চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যানগগকে নিয়ে গাওয়া “স্টারি স্টারি নাইট” গানটির কিছু কথা আলোড়িত করে। মাঝারি চিন্তার সমাজে শিল্পীর বোধের যে কষ্ট; অন্যেরা তাকে বুঝতে না পারার যে বেদনা শিল্পীকে বহন করতে হয়; তা স্টারি স্টারি নাইট গানটিতে প্রকাশিত।
বাংলাদেশ গানের দেশ, কবিতার দেশ; এইখানে গান গাওয়ার ক্ষমতা, কাব্য ভাবনা নিয়ে অনেক মানুষ জন্মে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে শিল্পের জন্য প্রতিকূল এই দেশের পরিবেশ।
সিভিল সার্ভিসে কাজ করার সময় বাংলাদেশ বেতারে বাংলাদেশ মনীষাকে গভীর অভিমানে সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম। কিংবদন্তীর সংগীত শিল্পীরা এই ক্ষয়িষ্ণু জলসাঘরে আসতেন বুক ভরে অক্সিজেন নিতে। ফলে যাদের গান শুনে শৈশব-কৈশোর শিহরিত হতো; সেইসব গানের ভিনসেন্টের সঙ্গে সময় কাটাতে পেরে মনে হতো এ জীবন পূর্ণ হলো।
একদিন এক ভদ্রমহিলাকে দেখলাম, সিল্কের শাড়ি পরা-গোলগাল চাঁদের মতো মুখ আমার অফিসকক্ষে প্রবেশ করলেন ডোর ক্র্যাশিং-এর ভঙ্গিতে। সোফিয়া লরেনের মতো কথা বলার ঢং, কই শুনলাম আমার নাতি এখানে পোস্টিং পেয়েছে!
প্রযোজনা সহযোগী দ্রুত এসে আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বললেন, উনি স্পেশাল গ্রেডের সংগীত শিল্পী নার্গিস পারভীন। উনি নাতি শব্দটি বলার ফলে আমি বুঝতে পারি; আমার নানীর কাজিন উনি; নার্গিস পারভীনের শহর কুষ্টিয়ার উল্টোদিকেই পদ্মা নদীর পারে নানীর গ্রাম রূপপুর।
স্পেশাল গ্রেডের শিল্পীদের জন্য সেরা সংগীত পরিচালক আর বাদ্যযন্ত্রীদের নিয়ে দিনের শেষে রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা থাকে। হাতে সময় ছিলো উনার; তাই অভিভাবক হিসেবে একটু আমার খোঁজ-খবর করতে এসেছেন। বয়স আঠারো হবার পর থেকে আমি যতই অভিভাবকদের থেকে পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছি; ততই অভিভাবকেরা গেট ক্র্যাশ করে বার বার ঘিরে ধরেছেন যেন। বাংলাদেশ এতো ছোট দেশ; যে এখানে আত্মীয় পরিচয় বেরিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে সব জায়গায়।
নার্গিস পারভীন আমার অফিস কক্ষের সোফায় বসে বললেন, আমাকে কোন ব্যুরোক্রেসি দেখিও না। নানী কখনো এপয়েনমেন্ট নিয়ে নাতির অফিসে আসে না। নবম ব্যাচের সিনিয়ার নাজনীন আপা এসে নার্গিস পারভীনের সঙ্গে তাঁর গানগুলো নিয়ে গল্প শুরু করলেন। “যে আমার হৃদয় করলো চুরি” গানটি নার্গিস পারভীন গেয়ে উঠলেন অপেরার মতো করে।
https://www.youtube.com/watch?v=leQXn9VoYWc
এরপর আরো দু’একটি গান; “ঐ ভীরু মন তোমার আমার” কিংবা “ভালোবাসা দিয়ে মোরে এতো সুখ দিয়েছো; চাইনা আর কিছু চাইনা; যা পেয়েছি তা যেন হারাইনা।” মনে হলো জ্যোৎস্না নেমে এলো চারপাশে। কন্ঠের মধ্যে কী জাদু থাকে; যা ইট পাথরে নিসর্গকে বিনির্মাণ করতে পারে।
https://www.youtube.com/watch?v=NddUedNBHWI
নার্গিস পারভীন বাংলাদেশের সোনালী যুগের শেষ জাদু-কন্ঠগুলোর একটি। শৈশব থেকেই গানের প্রস্তুতি। কুষ্টিয়ার আড়ুয়াপাড়ার গাছপালা ঘেরা লাল ইটের দোতলা বাড়িটিতে আইনজীবী বাবার অনুপ্রেরণা; আর আইনজীবী বড় ভাইয়ের সংগীত চর্চার সঙ্গে বেড়ে ওঠা নার্গিস পারভীন; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কালেই রাজশাহী বেতারে গান করা শুরু করেন। বাংলাদেশ বেতার বাংলাদেশের শিল্পী লালনের কাজটি করে চলে; সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে। ফলে ঢাকা বেতার-টেলিভিশন হয়ে চলচ্চিত্রের গান সর্বত্রই নার্গিস পারভীন গান করেছেন; সমাদৃত হয়েছেন বিশিষ্ট গায়কীর জন্য।
বলিউডের চলচ্চিত্রের মান পড়ে যাবার আশির দশক আর নব্বুই দশকের শুরুটা; যখন জিতেন্দ্র সাদা ট্রাউজার সাদা শার্ট পরে হাটে-মাঠে-ঘাটে নেচে বেড়াতে শুরু করলেন; গোবিন্দ যখন কমলা ট্রাউজার পরে নাচানাচি আর হাসাহাসি শুরু করলো; অমিতাভ-শ্রীদেবী গেয়ে উঠলেন, সারে বদন বিচ্ছু লাড় গিয়া; সেই সাংস্কৃতিক ধসের অভিঘাতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দিশেহারা হলো। দর্শক রুচির লিবিডোতে সুড়সুড়ি দিতে, চাকভুম চাকভুম চাঁদবদনী গানের প্রচলন হলো; বাংলা চলচ্চিত্র আর সংগীতের শিল্পীরা অভিমানী হলেন। নার্গিস পারভীন সেই অভিমানী শিল্পীদের একজন। যিনি সংগীত রুচির ব্যাপারে কখনোই আপোষ করবেন না।
বলিউডের ধসের ধাক্কায় একই সময়ে কলকাতা ও লাহোরের চলচ্চিত্র জগত ধসে পড়ে যেন ডমিনো এফেক্টে। দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতির অন্তঃসলিল প্রবাহ আর অরগানিক ইউনিটির জায়গাটি এই সময়কালের সংগীত-চলচ্চিত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট ধরা পড়ে।
ফলে কিংবদন্তীর শিল্পীদের গান গাওয়ার জায়গা বলতে বাংলাদেশ বেতার আর টেলিভিশন এই দুটি জায়গা অবশিষ্ট ছিলো। কারণ ভালো গীতিকার-সুরকার-বাদ্যযন্ত্রী-স্টুডিও সুবিধা মিলিয়ে; এই একটি জায়গাই ছিলো ঐতিহ্যের অস্থি ধারণ করে। অন্য জায়গায় চলছিলো বলিউড আর হলিউডের কপি পেস্ট ফিল্ম বানানো আর গানের সিডি বের করার টিক টক ভেড়া দৌড়। আশৈশব প্রস্তুতি ছাড়াই স্টেজে মেরে দেয়া অপ্রস্তুত শোবিজের ভীড়ে; নার্গিস পারভীনদের শেষ দিনগুলো সুখের হয়নি।
নার্গিস পারভীনের আর্থিক টানাপোড়েন ছিলো না; কিংবদন্তীর শিল্পী বলে বাংলাদেশ বেতার-টিভিতে যথাযথ মর্যাদায় গান গাইতেন; শিল্পীর আনন্দের জন্য এটা যথেষ্টই ছিলো।
কিন্তু ভিনসেন্টের মতোই বেদনা আহত করেছিলো নার্গিস পারভীনকে। শিল্পিরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর আর বিষণ্ণতা বিলাসী হন। এটা সৃজনশীলতার শুল্ক; যা একজন মানুষকে দিতে হয়; বেতোফেন কিংবা এলিজাবেথ টেলরের জীবনের ট্র্যাজেডি দেখলে বোঝা যায়। পারফর্মিং আর্টের মানুষদের সমাজের মনখারাপকে আনন্দে রূপান্তর করতে হয়। এরফলে একজন শিল্পীকে নিজের মুডকে আপলিফট করতে হয়; পাওয়ার পারফরমেন্সে। ক্রমাগত শ্রোতা দর্শকের মুড আপলিফট করতে, তাদের মন চাঙ্গা করতে; নিজের মুডকে এলেগরিক্যালি চন্দ্রাহত করতে হয়। শিল্পের জ্যোৎস্না নামাতে। মানুষের মনের পোলের নীচে থাকে মনখারাপ আর ওপরে থাকে আনন্দ।
সঙ্গীত শিল্পীর গায়কী শ্রোতার মনে আনন্দের রসায়ন সৃষ্টি করে। গানের কথা-সুর-বাদ্যসঙ্গকে শ্রোতার মস্তিষ্কে কেমিকেলের মতো ছড়িয়ে দেন গায়ক-গায়িকা। এই কাজটি করতে গিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব কিংবদন্তীর গায়ক-গায়িকার নিজের প্রাণপ্রবাহে ঘাটতি পড়ে।
এসময় তার পরিপার্শ্ব তাকে আর্ট-এপ্রিসিয়েশান দিয়ে চাঙ্গা করার কাজটি করে অগ্রসর সমাজে। ভিনসেন্ট ভ্যানগগের মতো শিল্পীদের অভিমানে আত্মহনন দেখে পশ্চিমাসমাজ কিছুটা সচেতন হয়েছে। শিল্পীমনকে বোঝার চেষ্টা করে ইউরোপের মানুষ।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় সারাক্ষণ টেকাটুকার আলাপ, বাড়ি-গাড়ি-মরিচ-পেয়াজ, চেয়ার, অধুনা সেকেন্ড হোম; ইত্যাদি ফাঁপা সাফল্যের আলোচনা। আর কৃত্রিম শোবিজ তৈরি করে নিজেরাই নিজেদের যুগশ্রেষ্ঠ ঘোষণার মিড সামারস নাইটস ড্রিম। ফলে শিল্পীকে নিরুতসাহিত করার সব উপাদান এখানে বিদ্যমান।
আজ নার্গিস পারভীনের জন্মদিন। ইউটিউবের শেলফ থেকে উনার গানগুলো শুনে সোনালী যুগের গীতিকবিতা, সুর, বাদ্যসঙ্গ আর গায়কীর ধ্রুপদী বারান্দায় ঘুরে মনে হলো, উনি যে উপহার রেখে গেছেন; তা স্বকীয় নান্দনিকতায় ভরপুর। আকাশের যে তারাদের মাঝে ভিনসেন্ট আছেন, সেইখানে নার্গিস পারভীন আছেন নিঃসীম আনন্দে; যে সমাজ সমসাময়িককালে শিল্পীর মনের সূক্ষমতা অনুধাবন করতে পারেনি; সেই সমাজই আকাশের আন্তর্জালে খুঁজে পাচ্ছে অনবদ্য সেই তাঁকে।
Now I understand
What you tried to say to me
And how you suffered for your sanity
And how you tried to set them free
They would not listen, they did not know how
Perhaps they’ll listen now.
https://www.youtube.com/watch?v=LG-2bJ-Af3M