রে পৌঁছে দেয়। পুরান শাকা থেকে চতুরীরা নতুন শাকায় আসে। আগের স্বাধীনতার সুফল কুড়িয়ে শাকা শহরে গোটা পঁচিশেক বাড়ি করে পুরোনো চতুরী। আর পরের স্বাধীনতার সুফল কুড়িয়ে শাকার বাড়িকে নতুন চতুরীরা পৌছে দেয় পশ্চিমের বেগম পাড়ায়।
দেশটাই যে একটা ক্যাশকাউ; এটা সান কাট ডায়ামন্ড চতুরীরা ধারাপাত শিখতে শিখতে; নাচতে নাচতে আর দেশপ্রেমের ক্রিকেট ধারাভাষ্য দিতে দিতে দারুণভাবে শিখে ফেলে ।
এই ল্যান্ড অফ অপরচুনিটিতে চতুরীদের পছন্দ ঘোড় দৌড়; সে অনেক আগের কথা; রেসকোর্সের ময়দানে দ্রুতগামী ঘোড়ায় বাজি ধরতেন চতুরী দ্য সিনিয়র। আর এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেশপ্রেমী ঘোড়ায় বাজি ধরেন চতুরী দ্য জুনিয়র।
এই ঘোড়া বাজি জিতে গেলে; আগে যেমন লোকে মাটির ব্যাংক কিনতো; ঠিক সেই স্পিরিটে চাষা-ভুষোদের ব্যাংক কিনে নেয় চতুরীরা। ওয়ানটন পাঁচতারা হোটেলে পিউ পাপিয়ার আসরে সুচিন্তকেরা যখন ‘হিজড়ে লাগিয়ে দিয়ে পদ্য লেখে”; চতুরী দ্য জুনিয়র তখন নৃত্য লাস্যে সেখানে ঢুকে বলে, “বাবু খাইসো।”
টেকাটুকা-শারাব-কাবাব-শায়েরি শেষে বিশিষ্ট দেশপ্রেমের টকশো লিপ সার্ভিস ম্যান ধারাপাত ভাইকে একটা এফিমিনেট হাগ দিয়ে চতুরী দ্য জুনিয়র বলে, বেগম পাড়ায় বসে অনেক ভাবলাম। আপনিও ধারাপাত আমিও ধারাপাত; এবার চলুন স্বপ্নের “ইউনিভার্সিটি অফ বেগমপাড়া” গড়ি। চলুন এদেশের তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার পিঁপড়াবিদ্যা শেখাই। অদূরে দাঁড়ানো মাথামুণ্ডিত উপাচার্য লক্ষণ সেন মিটি মিটি হাসছিলেন। চতুরী দ্য জুনিয়র তাকেও এফিমিনেট হাগ দিয়ে বলে, চলুন এবার ক্যাশকাউয়ের গলায় শিক্ষার উত্তরীয় পরাই।
টিভির সফল যারা কেমন তারা সিরিজে; “স্টাইল উইথ চতুরী” এপিসোডে; সাকসেস স্টোরি তুলে ধরা হয়; কী করে পুরান শাকা-নতুন শাকা-বেগম পাড়া হয়ে মতিঝিল ভেগাসের শেয়ার বাজার; চাষা ভুষোদের ব্যাংক, ইউনিভার্সিটি অফ বেগম পাড়া গড়তে গড়তে ইতিহাস গড়ার রেসে চতুরী দ্য জুনিয়র তাক লাগিয়ে দিলেন?
এর উত্তরে চতুরী বলেন, হার্ড ওয়ার্ক-হার্ড ওয়ার্ক এন্ড হার্ড ওয়ার্ক।
টিভি শো দেখার পর “মত চিত্তে নিত নৃত্যে ক্যাশকাউ নাচে; তা তা থৈ থৈ” বলে নাচতে নাচতে; হঠাত ফেসবুকে চতুরী তাকে নিয়ে একটি পৃথুল কার্টুন দেখে আর এই কার্টুনের মন্তব্যে “রাজাকার থেকে রাজবদর”; “সহমত ভাইয়েরাই যুগে যুগে টিকে থাকে লুন্ঠনে-বন্টনে আর পাচারে;” এসব দেখে রেগে ফায়ার হয়ে যায়। চতুরী বাড়ির লোক সুনাম চায়; দুর্নাম সহ্য করতে পারে না। যদি তুমি সহমত হও; তবে তুমি বেশ; যদি তুমি ভিন্নমত হও; তবে তুমি শেষ।
চতুরী দ্য জুনিয়র ঘুমের মধ্যে ঘেমে ওঠে; পৃথুল শরীরটা শ্বাস-কষ্টে হাপরের মতো ওঠানামা করে। ইন হেলার নিতে উঠে দেখে, চক্ষুলাল চতুরী দ্য সিনিয়র চেয়ারে বসে আদেশ করছে, পাইক-বরকন্দাজ পাঠিয়ে ধইরা আন ওগো; যারা অভিজাত চতুরী বাড়ির মানহানি করেছে।
চতুরী ফোন করেন, ওয়ান্টন হোটেলের বুলবুলি আখড়াই-এর রেগুলার বাবু অভিজাত বাহিনীর হাবু ভাইকে।
কাঁপতে কাঁপতে বলে, কার্টুনিস্ট আর পেজ এডমিনরে সাইবার এক্টে আটক করুন; আমাকে সাইবার নিরাপত্তা দিন। ওরা দেশদ্রোহী। আমিই দেশ; আমার মানহানি মানে দেশের মানহানি।
চতুর বাড়ির অনুভূতি রক্ষায় ও চতুরের ক্যাশকাউয়ের দুধ খাওয়া দেশপ্রেমিকদের মানের গোপনীয়তা রক্ষায়; কারাগারে ডান্ডা বেড়ি পরে ধুঁকতে থাকে লেখক ও কার্টুনিস্ট।
চতুরী দ্য জুনিয়র আদালতকে ফোন করে বলে এফিমিনেট লাস্যে , “বাবু খাইসো; এই শোনো লক্ষীটি; জামিন পাবে ঋণ খেলাপীরা কিন্তু মান খেলাপীদের জামিন; কাভি নেহি।”
এইভাবে একদিন কারাগারে লেখকের মৃত্যু হলে; সে সুসংবাদ শুনে চতুরী আনন্দে ধারাপাত নৃত্য করতে করতে করতে বলে, একেককে এক; দুয়েককে দুই; কার্টুনিস্টটা মরে না ক্যারে। ওরা জানেনা; এই চতুর বাড়ির ঘাটে বাঘে-মহিষে একসঙ্গে ক্যাশকাউয়ের দুধ খায়।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
এডিটর-ইন-চীফ, ই-সাউথ এশিয়া