১৯৮৯ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথায় লাল ফেটি বেঁধে কয়েকদিন ‘প্রতিরোধে প্রতিশোধ; জাসদ জাসদ’ বলে বেড়াচ্ছি। টিএসসিতে বিতার্কিকদের আড্ডায় সাত টাকায় পোলাও খেয়ে সারাদিন সমাজ পরিবর্তনের জন্য তাপিত হই আমরা। ‘স্বকালের জগদ্দল পাথরের বিপরীতে প্রমিথিও প্রজন্মে’র ব্যারিকেড রচিত হচ্ছে। সেখানে বুয়েট-ডিএমসির বন্ধুরাও আসে।
এক্স ক্যাডেটরা স্পন্দন নামে একটা ঘোঁট পাকায়। স্পন্দন একুশে বইমেলায় স্টল নেয়। মামুন, নঈম, হানিফ, মেহদী, কাজী মাহবুব গড়ে তোলে শৈল্পিক এই কারু গৃহ। আমাকে দিয়ে কোন কায়িক পরিশ্রম হয় না। তবু বুদ্ধিজীবী কোটায় আমাকে রাখা হয়। জাহানারা ইমাম এসে চেয়ারে বসে কিছুটা সময় কাটান। আমি উনার প্রটোকল করি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির লিফলেট বই ক্রেতাদের বইয়ের মাঝে দিয়ে দিই। মেহেদী ডেইলি স্টারের সৌজন্য সংখ্যা উপহার দেয় বইক্রেতাদের।
ক্রেতার চাপ কম থাকলে টেবিলের নীচে শুয়ে শাহরিয়ার কবিরের শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা গ্রন্থ পড়ি। মাঝে মাঝে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের বন্ধু ইলোরা আসে। ওর সঙ্গে একটু ঘুরি; ওর আব্বার লেখা একটা ইংরেজি বই স্পন্দনের স্টলে রেখে বিক্রি করি। মাঝে মধ্যে এষা আসে। ওর সঙ্গে বটমূলে বসে ঝগড়া করি। এগিয়ে দিয়ে আসি রিক্সা পর্যন্ত।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের লিফলেটও থাকে আমাদের স্টলে। আহকাম-পরাগদের মৃত্যুঞ্জয়ী স্কোয়াডের তৈরি; মুক্তিযুদ্ধের ইনস্টলেশন স্টলের পেছন দিকে। ওখানে গিয়ে আহকামের সঙ্গে গল্প করি। পরাগের সঙ্গে খুনসুঁটি করি।
ছাত্রজীবনটা এমন করেই প্রত্যেক বছর বইমেলার জন্য অপেক্ষা করি। কবি বন্ধু ইফতেখার দেখায়, আফজাল হোসেন আর ইমদাদুল হক মিলন যৌথ গ্রন্থ লিখেছেন। ইফতেখারের উদ্যোগে ওর কবিতাগ্রন্থ আর আমার গল্প গ্রন্থ ‘দরথী’ প্রকাশিত হয়; একুশ বছর বয়সে। গুলতেকিন আপা আমাদের ব্যাচে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছেন। উনি হুমায়ূন আহমেদকে স্পন্দনে নিয়ে আসেন। মামুন উনাকে আমার দরথী গছিয়ে দেন। টাকাটার শ্রাদ্ধ করে উনি আমার অটোগ্রাফ নেন। উনি বলেন, এভাবেই হবে।
আমি কিন্তু নিজের ওপর বিরক্ত এই বই লিখে। কারণ ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট সেমিনারে বসে বন্ধু রুখসানা বলে, ‘আব্বা পড়ে বললেন, এই ছেলে ভালো লেখে; কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কিচ্ছু হয়নি।‘
নাঈম বোঝায়, গল্পগুলো তো ভালো রে; আমরা তোর কাব্যগ্রন্থ বের করবো। মামুন আমার ডায়েরি থেকে টুকে টুকে পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে সাহায্য করে ওর মিরপুরের বাড়িতে; সারারাত জেগে। রম্য রহিম প্রচ্ছদ করলেন। কিন্তু উনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বইটা বের হলো না। কারণ নঈম উনাকে প্রকাশনার দায়িত্ব দিয়েছিলো অনেক অনুরোধ করে।
হতাশায় ভেঙে পড়লাম। এষা এসে বোঝালো, ‘লেখকদের জীবন তো রুপকথা হয় না পাভেল।‘ বর্ধমান হাউজের সিড়িতে বসে, কবিতার ডায়েরি থেকে আমার কবিতা পড়ে শোনায়। রশীদ হায়দার পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় স্নিগ্ধ হাসিতে প্রশ্রয় দেন খানিকটা।
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ না হবার দুঃখে কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি বলে, বিষণ্ণতার শহর লিখতে শুরু করলাম।
পরের মেলায় বিচূর্ণীভাবনার গ্রন্থ বিষণ্ণতার শহর প্রকাশ করলো; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাহমুদ-মাছুদ আর আমার ছোট ভাই রুবাইয়াত মিলে তাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে। প্রচ্ছদ করলো বন্ধু অঞ্জন। স্পন্দনের স্টলে আবার এই বই পুশ সেল শুরু করলো, মামুন। মেহদী অন্য কিছু স্টলেও। আবুদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারও একটা কপি নিলেন। দুদিন পর ডেকে বলেন, মশহুর মাসকাওয়াথ; বিস্ত্রস্ত জার্নাল বেশ হয়েছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে মাঝে মাঝে এসো; আড্ডা দেবো আরও।
আমি এসময় আবুল হাসানের ভক্ত; তার বই আউট অফ প্রিন্ট; হন্যে হয়ে খুঁজতাম সারা মেলা। বাংলা একাডেমির মাঝখানে শুকনো পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবুল হাসানের বই বের না হবার আক্ষেপে ভাবতাম; বেস্ট সেলার না; আউট অফ প্রিন্ট হতে চাই। যেন আমার বয়েসী কোন তরুণ এসে এভাবে খোঁজে আমায়।
তসলিমা নাসরিন, হুমায়ূন আজাদ আমাদের স্টলে এসে বসতেন। উনাদের বই আমরা বিক্রি করতাম। একদিন সাঁঝে কী যেন হলো; মেহেদী বললো, ‘তসলিমা নাসরিনের বই লুকিয়ে ফেল কুইকলি।‘ পুলিশকে দেখলাম, উনাকে ঘিরে নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যেতে। সেই শেষ দেখা।
বইমেলাটা একটা পরিবারের মতো; প্রতিদিন ছড়াকার রিটন ভাই, মইনুল আহসান সাবের, আনিসুজ্জামান স্যার, এক ঝলক শাহরিয়ার কবির, নাসরিন জাহান, আনিসুল হক ভাইকে না দেখলে ভালো লাগতো না। চকিতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল মকসুদ, সরদার ফজলুর করিম, তালুকদার মনিরুজ্জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম; সাঁঝে বর্ধমান হাউজের সার্চ লাইটে জাদুবাস্তব মায়া তৈরি হলে; মনে হতো যেন বাংলাদেশের সোনালী যুগের জাদুঘর এটা। তাই প্রত্যেক বছর বইমেলা শেষ হবার দিনটিতে মনের মধ্যে করুণ সুর বাজতো। আহারে এই স্বপ্নের মানুষগুলোর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হবে না। ফরহাদ খান সমাপনী ঘোষণা দিলে; আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতাম স্পন্দনের স্টলে টেবিলের নীচে সবুজ ঘাসের গালিচায়।
১৯৯৬ সাল থেকে বইমেলায় যেতাম বাংলাদেশ বেতারের বইমেলা কাভার করতে যাওয়া রেডিও জার্নালিস্টদের সুপারভাইজ করতে। হুমায়ূন রেজা, মাশুক ভাই, পান্না ভাই, সাইদ, দীপুর সঙ্গে ঘাসে বসে আড্ডা দেবার সময়, বেতার সাংবাদিকরা কেউ একটু ডাকতে এলে রেজা বিরক্ত হতো। মাশুক ভাই জিজ্ঞেস করছিলেন, কোথায় যাচ্ছো! রেজা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘প্রফেশনাল হ্যাজার্ড, বিসিএস হয়েছে না!’
যারা এতোদিন শার্ট ওপরে দিয়ে আড়ং-এর স্যান্ডেল পরে দেখে এসেছে; তারা শার্ট টাক ইন করে জুতো পরা দশা দেখে একটু অবাক হতো। আমিও যেন একটু একটু করে প্রতিষ্ঠান বিরোধী থেকে প্রতিষ্ঠানের মানুষ হয়ে উঠছিলাম।
তবে হুমায়ূন আজাদের মতো প্রতিষ্ঠান বিরোধী কেউ সরকারী মিডিয়ায় ইন্টারভিউ দিতে রাজি না হলে; তখন আমাকে ডাকতো রেডিও-র সাংবাদিকেরা। আজাদ স্যার বলতেন, ‘পারবে এডিট না করে চালাতে?’ আমি কনফিডেন্টলি বলতাম, ‘পারবো স্যার।‘ হুবহু প্রচার করে দিলে পরে স্যার শিশু মতো হাসতেন।
দু’হাজার সালে মৃত্যুর শহর উপন্যাস করলেন পড়ুয়ার কাজল ভাই। হুমায়ূন রেজা ভোরের কাগজে বিষণ্ণতার শহর ছেপে পরিচিত করে দেয়ায়; তখন আমি প্রতিষ্ঠিত লেখদের মুখভঙ্গী কপি করে; পাঠকদের অটোগ্রাফ দিতে শুরু করি। স্টলে সায়কা,ফারহানা, কাজল ভাইয়ের সামনে পাঠকের উচ্ছ্বাসের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা লজ্জাই লাগতো। আনিসুল হক ভাই নিজের পকেট থেকে খুলে একটা কলম দিলেন অটোগ্রাফ দেয়ার জন্য। সুমনা শারমীন আপা বললেন, লজ্জায় মুখ লাল করিস কেন, এখন তো অটোগ্রাফ দেয়া শুরু হলো তোর। মাঝে মাঝে সাইদ এসে বাইরে থেকে মুচকি হাসতো। ওর হাসির অর্থ, শালা বড় লেখক হয়েছিস! দীপুও পাশে দাঁড়িয়ে মজা নিতো; রেজাও তার দীর্ঘ কবিতা গ্রন্থের অটোগ্রাফ দিতো। সাইদ-দীপু আছে কীনা দেখে নিতো লুকিয়ে। মুনির রানা আমাদের বলতো, ‘দে দে, ভালো করে অটোগ্রাফ দে।‘ বাংলা একাডেমীর কল্পনা আপা অনেক স্নেহ করতেন। মাইকে বার বার ঘোষণা করতেন, ‘মৃত্যুর শহরে’র নাম। আমার উপন্যাসে অভিষেকের খবর।
পরের বছর সাম্য আহমেদ বিষণ্ণতার শহর প্রকাশ করলো; জনান্তিক থেকে; ফলে আমি একবার পড়ুয়া একবার জনান্তিক করি। মাঝে মাঝে লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে দীপের কাছে যাই; রেজার ‘অর্জুন’ সেখানে বিক্রি হয়।
২০০২ সালে ডয়চেভেলেতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম; ফলে আবদুল্লাহ আল ফারুক ভাইয়ের জন্য ইন্টারভিউ পার্টনার ম্যানেজ করতে ব্যস্ত হলাম। জাফর ইকবাল স্যার, আতিউর রহমান, আনিসুল হক, রফিক আজাদ, আমি তাঁদের ফারুক ভাইয়ের কাছে নিয়ে আসতাম। ফারুক ভাইয়ের বন্ধু ফরহাদ খান। আমাকে ইনট্রোডিউস করলে ফরহাদ খান বিস্মিত হন, উনি বলেন, আমি তো বিষণ্ণতার শহর পড়ে ভেবেছিলাম; আমাদের বয়েসী কেউ।
সেবছর আমার আকাংক্ষার শহর উপন্যাস বেরিয়েছে। সেটা আমার আকাংক্ষার শহর ঢাকা ছেড়ে যাবার বছর। পরেরবার তাই জার্মানি থেকে লিখে পাঠালাম, ওপারে ভাসালে ভেলা।
২০০৮-এর বইমেলায় ফিরলাম বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের মোবাইল নিউজরুম নিয়ে। লিটল ম্যাগ উঠোনে; আমার এসব হাইটেক কেরামতি দেখে, মাহবুব লীলেন এসে ঝাড়ি দিলেন, ‘আপনি তো ক্যাপিটালিস্ট এমেরিকার মতো; আমাদের পরিবেশটা নষ্ট করতে এসেছেন।‘ দীপ তখন পেছন থেকে বললো, ‘না না উনি সোশালিস্ট; উনি আমাদের লোক।‘
জনান্তিক সেবার ইংরেজি গল্পগ্রন্থ মঙ্গা ক্যারাভান প্রকাশ করেছে; সাম্য ক্রেতাদের বিডিনিউজ স্টলে পাঠাতেন অটোগ্রাফ নিতে। মারুফ রায়হান ভাই, সুযোগ পেলেই টিভির জন্য আমার ইন্টারভিউ নিতেন। সহকর্মী সুমন কায়সার আর গাজি নাসির খোকন, সুযোগ পেলেই প্রিন্ট মিডিয়ায় আমার উদ্ধৃতিসহ মঙ্গা ক্যারাভানের খবর ছাপানোর বন্দোবস্ত করতেন। তৌফিক ইমরোজ খালিদি ভাই, সিএস করিম বা শফিক রেহমানের মতো ইংরেজি সাহিত্য অনুরাগীদের আমার বই জনান্তিকে গিয়ে কেনার চাপ দিতেন। সলিমুল্লাহ খান বইটা পাঞ্জাবীর পকেটে ভরতে ভরতে বললেন, ‘আমাদের ইংরেজি লেখক দরকার।‘
২০০৯ সালে দ্য এডিটরের মোবাইল স্টলে ওয়েব টিভি লাইভ সম্প্রচারের নিরীক্ষা করতে গেলাম টিম নিয়ে। বাকার, নিউটন, রাকা, সুস্মিতা লেখক-সংস্কৃতি কর্মীদের ইন্টারভিউ করতো অবিরাম। দেবাশীষ দ্য এডিটর ডিবেট কনসার্ট আয়োজন করলো স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে। আমি একবার মেলার স্টল-একবার ডিবেট কনসার্টে পিং পং বলের মতো ঘুরতাম। মাঝে মাঝে শামীম এসে সোরোয়ার্দি উদ্যানে নিয়ে যায়; হাঁটতে হাঁটতে আমরা ছবির হাটে যাই; চা খাই।
সেটা আমার দ্বিতীয় দফা দেশ ছাড়ার বছর।
মেলার শেষ দিনে টিএসসি’র সামনে দাঁড়িয়ে ভালোবাসার মুক্তাঞ্চলটিকে শেষবার দেখছিলাম। মেরিনা আপা এগিয়ে এলেন আনিসুল হককে নিয়ে। বললেন, ‘সামনে বার দেখা হচ্ছে পাভেল।‘ আমি হাসলাম, কারণ আমি তো জানিই, ওপারে ভাসিয়েছি ভেলা।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই সাউথ এশিয়া