মাসকাওয়াথ আহসানের বিতর্ক
ক্লাস ফাইভ-সিক্সেই তুলনামূলক ধর্ম-দর্শন পাঠ করার ফলে; ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টীয় ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়। প্রতিটি ধর্মেই সত্য-সুন্দর ও মঙ্গলের ধারণা পেয়ে গভীর আনন্দ অনুভব করি। আমার ছেলেকেও আমার আব্বা একইভাবে তুলনামূলক ধর্ম-দর্শন পাঠ করান। বারো বছর বয়সে সে একটা প্রবন্ধ লেখে এ বিষয়ে। সেখানে অনুসিদ্ধান্ত টানে কিছু খাদ্যাভাস ছাড়া; ধর্মগুলোর মাঝে কোন পার্থক্য নেই। প্রত্যেকটি ধর্মই ট্রুথ-বিউটি এন্ড গুডনেসের মেসেজ দিচ্ছে। ধর্ম সম্পর্কে এই ধারণার ভিত্তিভূমিতেই দাঁড়িয়েই আনন্দময়; অবিভাজিত মানব সভ্যতা উদযাপন করলাম; নানা ধর্মের বন্ধুদের সঙ্গে।
আব্বা মারা যাবার কিছু দিন আমাকে আরেকবার মুহাম্মদের বিদায় হজ্জ্বের ভাষণটি পড়তে বললেন। মুহাম্মদ যেখানে নিজেকে রক্তমাংসের মানুষ বলে বর্ণনা করছেন। তিনি কোন মহামানব নন; একথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।
পবিত্র কুরান পড়ে; খৃস্টীয় ও ইহুদি ধর্মের লেখক-গবেষকদের ইসলাম ও মুহাম্মদ সম্পর্কে গবেষণা গ্রন্থ পড়ে বুঝলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টিয় ধর্মের পর ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে খোদার বার্তা মানব কল্যাণে প্রচারিত হওয়ায়; তা উত্তরাধুনিক ও সাম্প্রতিকতম কল্যাণবার্তা।
খৃস্টীয় ও ইহুদি ধর্মের সুবিধা হয়েছে যে, এই স্কুলে ততজন ছাত্রই ভর্তি করা হয়েছে; যারা এই স্কুলে ভর্তি হবার যোগ্য। তবু উগ্রপন্থী হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট বা কট্টরপন্থী ইহুদি-খৃস্টান আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরাইলে দেখতে পাই।
কিন্তু ইসলাম ধর্মে স্কুলের ধারণ ক্ষমতা চিন্তা না করেই; অনেক বেশি ছাত্র ভর্তি করা হয়েছে। ফলে অতীতে যে মাদ্রাসা, দর্শন-বিজ্ঞান-গণিত-ন্যায়শাস্ত্র পড়ানো হতো; এখন সেখানে অর্থ না বুঝে কেবল কোরান হেফজ করা হয়।
তুরস্ক-মালয়েশিয়া ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সবচেয়ে সফল দুটি রাষ্ট্র। সংযুক্ত আরব-আমীরাত নানা সংস্কারের মাঝ দিয়ে সেরকম একটা জায়গায় যাবার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কিত কৌতুকের জনপ্রিয়তা দেখে ধারণা করি; ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে তারা একটি অপেক্ষাকৃত সভ্য সমাজ বিনির্মাণের চিন্তাটা অন্ততঃ করতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে কট্টর ইসলামের লীলাভূমি আফঘানিস্তান। আর বাংলাদেশে ইসলাম; দুর্নীতি লুকানোর ভেক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র “লালসালু” উপন্যাসই বাংলাদেশ বাস্তবতা।
কলকাতায় ব্রান্ম ধর্মের চর্চার মাঝ দিয়ে বেঙ্গল রেনেসাঁ ঘটেছিলো। ফলে হিন্দু ধর্ম সে চ্যালেঞ্জের মুখে সহনশীলতা বাড়াতে পেরেছিলো। অভিনেতা ভানুর কৌতুক উপভোগ করার মতো সামাজিক আলোকায়ন ঘটেছিলো। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানে সে পরিবেশ এখন আফঘানিস্তানের মতোই কট্টর হয়ে উঠেছে। এখন বিভিন্ন জায়গায় শিবলিঙ্গ খুঁজে খুঁজে ঐ স্থানের মসজিদ গুঁড়িয়ে দেবার ফন্দি করছে উগ্রপন্থী হিন্দুসেনারা। হিন্দু ভারতের স্বপ্নে বিভোর তারা। বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের এই কট্টরপন্থীদের দেখা মেলে।
গৌতম বুদ্ধের অহিংস শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়েছে মায়ানমার ও বাংলাদেশের বৌদ্ধদের একটি অংশ। আমি ছাত্রজীবনে যে বৌদ্ধ বন্ধু পেয়েছি; অনাবাসে যে আফঘান বৌদ্ধ বন্ধু পেয়েছি; তাদের অন্তর্গত আলোকায়নের সঙ্গে তুলনা করলে; সম্প্রতি যে বৌদ্ধদের দেখা পেলাম; এরা আফঘানিস্তানের তালিবানদের মতোই হিংস্র ও অমানবিক।
সেদিক থেকে বিচার করলে; এই মুহূর্তে ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে হিংস্র ডিএনএ-র বসবাস বাংলাদেশ। এরা সবই চিন্তার জগতে অনগ্রসর তেতো মানুষ।
ইন্টারনেট যুগ এসে পৃথিবীর জানালা খুলে গিয়ে সভ্যতা-শিক্ষা-উদারপন্থা-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-বিনোদনের সম্ভার দেখে আসলে এই ডিএনএ-রা ভয় পেয়েছে। পশ্চিমে অনাবাসী মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধরা; যে কারণে অনেক বেশি ধর্ম-কর্মে ঝুঁকে পড়ে। তারা ভয় পায়, তাদের ছেলেমেয়ে একেবারেই ধর্ম-কর্ম ছেড়ে দেবে।
যে কোন ডিএনএ, তিনপুরুষ শিক্ষা ও আর্থিক সচ্ছলতার সুযোগ পেলে; প্রচলিত ধর্ম পালনে অতো সিরিয়াসনেস আর দেখায় না। যেহেতু সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের আনন্দ পেয়ে যায় অগ্রসর ডিএনএ; তাই মসজিদ-মন্দির-প্যাগোডায় গিয়ে রিচুয়ালিস্টিক ধর্মপালনে আগ্রহ পায়না এনলাইটেনমেন্টের মানুষেরা।
নারী যেহেতু ধরিত্রীর প্রতীক; নারীই গৃহকোণে বসে প্রার্থনা করে; ধর্মের রিচুয়াল বেঁচে থাকে নারীর মাঝ দিয়ে। খৃস্টান-ইহুদি-মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের নারী শান্তি ও অহিংস স্পিরিটে ধর্মগুলো পালন করে।
অনেক লোক দেখিয়ে ধর্মপালন করে দুর্নীতিবাজ পুরুষেরা। আর ফেসবুকে আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা তরুণ-যুবারা। ফেসবুক রেনেসাঁকালের ইনডিভিজুয়ালিজম আঙ্গিকে; ব্যক্তির ক্ষমতার ঔজ্জ্বল্য প্রদর্শনের সুযোগ করে দিয়েছে। সেইখানে যখন ব্যক্তি নিজের অনুজ্জ্বল উপস্থিতিতে অসহায় বোধ করে; তখনই সে ধর্ম কিংবা দলের গ্যাং পাকিয়ে আসে।
অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষের ইগো প্রবল হয়। ফলে মাদ্রাসা-কলেজে পড়ে নিজেকে যখন কেবল একটি একটি সংখ্যা মনে হয়; তখন অনাম্নী তরুণ-তরুণী ক্রোধের আগুনে হিস হিস করে জ্বলতে থাকে। আবার দুর্নীতি বসন্তে নতুন টাকা-জামা-গাড়ি-দামী রেস্তোরায় চেক ইন দিয়েও যখন ঠিক “জাতে ওঠাটা” নিশ্চিত হয়না; তখন এক শ্রেণীর তরুণ তরুণী সেকুলার হবার চেষ্টা করে।
এখন বাপ-দাদা যেহেতু অসাম্প্রদায়িকতা “অ” চর্চাও করেনি; তখন ছেলেমেয়েকে বেশি টগবগ করে ফুটতে হয়। ধর্মকে গালি দিলে ন্যান্সি কিংবা সিন্থিয়া আপা, ফাল্গুনী কিংবা লেনাদিদি; ফেসবুকে কীরকম কথা বললে খুশি হয়ে তার সেকুলার আড্ডায় দাওয়াত দেবে; চিত কাত হয়ে বিটলস গায়কদের মতো করে ছবি তুললে অত্যন্ত ট্রেন্ডি মনে হবে; এমন ভাবে আফজাল অরণ্য; বদরুদ্দোজা কিংবা রাজেশ পাল। কিন্তু এইটা হয়না; মানে দাঁড়ায় না; খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করে, আফ্রিকার লোকজন বৃটিশ সাহেবের মতো পোশাক পরে চার্চে গেলে যেমন দেখায়; ঠিক তেমনি দেখায় দক্ষিণ এশিয়ার নতুন কনভার্টেড সেকুলারদের।
বাংলাদেশ সমাজে আমরা শিশু-কিশোরদের প্রতি নির্দয় এক পেডোফিলিক সমাজ গড়েছি। ফ্রান্সজ কাফকার মেটামরফসিসে গ্রেগর সামসার বাবা সামসার প্রতি যেরকম কর্কশ আচরণ করে; আমরাও ঠিক তাই করি আমাদের সন্তানদের সঙ্গে। ফলে সেন্স অফ হিউমার বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যত্র যে স্ট্যান্ড আপ কমেডি ও সাটায়ার বিকশিত হয়েছে; বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়নি।
তবে আমি বাংলাদেশের কট্টর মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ তরুণ-তরুণীদের নিয়ে অনেক আশাবাদি। নিজে স্যাটায়ার চর্চা করি। ধর্মীয় ও দলীয় কুসংস্কার নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখি। “প্যাসেজ টু হেভেন” ধর্মান্ধতা ও দলান্ধতার ক্যানভাসে লেখা এরকম একটি উপন্যাস। এর যথেষ্ট পাঠক-পাঠিকা আছে। কলকাতা বা করাচীর পাঠক কখনো গালাগালিভার্স ট্রাভেলস করে না। গালি খেতে হয় স্বদেশের পাঠক-পাঠিকার কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই আমার ভালোবাসার মাতৃভূমি; একে এমন অন্ধকার যুগের দিকে নিমজ্জিত হতে দিতে পারিনা কিছুতেই।
স্বগ্রামের জগদ্দল পাথরের বিপরীতে বিলয় বিমুখ রসক্ষেত্রের যুদ্ধটা চলতে থাকে। কিছু দলান্ধ ও ধর্মান্ধের অভিশাপ-গালাগাল উপেক্ষা করে চলতে থাকে অশোকের রম্য কীবোর্ড।