১৯৭৪ সালে জাসদ লাগাতার প্রোগ্রাম দিচ্ছিল দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে। ৮ই ফেব্রুয়ারীর হরতালের পর ১৭ই মার্চ, ১৯৭৪ সালে পল্টন ময়দানে সভা ডেকেছিল জাসদ পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণার জন্য। সভাকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক জোট এবং কৃষকলীগ সম্মিলিত ভাবে প্রচার এবং সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ১৭ই মার্চের সভা দুপুর বেলা, সময়টা সঠিক ভাবে মনে নেই। আমি তখন ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক এবং লিনু সদস্য। সাধারণত আমি আর লিনু আমাদের দায়িত্বে থাকা মেয়েদের সাথে করে নিয়ে মিটিংয়ে, মিছিলে আসতাম। বদরুন্নেসা কলেজের মিথুন এবং বানুও আমাদের সাথে যোগ দিত। সেদিন সকাল ১১টায় আমার ডেন্টিস্টের সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিল নবাবপুরে। তাই লিনু, বানু এবং মিথুনের সাথে আমার কথা হয়েছিল ওরা সভাস্থলে চলে আসবে, আমি নবাবপুরে ডেন্টিস্টের অফিস থেকে সরাসরি পল্টন ময়দানে চলে আসব। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সভাস্থলে আমাদের দেখা হয়েছিল। সময় মত যথারীতি সভা শুরু হয়েছিল। শাজাহান সিরাজ, আসম আবদুর রব এবং মেজর জলিল ভাষণ দিয়েছিলেন। বক্তারা তাদের ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন যে, সভা শেষে শোভাযাত্রা করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মনসুর আলীর মিন্টু রোডের বাসভবনে যেয়ে ঘোষিত দাবীদাওয়া সম্বলিত স্মারকলিপি মন্ত্রীর কাছে পেশ করা হবে। সভা শেষে নেতৃবৃন্দ সবাইকে মিছিলে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। যথারীতি হাজার হাজার ছাত্র জনতা মিছিল করে রাস্তায় নেমে এসেছিল। মিছিলের অগ্রভাগে মেজর জলিল, আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন। আমরা সব মেয়েরাও মিছিলের অগ্রভাগে নেতাদের সাথে সাথে শ্লোগানে শ্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মিছিল শুরু হতেই হাসানুল হক ইনুর সাথে দেখা হয়ে গেল, তিনি ঢাকায় ছিলেন না, প্রোগ্রামে মাদারীপুর গিয়েছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে জানতে চেয়েছিলাম,”আরে ইনুচাচা, আপনি কখন এলেন?” ইনুচাচা বলেছিলেন,” এইতো বাস থেকে নেমে জাসদ অফিসে গেলাম, দেখি অফিস খালি, সিরাজ ভাই একা বসে আছেন। আমাকে বললেন, সবাই পল্টন ময়দানে গেছে, তুমিও যাও। ব্যাগটা জাসদ অফিসে রেখে চলা আসলাম।”
মিছিল পল্টন ময়দান থেকে বের হয়ে জিপিওর মোড়ে ডান দিক দিয়ে বায়ে মোড় নিয়ে তোপখানা রোডে উঠেছিল। প্রেস ক্লাব পেরিয়ে হাইকোর্টের সামনে ডান দিকে মোর নিয়ে সোজা কাকরাইলের মসজিদের সামনে দিয়ে এসে আমরা মিন্টু রোডে উঠেছিলাম। কোনটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ী আমার জানা ছিল না, আসলে কোন মন্ত্রী কোথায় থাকে সেটা তো আমাদের জানার কথা নয়, জানার চেষ্টা কখনও করিনি। সবাই যখন একটা গেইটের সামনে থামলো বুঝেছিলাম আমরা গন্তব্যে এসেগেছি। একটা লোহার উঁচু গেইট, ভিতরে পুলিশ পাহারায় রয়েছে। নেতৃবৃন্দ বললেন সবাইকে গেইটের সামনে বসে যেতে। আস্তে আস্তে পুরো মিছিল পৌঁছাতে সম্পূর্ণ এলাকা জনাকীর্ন হয়ে উঠেছিল। গেইটের ভিতরের লোকজনের সাথে নেতৃবৃন্দ কথা বলে জানতে পেরেছিলেন মন্ত্রীমশাই বাসায় নেই। আমরা সব মেয়েদেরকে বসানোর চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম কিছু অতি উৎসাহী ছেলেপুলে গেইট বেয়ে পার হবার চেষ্টা করছে। নেতৃবৃন্দ চেষ্টা করছিলেন তাদের সেখান থেকে নামিয়ে সামনে বসে অবস্থান নিতে। আস্তে আস্তে অনেকেই গেইটের সামনে রাস্তায় বসে পড়েছিলেন। আমরা বাকী সবাই যেন বসে যায় সে চেষ্টাই করছিলাম। সেখানে জলিল ভাই, রব ভাই, ইনুচাচা সবাই আমরা কাছাকাছি ছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ হলো, কিছু বোঝার আগেই লোকজন দৌড়াতে শুরু করেছিল। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য ছিল, আমরা আমাদের চোখের সীমানায় শুধুই আমাদের মানুষজন দেখেছি, কোন পুলিশ বা রক্ষীবাহিনী কিছুই চোখে পড়ার উপায় ছিল না। বাবা ‘৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে যেভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং – এটাই বলে গোলাগুলির মধ্যে ছোটাছুটি না করে শুয়ে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু শোব কোথায়, মানুষ আর মানুষ, সেখানে শুয়ে পড়লে যে মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যাব। ইনুচাচা,আমি, লিনু, বানু, মিথুন মন্ত্রীর বাসভনের ডানদিকে ফুটপাত ধরে ছুটতে শুরু করলাম, ছুটতে ছুটতেই বলাবলি করলাম রাস্তায় না শুয়ে দেওয়ালের সাথে ঘাসের উপর শুয়ে পড়াটাই শ্রেয়। সামনে জলিল ভাই, রব ভাই, মমতাজ আপা ওনাদেরকে ছুটতে দেখলাম। ছুটতে ছুটতে খুঁজছিলাম কোন জায়গায় শুয়ে পড়া যায়। যেখানে ডান দিকে রাস্তা গেছে, রাস্তার কোনায় দেওয়ালের কোনাটা পেরিয়ে ঘাসের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। জলিল ভাইয়ের বা পাশে আমি, ডানপাশে লিনু, আমার বাদিকে রব ভাই, রব ভাইয়ের বাপাশে মমতাজ আপা। ইনুচাচাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না, বানু আর মিথুন লিনুর ডান পাশে কিছুটা দূরে। যে যেখানে পারছে শুয়ে পড়ছিল। ওদিকে গুলি চলছিল লাগাতার। হঠাৎ জলিল ভাই ক্ষেপে উঠলেন, মাথা তুলে চিৎকার করে বললেন,” I am Major Jalil speaking. Stop firing. Stop firing.” আমি আর লিনু দুপাশ থেকে জলিল ভাইয়ের মাথা চেপে ধরেছিলাম, বলেছিলাম,”জলিল ভাই, করেন কি? দেখছেন না, কিভাবে বৃষ্টির মত গুলি আসছে, আপনি এভাবে মাথা তুললে তো খুলি উড়ে যাবে। আর এত গুলির শব্দের মাঝে আপনার কথা ওদের কাছে তো পৌঁছাবে না।” জলিল ভাই শান্ত হলেন, মনে হয় আমার কথায় তিনি অনুধাবন করেছিলেন ওনার এমনটা করা উচিৎ নয়।
এভাবে কতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে ঘাসের উপর শুয়েছিলাম বলতে পারবো না। অজস্র গুলি আসছিলো, দেওয়াল ঝাজরা হয়ে যাচ্ছিল। আমরা ফুটপাথের একটু নীচে ঘাসের উপর বলে হয়তো গুলিবিদ্ধ হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিলাম। এক সময় গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। লিনুর ডানপাশে যে তরুণ শুয়েছিলেন, তিনি উঠলেন না। তাকে লিনু বা আমি কেউ চিনি না। জলিল ভাই দেখে বলেছিলেন,” ও তো জাফর, আমাদের বরিশালের জাফর।” জলিল ভাই, রব ভাই, মমতাজ আপা, ইনুচাচা, বানু, মিথুন সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল। যারা ঘাসের উপর এদিক ওদিক শুয়েছিল তারা সবাই ধীরে ধীরে এসে জলিল ভাই, রব ভাইয়ের আশেপাশে রাস্তার কোনাটায় ফুটপাতে জড়ো হতে শুরু করেছিল। চারিদিকে রাস্তায় তাকিয়ে দেখলাম একদম শুনশান। একটু আগে যে রাস্তাগুলি জনাকীর্ন ছিল, এখন সেখানে কোন জনমানব নেই। দেখলাম উল্টা পাশে দূরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে ফুটপাতের পাশে রক্ষীবাহিনীর লরি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রক্ষীবাহিনীর সৈন্যরা উল্টা পাশের ফুটপাতে, রাস্তার মাঝখানের গোলচত্বরে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ভাবিনি আমরা আন্ডার এরেস্ট, আমি ভেবেছি গোলাগুলি শেষ আমরা এখন হেটে সামনে যেয়ে রিক্সা নিয়ে চলে যাব। কিন্তু রক্ষীবাহিনী আমাদের ঘিরে রাখলো। যতদূর বুঝেছি ওয়ারলেসে নির্দেশ আসছিলো আমাদের বিষয়ে। এর মধ্যে দুটো পুলিশের খালি ট্রাক আসলো। আমাদেরকে ঐ দুটি ট্রাকে উঠতে নির্দেশ দিয়েছিল রক্ষীবাহিনীর ওখানকার ভারপ্রাপ্ত অফিসার। আমরা যখন ট্রাকে উঠছিলাম, ইনুচাচাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম জাফর ভাই ঘাসের উপর শুয়ে আছে, ওনাকে তুলতে হবে। চারপাঁচ জন তরুণ ধরাধরি করে জাফর ভাইকে ট্রাকে তুলেছিল। আমরা ওখানে জাফর ভাইসহ ৩৩ জন ছিলাম। একজন ফটোগ্রাফার ছিলেন যিনি আমাদের সাথে একই ট্রাকে উঠেছিলেন। আমরা তখনও জানিনা আমাদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে। যখনই বোরহানউদ্দিন কলেজের সামনে দিয়ে নাজিমুদ্দিন রোডে উঠেছিল, বুঝতে পেরেছিলাম আমাদেরকে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পড়ন্ত বিকেলে আমাদের সহ দুটি পুলিশের ট্রাক কেন্দ্রীয় কারাগারের গেইটে এসে থেমেছিল। আমরা একে একে ট্রাক থেকে নেমে এসেছিলাম। নেমে দেখলাম বেশকিছু সাংবাদিক জেলের গেইটের সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর লিনু ইনুচাচাকে বুদ্ধি দিলাম আস্তে করে সাংবাদিকদের মধ্যে ঢুকে পড়তে। ইনুচাচা বলেছিলেন,” তোমরা দুজনও চলে আস আমার সাথে।” আমি উত্তরে বলেছিলাম,” ইনুচাচা, বেশীজন যেতে গেলে পুলিশের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আপনার এমুহুর্তে বাইরে থাকাটা প্রয়োজন। তাছাড়া বানু-মিথুনকে এখানে ফেলে রেখে আমি আর লিনু তো চলে যেতে পারবো না।” ইনুচাচা আস্তে করে সাংবাদিকদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, ইনুচাচা পিছন দিক থেকে সরে পড়েছিলেন। আমাদের বাকী সবাইকে জেলের প্রধান ফটক দিয়ে ভিতরে আনা হয়েছিল। ফটক দিয়ে ঢুকেই হাতের বায়ে দুতিনটি অফিস ঘর ছিল। ঐ খানে আমাদের সবাইকে আনা হয়েছিল। শেষের ঘরের একটি টেবিলের উপর জাফর ভাইকে রেখেছিল। আমরা কিন্তু চুপ ছিলাম না, ট্রাকে আসতে আসতে শ্লোগান দিচ্ছিলাম, জেলের অফিস ঘরও আমরা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে তুলেছিলাম। জাফর ভাইয়ের নিথর দেহ টেবিলে শুয়ে আছে। তারপরও আমরা চাইছিলাম ডাক্তার আসুক, পরীক্ষা করে বলুক তিনি বেঁচে নেই। জলিল ভাই, রব ভাই ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। আমরা যেয়ে বললাম,” জলিল ভাই, রব ভাই, আপনারা থাকতে জাফর ভাই কোন চিকিৎসা পাবে না?” জলিল ভাই তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে উঠে পাশের ঘরে পাহারারত পুলিশের কাছে হুকুম জারি করেছিলেন,”এক্ষুনি তোমাদের অফিসারকে ডাক। এক্ষুনি একজন ডাক্তার চাই, একজন আহত মানুষ রয়েছে আমাদের সাথে, তার চিকিৎসা দরকার।” কিছুক্ষণ পরে একজন অফিসার এসেছিল, সান্ত্বনা দিয়ে গিয়েছিল,” দেখি, আমি কি করতে পারি।” কিন্তু ওই পর্যন্তই, জাফর ভাইয়ের নিথর দেহ সারা রাত টেবিলেই পড়েছিল, কোন ডাক্তার তো দূরে থাকে কর্মকর্তারাও কেউ আসেননি।
ছোট দুটি ঘর, কয়েকটি টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার, জাফর ভাই বাদে আমরা মানুষ হলাম ৩১ জন। খাওয়া-দাওয়ার বালাই নাই, রাতটা কাটাব কি করে তারও কোন ব্যবস্থা নাই। যখন শক্তিতে কুলায় শ্লোগান দিচ্ছিলাম, যখন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না, টেবিলে, ফ্লোরে যেখানে জায়গা পাচ্ছিলাম বসে পড়ছিলাম। এমনি করে রাত কেটেছিল, আযান পড়েছিল, ১৭ই মার্চ পৌঁছে গিয়েছিল ১৮ই মার্চের দ্বার প্রান্তে।
– লুৎফা হাসিন রোজী, শিক্ষক, সাবেক রাজনৈতিক কর্মী