ডাজাফরুল্লাহ চৌধুরীর লন্ডনের বিলাসী জীবন তাঁর জীবনের পরবর্তী পথ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো বলে মনে হয়। দামী গাড়ির শখ কিংবা ফ্লাইং ক্লাবে উড্ডয়নের শখপূরণের পর বিলাসী জীবনের মোহ তাঁর মধ্যে আর ছিলো না। এ কারণেই উচ্চাভিলাষ শব্দটি তাঁর অভিধানে ছিলো না। ফলে দেশপ্রেম তাঁর জীবনে অর্থবহ হতে পেরেছে।
বাংলাদেশে দেশপ্রেম করা হচ্ছে বিলাসী জীবন লাভের একটা ছুঁতো। এ কারণে যারা দেশপ্রেম করে খায়; তাদের চিন্তার গজফিতায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দেশপ্রেম মাপামাপি করা বেশ কঠিন। পলিটিক্যাল লিলিপুটদের চোখে তিনি তাই ছিলেন রঙ হেডেড।
সাধারণ মানুষ; যারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে খায়; দেশের জন্য বুকের গভীরে ভালোবাসা লালন করে; জাফরুল্লাহর মৃত্যু তাদের কাছে মনের মানুষের চলে যাওয়া।
আর দলীয় ফুটসোলজারদের কাছে; কতটুকু শ্রদ্ধা জানাবো; কতটুকু নিন্দা জানাবো তার কুঞ্চিত মাপামাপি।
আসলে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কারখানায় সমর্থকদের জন্য যে মাপের জুতা তৈরি হয়; জাফরুল্লাহ’র পায়ের মাপ তার চেয়ে অনেক বড় ছিলো।
পাকিস্তান উপনিবেশের পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে সেই যে তিনি মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়লেন, আমৃত্যু তিনি সেই মুক্তির যুদ্ধে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য গড়ে তোলা ফিল্ড হাসপাতালের জাদুঘর হিসেবে রয়ে গেছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সাধারণ মানুষের সেবা দেবার জন্য এই কেন্দ্রটি নিরলস কাজ করে চলেছে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বুঝেছিলেন, যে সংগ্রাম ছিলো মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম; তা কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতার অর্জনের যুদ্ধেই শেষ হয়ে যায় না। মানুষের মুক্তির সংগ্রাম মানে একটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া।
উচ্চাভিলাষ না থাকায়, একদলীয় শাসনের অংশ হতে চাননি, সামরিক শাসকদের দেয়া মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্যনীতি ও ওষুধ নীতি তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
জাফরুল্লাহ’র তৈরি জননীতি যাদের ব্যবসার পেটে লাথি দিয়েছে; তাদের চোখে তিনি ছিলেন রঙ হেডেড। স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের পলিটিক্যাল ফুট সোলজাররা জাফরুল্লাহর তৈরি নীতিকে গণবিরোধী নীতি বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
কিন্তু তাঁর তৈরি ওষুধ নীতিটি কালক্রমে ঠিকই দেশজ ঔষধ তৈরি শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু জনমানুষের জন্য প্রয়োজনীয় একটি স্বাস্থ্যনীতি আজো গড়ে ওঠেনি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের জনবিরোধী বাধার মুখে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় লক্ষ্য করেছেন, পাকিস্তান উপনিবেশ তাড়ানো গেলেও দেশের মধ্যে গড়ে উঠেছে অলৌকিক এক অলিগার্ক উপনিবেশ। কিছু পরিবার আর তাদের লেঠেলরাই এই উপনিবেশের মালিক। নিজভূমে পরবাসী দেশের মানুষ। অলিগার্ক উপনিবেশের শৃংখল ছেঁড়ার জন্য মুক্তির এই ডাক্তার চব্বিশ ঘন্টা সক্রিয় থাকতেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অলিগার্ক উপনিবেশের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত চ্যাট জিপিটিগুলো এই ডাক্তারকে নিয়ে অযাচিত কথা বলেছে; ভেবেছে “ডাক্তাররে” গান্ধা কইরা দিছি।
ঠিক সে সময় সত্যজিত রায়ের গণশত্রু চলচ্চিত্রের মুখ্যচরিত্র ডাক্তারটির সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে ডা জাফরুল্লাহর।
স্বাধীন দেশে তাঁকে “মাছ চুরির” পরাবাস্তব মামলা দেয়া হয়েছে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির শীর্ষ নেত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে আওয়ামী লীগঘন সংস্কৃতি পুরোহিতেরা তাঁর প্রগতিশীলতার পৈতে কেড়ে নিতে সচেষ্ট থেকেছেন। কারণ প্রগতিশীল হতে গেলে কেবল আওয়ামী লীগের গতির জন্য ক্রিয়াশীল থাকতে হয় এই বিজন চিন্তাগ্রামে।
বিএনপিতেই আবার অর্ধশিক্ষিত তরুণ নেতৃত্ব আছে, যেখানে বাস করে স্যার ডাক শোনার আকুতি। প্রবীণদের সম্মান জানানোর পরিবর্তে অধীনস্থ ভাবার রাজরোগ আছে। জাফরুল্লাহ তাই তরুণ নেতৃত্বকে আবার স্কুলে ভর্তি হয়ে শিক্ষিত হয়ে আসার পরামর্শ রেখে বিএনপির নেত্রীর উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। বিএনপি কারখানায় তৈরি জুতার চেয়ে জাফরুল্লাহর পায়ের মাপ বড় এতো জানা কথা।
সবশেষে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মঞ্চে সক্রিয় থেকেছেন গরীবের এই ডাক্তার।
আমরা যারা প্রতিশোধ চিন্তায় ক্ষিপ্ত হয়ে ঘুরি; তাদের পক্ষে গান্ধীজীর অহিংস আদর্শ, কিংবা বঙ্গবন্ধুর ক্ষমার আদর্শ বোঝা প্রায় অসম্ভব। ফলে জাফরুল্লাহ’র শত্রুকে ক্ষমা করে দেবার দর্শন আমাদের পক্ষে বোঝা হয়তো সম্ভব নয়। প্রিয়াংকা গান্ধী ও রাহুল গান্ধী তাদের পিতার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয়ায়; আমরা স্তম্ভিত হয়েছি। ভাবতে শুরু করেছি, কিছু মানুষের জীনগত বৈশিষ্ট্যে ও চিন্তায় বিশালতা থাকে। আমাদের চোখের বদলে চোখ নেয়া অন্ধ সমাজের পক্ষে সেসব ঔদার্য্যের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা কঠিন।
আমরা হচ্ছি ফেসবুকের দলীয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের গোলাম। আমরা যা বুঝবো না; তা নিয়ে দাঁত বের করে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসবো।
জাফরুল্লাহ’র ঔদার্য্য, সরলতা, মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সতত সক্রিয় থাকার যে অনুপ্রেরণা; নতুন প্রজন্মের জন্য পথের দিশা দেয়। একটা খেলনা জীবন যাপন করে; বিত্ত বৈভবের ইঁদুর দৌড়ে দিশাহারা হয়ে দৌড়ে চলার যে সময়, যেখানে মোটিভেশনাল স্পিকার এসে প্রতিনিয়ত সিক্স ডিজিটের কথা মনে করিয়ে দিয়ে চিন্তাজগতটাকে সংকীর্ণ করে দেয়, সেখানে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঝটকা টানে নিয়ে যান মানুষের জন্য উতসর্গ করা অর্থপূর্ণ জীবনের মোহের দিকে।
ফেসবুকের লাশকাটা ঘরে দলীয় শব কর্মীরা জাফরুল্লাহ’র শব ব্যবচ্ছেদ করলেও; বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ এক যোগে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অফ অনার দিয়েছে।
যারা এই বিশাল হৃদয় মানুষের বিরুদ্ধে “মাছ চুরির মামলা” দিয়েছিলো; তাদের সহকর্মীদের দেয়া গার্ড অফ অনার, কিংবা আওয়ামী লিগের কৌশলী শোক বার্তা, কিংবা বিএনপির দেরিতে দেয়া কৌশলী শোক বার্তা দেখে মনে হয়, জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে গেলে ফুল।
নতুন প্রজন্মের যারা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন, দেশের কথা-মানুষের কথা ভাবছেন; তাদেরকে অলিগার্ক সমাজের কথিত রাইট হেডেড না হয়ে জাফরুল্লাহ’র মতো রঙ হেডেড হতে হবে। রাইট হেডেড লোক মারা গেলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আর রঙ হেডেড মানুষ মারা গেলে শোকের ও স্মরণের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরী কখনোই সাবেক মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাননি, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছেন; নতুন প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন সংগ্রামী জীবনের অনুপ্রেরণা; যে জীবন ফুরায় না মৃত্যুতে।