আশির দশকে দৈনিক সংবাদের সম্পাদক আহমেদুল কবির তাঁর এক কলামে অনুরোধ রেখেছিলেন, বাংলাদেশের তারুণ্যের জন্য বিয়ার-এর মতো খুশিজল উন্মুক্ত রাখতে। যাতে ১৮ বছর পেরিয়েছে এমন যে কেউ মন চাইলে এই পানীয় পান করতে পারে।
আহমেদুল কবিরের এই লেখা পড়ে মুখ টিপে হেসেছিলেন ক্ষমতা কাঠামোর ব্লু লেভেলের মওদুদ আহমাদেরা। এসব কথা কী কেউ প্রকাশ্যে বলে নাকি! রাতে ব্লু লেভেল খেয়ে স্বপ্ন দেখা যায়, ‘অমুক মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে হবে। কিন্তু সে তো স্বপ্নের গোপন রহস্য। ইসলামি ভোট ব্যাংককে জানতে হয়, রাষ্ট্রপতি বড্ড ইসলামের সিপাহসালার।
এই ঢাক ঢাক গুড় গুড়ে আশির দশক থেকে বাংলাদেশ ছেয়ে গেলো ফেনসিডিলে। কর্পোরেট জগতে কিংবা সিভিল সার্ভিসে যারা সুব্যবস্থাপনা দিতে পারতো; তারা টেনিসনের লোটাস ইটারদের মতো ফুলের মাঝে ঘুমিয়ে পড়লো ফুলের মধু খেয়ে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুবৃত্তটি ঝরে গেছে নানারকম ‘লোডস অফ সুইফট ডেভেলপমেন্ট(এলএসডি)-র নেশায়। ফেনসিডিল, হেরোইন, এক্সট্যাসি, কোকেন ইত্যদি নানা নেশায় চুর হয়ে তারা জীবন্মৃত বেঁচে রইলো। ফলে যারা বিসিএস গাইডের নেশায় বুঁদ থাকলো; সেই দ্বিতীয় বেঞ্চের গ্রন্থকীটেরা উঠে এলো ব্যবস্থাপনায়। তাদের কারো কারো আবার বেশি বয়েসে যৌবন আসায়; তারা ভোট ফর বোট ক্লাব তৈরি করে; সেইখানে প্রজাপতির আপিস বসিয়ে দিলো। যৌবনকালে পরীক্ষার পড়ায় নিমগ্ন থেকে বিগতযৌবনে হঠাত যৌবনের বান ডাকলে যে বিপদ হয়; সেরকম একটা বিপদের মধ্যে বাস করছি আমরা।
আরেকদল ইহজনমের স্বাভাবিকতা স্থগিত রেখে পরকালের ৭২ হুরের নেশায় এমন দিওয়ানা যে; তারা ‘খিলাফত প্রতিষ্ঠার’ নেশায় শরিয়াহ আইনের ফতোয়াবাজ হয়ে উঠলো। ফলে তাদের খুশি রাখতে এসে গেলো একসেস টু টেকাটুকা (এটুটু)-র ধর্মীয় অনুভূতির মডেল মসজিদের প্রকল্প। পলেস্তরা হাতের সঙ্গে উন্নয়নের রহমত হয়ে উঠে এলেও; তারা বিল বোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়, শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে সহমতের ইমান ধইরা রাখাই ধর্মীয় নির্দেশ।
আরেকদল ক্ষমতাসীন দলের ‘গান্ধা কইরা দেয়া’ ক্রিপি গ্যাং ফেসবুকে মদ খেয়ে মদের বোতলসহ ছবি দিয়ে ও মাতলামো করে স্ল্যাং ব্যবহার করে সমাজের সামনে প্রমাণ করে দিলো, মদ খাওয়া সত্যই হারাম হওয়া উচিত। সত্যিকার অর্থে এরকম পরিমিতিবোধহীন মদ্যপানের কারণে পবিত্র কুরানে ‘মদ জাতীয় নেশাদ্রব্য’ গ্রহণে নিরুতসাহিত করা হয়। নিরুতসাহিত করা মানেই নিষিদ্ধ করা নয়। যার পরিমিতি বোধ আছে; যে নামাজ পড়ার সময় সুরা ভুলে যায় না, যে পেটে দু’বিন্দু খুশিজল পড়লেই ‘নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনা’; তার জন্য পৃথিবীর কোন কিছুই নিষিদ্ধ নয়। নিজের শরীরের বা সামাজিক পরিবেশের ক্ষতি না করে মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে কী করবে না করবে; তার জন্য সে কেবল খোদার কাছে জবাবদিহি করে। ধর্মের কোন ম্যানেজার বা দেশপ্রেমের কোন ম্যানেজার ধর্ম ও দেশচর্চায় কাংক্ষিত নয়।
একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুর নাম, পরিমিতি। চাইলে পরিমিতির সঙ্গে বসে খুশিজল পান করা যায়, তার সঙ্গে নাচা যায়; তাকে ভালোবাসা যায়; তার জন্য নিবেদন করা যায় জগতের আনন্দযজ্ঞ।
পরিমিতি কাউকে মাতাল করে না; আর যে খোদার ধ্যানে; সত্য সুন্দর মঙ্গলের আকাংক্ষায় সতত খুশি; তার তো মাতাল হতে খুশিজলও লাগে না। এই যে নিসর্গ; তার মাঝে জীবজগতের অপার সৌন্দর্য্য; আর জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা মায়ার বন্ধন; যেখানে হাত বাড়ালেই বন্ধু; সেখানে এর চেয়ে বড় আর কোন নেশা আছে! আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ যার জীবনে।
একটা বিষয় তো স্বীকার করতেই হবে; গ্রামীণ সংস্কৃতির ‘ঢাক ঢাক গুড় গুড়, পাছে লোকে কিছু বলে; আর চট করে নিজে সাধু সেজে অন্যকে দোররা মারার বা পাথর ছোড়ার যে পঞ্চায়েতি; ধর্মীয় অনুভূতির ব্যবসা; এসবের পাঁচ পয়সা দাম নাই দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের জগতে।
পাকিস্তানে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে একে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ বলে ঘোষণা দেয়া হলেও; পাকিস্তানে পানীয় শিল্পের ঐতিহ্য প্রায় দেড়শো-দুশো বছরের। কাগজে কলমে সংখ্যলঘু ৫ শতাংশ। তারাই লাইসেন্স পান ওয়াইন কারখানা ও দোকান চালানোর। অথচ যে সংখ্যক মানুষ মদ পান করে তা ৭০ শতাংশের কম নয়। খুশিজল পানের হিসেবে পাকিস্তানে সংখ্যালঘু ৩০ শতাংশ মানুষ; যারা খুশিজলকে ‘নিরুতসাহিত করা পানীয় নয়; হারাম পানীয় বলে মনে করেন। ঠিক এ কারণেই আফঘানিস্তান থেকে আগত ‘পপি’ মাদকের ছোবল পাকিস্তানে আঘাত হানতে পারেনি। শহরগুলোতে প্রত্যেক মহল্লাতেই ওয়াইন শপ আছে পাকিস্তানে।
ভারতেও গড় পড়তা ৭০ শতাংশ মানুষই খুশিজল পরিষেবা করে। ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু (অর্থোডক্স বা কড়া হিন্দুত্ববাদী ও ইসলামপন্থী) খুশিজল পান থেকে বিরত থাকে। এরা কাশ্মীর থেকে গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, আসাম হয়ে মনিপুরে সাধারণ মানুষের রক্ত পান করে।
এইসব উগ্রধর্ম ও উগ্র জাতীয়তাবাদের দক্ষিণ এশীয় কসাই; যারা পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশে’ খুন-ধর্ষণ-গুম-ক্রসফায়ারের নেশায় রাক্ষস হয়ে উঠেছে; নিপীড়িত জনমানুষ যেন তাদের উদ্দেশ্যে বলে, কেন রক্তপান করো হে কেল্লার শাসক-শোষক-পরিতোষক-বিদূষক; তার চেয়ে বরং জীবনদায়ী খুশিজল পান করো।
কবি মির্জা গালিবকে খুশিজল পানে কড়া মোল্লারা বাধ সাধলে; তিনি বলেছিলেন, “খুশি জলের মাঝেই যদিই মাদকতা থাকতো তবে সারাক্ষণ বোতলই নাচতো। ”
লালন এসব কড়া অনুশাসনের বজ্র আঁটুনি আর ফস্কা গেরো দেখে এইসব কুচিন্তা আর কুতর্কের দোকানকে ‘কানার হাটবাজার’ বলেছেন। আবার উপহাস করে বলেছেন, জাত গেলো জাত গেলো বলে; একী আজব ‘অনুভূতি’র কারখানা।
অথচ কবি জালালুদ্দিন রুমী যখন বলেন, কষ্টকে ভয় পেয়োনা; কষ্ট পেলে শরীরের মাঝে আলোক প্রবেশ করে। এই দর্শন ভাবনাতে এমন মাদকতা আছে যে, ঘূর্ণায়মান নৃত্যের আবহ তৈরি করে সে ধামাল ছন্দের খুশি-আনন্দ-খোদার নৈকট্য লাভের; পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার মিলনের আকুতি।
তাই বুঝি লালন গেয়েছেন, মিলন হবে কত দিনে; আমার মনের মানুষেরই সনে।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া