আমার পূর্বজ চৌদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ চিত্রশিল্পী বা লেখক ছিলেন বলে আমার অন্ততপক্ষে জানা নেই। তবে মায়ের পক্ষের আত্মীয় দু-একজন পুরুষ ছিলেন প্রতিভাবান। খুব স্মার্ট একজন ভদ্রলোক কালেভদ্রে সিলেটের সুনামগঞ্জ থেকে কুমিল্লায় আসতেন। দীর্ঘ সুঠামদেহী কোট-প্যান্ট পরে আসতেন। খুব চৌকস ইংরেজিতে কথা বলতেন বাবার সাথে। দু-একদিনের বেশি থাকতেন না। আজ আর নাম মনে নেই তাঁর, আমার শৈশবে দু-তিনবার দেখেছিলাম। আমার জন্য লেইস চকোলেট নিয়ে আসতেন। তখন ট্রেনের মধ্যে হকাররা বিক্রি করতেন। খুব জনপ্রিয় ছিল শিশুদের কাছে। সেই দীর্ঘাঙ্গী মামা খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। কলকাতা বেতারে বাঁশি বাজাতেন। একবার আসামের কামরূপ কামাক্ষ্যায় গেলে পরে আর ফিরে আসেননি। এমন সুদর্শন বংশীবাদককে কোনো উর্বশী জাদুকন্যা জাদু করে রেখে দিয়েছেন বলে মা মাঝে মাঝে বলত।
আর প্রতিভাধর ছিলেন মায়ের এক জ্যাঠাত ভাই সংস্কৃত পণ্ডিত নীহার সরকার, তিনি সংস্কৃত ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। লিখতে পারতেন। তিনি হবিগঞ্জ হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মাঝে মাঝে কুমিল্লায় এলে গান গেয়ে শোনাতেন। খুব ভালো আধুনিক বাংলা গান তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। আর ছিলেন সিনেমাপাগল। সাহেবদের মতো কোট-প্যান্ট পরতেন। রুচিবোধও ছিল উন্নত। কৈশোরে তিনি ছিলেন আমার ফ্যাশন-কুশনের আইকন।
আর বর্তমান প্রজন্মে আমার অনুজ পীযূষ কান্তি সরকার ভালো লেখে এবং গ্রাফিক ডিজাইন করতে পারে। কিন্তু সিরিয়াস নয়, একটিভও নয়।
বাবার দিকের কয়েক পুরুষই চাষাভুষা। আমিও দেশে থাকলে এতদিনে চাষাভুষাই হতাম। আমার কোনো প্রতিভা-টথিভা নেই। ছিলও না কোনোকালে। সাদামাটা খেয়ালি মানুষ আমি। যখন যা ভালো লাগে তাই করে থাকি, ভালো হোক আর মন্দ হোক।
মানুষ পত্রিকা, ম্যাগাজিন তৈরি করে। তাই দেখে আমিও ছাত্রজীবনে দু-তিনটি ম্যাগাজিন তৈরি করেছি। কেউ কেউ ছড়া লেখে, তাই দেখে আমিও লিখে ফেলেছি। স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম জাপানে প্রকাশনা ব্যবসা করব বলে। একটি উন্নত মানের কাগজ প্রকাশ করব। যা ভাবা তাই করা। নো হাউ শিখে, বাকিটা দেখে দেখে একদিন ঠিকঠিক পত্রিকা তৈরি ফেললাম “মানচিত্র” নামে।এরপর গানের সিডির কভার, বড়মাপের পোস্টার, হ্যান্ডবিল, স্মরণিকা, টিকিট, ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ, বইয়ের প্রচ্ছদ এক এক করে করে ফেললাম! তাই দেখে জাপানি গ্রাফিক ডিজাইনরা প্রশংসা করলেন আমিও খুশি হলাম। সবচে বেশি প্রশংসা করেছে আমার স্ত্রী নোরিকো। ব্যস্ তাতেই আমি নিশ্চিন্ত মনে উৎরে গেলাম। সে খুব সুন্দর ছবি আঁকে। রং আর অঙ্কন পদ্ধতি সম্পর্কে তার ধারণা খুব স্বচ্ছ এবং আকর্ষণীয়। “মানচিত্র” ম্যাগাজিনের অনেক প্রচ্ছদ আমার নিজের তৈরি।কোনেটাই মন্দ হয়েছে বলে শুনিনি। আসলে সৃজনশীলতা এবং ফ্যাশনের কোনো সংজ্ঞা নেই, এটা স্বতন্ত্র চিন্তা, আইডিয়া, দর্শন, মেজাজ আর রুচিবোধের একটি সমন্বিত ভারসাম্যতার খেলা মাত্র।
“মানচিত্র” ২০০২ সালে বন্ধ করে দিলাম। শিশুদের সংবাদপত্র “কিশোরচিত্র” প্রকাশের পরিকল্পনা করছি। সেই সময় ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে ফিরে এলে পরে বেকার দিন গুজরান করছি। শরীরও তেমন ভালো যাচ্ছে না হাইপার টেনশনের কারণে। ১২ বছর “মানচিত্র” নিয়ে অমানুষিক খাটাখাটুনির ফল এটা।
একদিন জাপানপ্রবাসী বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ডাঃ শেখ আলীমুজ্জামান ভাইয়ের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে দেখা হলে বললেন, কী করছেন এখন?
আমি বললাম, আপাতত বেকার। একটি পরিকল্পনা অবশ্য আছে। কাজ চলছে। কেন বলুন তো?
আমার এক অনুজপ্রতিম ব্যবসায়ী সানাউল হক একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছেন নাম দশদিক। গ্লোসি কাগজে ছাপা ১০০ পৃষ্ঠার সম্পূর্ণ রঙিন কাগজ। তিনি একজন সম্পাদক খুঁজছেন কাগজটি যাতে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। আপনি তো আর এখন “মানচিত্র” প্রকাশ করছেন না। দশদিকের দায়িত্ব নেন না কিছুদিনের জন্য! কাজগুলো স্টাফদের শিখিয়ে দিলে পরে তারাই রান করাতে পারবে।
আলীম ভাইয়ের কথা ফেলতে পারলাম না। স্ত্রীকে বললে পরে সে বলল, আবার নিউজ ম্যাগাজিন সম্পাদনা করা! প্রেসারের তো আরও খারাপ অবস্থা হবে। কিন্তু আলীম সান যখন অনুরোধ করেছেন তাঁর কথাও রাখা কর্তব্য। তিনি তোমাকে সম্মান করেন।
আলীম ভাইয়ের মাধ্যমেই সানাউল হক তথা এক তরুণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে আকিহাবারা তার অফিসে সাক্ষাৎ করি। টাঙ্গাইলের ছেলে বেশ চৌকস। চুক্তিমাফিক দুবছরের জন্য মাসিক “দশদিক” ম্যাগাজিনের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব নিলাম। সম্পাদকীয় দপ্তর টোকিওতে, কাগজ ঢাকায় ছাপা হয়ে জাপানে আসে। প্রথম সংখ্যাটি আমাদের সবার সুপ্রিয়, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন ভাই সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন। কোনো কারণে তিনি আর করতে পারেননি। ফলে আমাকেই নতুন এই প্রকাশনাটির ডিজাইন, লেআউট, সম্পাদনা এবং নিয়মিত কয়েকটি বিভাগ লেখা দিয়ে সাজানোর দায়দায়িত্ব নিতে হল। প্রধান সম্পাদক সানাউল হক ব্যবসা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। তিনি আমাকে একটি অফিসও নিয়ে দিলেন তার অফিসের কাছেই। নিরিবিলি কাজ করি সেখানে ডেস্কটপ কম্পিউটার, স্ক্যানার, কপিয়ার ইত্যাদির সমন্বয়ে। যেহেতু কাজ জানা আছে কোনো সমস্যা নেই। ঢাকায় বেশ কয়েকজন স্টাফ। সবাই ঝকঝকে মেধাবী তরুণ। এদের মধ্যে গ্রাফিক ডিজাইনার এস এ ফারুক। নবীন শিক্ষানুরাগী। কিন্তু কাজগুলো বেশ কাচা। তাকে প্রতিদিন নানাভাবে নির্দেশনা দিয়ে, মাঝে মাঝে রাগারাগি করে ডিজাইনের কাজ শেখালাম। এখন সে বাংলাদেশে প্রচারশীর্ষ “দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন” এর অন্যতম প্রধান গ্রাফিক ডিজাইনার। গর্ব অনুভব করি।
“দশদিক” এর দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ করেছিলাম। এটা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অনেকেই মনে করেছেন ঢাকায় মনোরেল চালু হয়ে গিয়েছে বুঝি! অথচ এটা ছিল কম্পিউটারে সুপার কম্পোজকৃত গ্রাফিক ডিজাইন মাত্র।
মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, জাপানের একজন খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ তখন সাংসদ ইতোও কোওসুকে স্যারের একটি ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম সংসদ ভবনে তাঁর অফিসে। নিয়ে গিয়েছিল আমার জাপানি সাংবাদিক বন্ধু য়োশিজাওয়া মাকোতো সান। ইতোও সেনসেই (স্যার) ম্যাগাজিনটি দেখে অবাক হয়ে বললেন, আরে! ঢাকায় কি মনেরেল চালু হয়ে গেছে! কবে?
আমি হেসে বললাম, না স্যার। এটা প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের জন্য একটি ডিজাইনকৃত ইমেজ। এখনো চালু হয়নি।
তিনি তখন বুঝলেন এবং হেসে বললেন, ও আচ্ছা। আচ্ছা। হবে। হবে। পরিকল্পনা চলছে জাপানের সঙ্গে। বাস্তবায়িত হবে। বাংলাদেশ এশিয়ার উদীয়মান শক্তি। নতুন সম্ভাবনা। সবাই মিলে লড়াই করো তোমরা! সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়!
ইতোও স্যারকে খুব মনে পড়ে। অনেক দিন দেখা হয় না।
“দশদিকে” যতদিন ছিলাম কাজ করে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। কাগজ যদি বহুরঙা হয় তাহলে কত রকমের ডিজাইন এবং সাজসজ্জা যে করা যায় “দশদিকে” করা কাজগুলোই তার উজ্জ্বল প্রমাণ। ম্যাগাজিন কালচার বলে কথা! কাজ করতে করতে নতুন নতুন আইডিয়ারও জন্ম হয়। এই সোনালি সুযোগটা করে দেবার জন্য শেখ আলীমুজ্জামান এবং অনুজপ্রতিম বন্ধু সানাউল হককে জানাই অশেষ অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
মাসিক দশদিক এর জয় হোক!
প্রবীর বিকাশ সরকার: জাপান প্রবাসী লেখক