আপাদমস্তক চীন একটি লুটেরা রাষ্ট্র। দেশটি তার উইঘুর নাগরিকদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালায়। ইসলামী শিক্ষা বিতাড়ন করতে পুরুষদের ক্যাম্পে বন্দি করে রাখে। নারীদের যৌন নিপীড়ন করে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে। হংকং, ম্যাকাও, তাইওয়ান ও তিব্বতকে জবর দখল করে রেখেছে। এসব অঞ্চলের নাগরিক স্বাধীনতা ও সম্পদ লুট করছে। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ বেষ্টিত দক্ষিণ চীন সাগরে ব্রুনাই, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন ও ভিয়েতনামের জায়গা ভোগ দখল করছে।
একই সাগরের বিতর্কিত জলসীমায় কৃত্রিম দ্বীপ গড়ে সামরিক ঘাঁটি বানাচ্ছে দেশটি। যা নিয়ে প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব তুমুল। অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের ধারণা, দক্ষিণ চীন সাগরে দেশটির আগ্রাসী নীতির ফলে এখান থেকে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। জাপান ও আমেরিকাকে শায়েস্তা করতে উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক সুবিধা দেয় চীন। আমেরিকাকে ধ্বংস করতে কিম জং উন যেসব হুমকি ছোড়েন তার পেছনে উস্কানি থাকে চীনা কর্তৃপক্ষের। ভারত মহাসাগরে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিধনে চীনের প্রত্যক্ষ মদদ আছে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা। বর্তমান দুনিয়ার দ্বিতীয় পরাশক্তি চীনের অসংখ্য সম্প্রসারণবাদী নীতির মধ্যে এসব অন্যতম। (চীনের বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দুষ্ট চরিত্রও অসংখ্য। সেটি আজকের লেখার মূল বিষয় নয়)
আঠারশো শতকের শেষ দিকে বিশ্ব খ্যাত একজন সমুদ্র বিজ্ঞানীর মন্তব্য ছিল, সমুদ্র যার দখলে থাকবে সেই শাসন করবে ভবিষ্যতের পৃথিবী। বর্তমান বিশ্বের প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ সমুদ্রে মার্কিন নৌ বাহিনীর অবাধ বিচরণ। সে তুলনায় চীনের হাতে সামুদ্রিক এলাকা নেই বললেই চলে। ফলে দেশটি বিশ্বের একক পরাশক্তি হবার বাসনায় সড়ক পথে গোটা বিশ্বকে যুক্ত চেষ্টায় মগ্ন। যার নাম দেয়া হয়েছে বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো সিল্ক রুটের মাধ্যমে ইউরোপকে এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে চায় চীন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, এফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্য আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে এককভাবে এসব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে চায় চীন। যা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন পৃথিবীর দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে সবার আগে যাদের নাম আসছে তারা হলো, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইসরায়েল ও অস্ট্রেলিয়া।
চীনের বিআরআই প্রকল্প ধ্বংস করতে ২০১৬ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং চীনকে চাপে রাখা। কিন্তু একই বছর ডনাল্ড ট্রাম্প নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি ওবামার ওপর ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে আরও অনেক প্রকল্পের সাথে টিপিপিও বাতিল করে দেন। ফলে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ যেসব দেশকে যুক্তরাষ্ট্র চীনা আগ্রাসন ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটি ভেঙ্গে পড়ে। এতে চীনের বিআরআই প্রকল্প সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যায়।
পূর্বেই বলেছি আজকের লেখায় চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বদনাম লিখবো না। স্পেশালি ভারতের। কারণ প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের আচরণ সবারই জানা। বাস্তবে চীন-আমেরিকা ও ভারত মূদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। চীনের অনেক বদনামের মধ্যেও দেশটির ভালো গুণ হচ্ছে, পৃথিবী শাসন করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সামরিক দক্ষতা। এক্ষেত্রে ভারত পুরোটাই উল্টো। কী কারণে উল্টো সেটি বলছি।
ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন। অধিকাংশ চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেন। সর্বশেষ করোনাভাইরাস উহান শহরে উৎপত্তি হওয়ার পর এটি চায়নিজ ভাইরাস বলে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এই পরিস্থিতির মধ্যে, চীনের সঙ্গে ভারতের বহু পুরনো সীমান্ত বিরোধ মাথা চাঁড়া দিয়ে ওঠে। গত মাসে দুদেশের সৈন্যদের হাতাহাতিতে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। যা নিয়ে ভারতে ব্যাপক চীনবিরোধী আক্রোশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু চীনা পণ্য দেশটি থেকে ব্যান্ড করা হয়েছে। এসব পুরনো খবর, যা কম বেশি সবার জানা। হঠাত চীন-ভারত এ তুমুল দ্বন্দ্বের নেপথ্য কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যেসব ঘটনা জানা যাচ্ছে তা এরকম।
চীন, পাকিস্তান ও ভারতীয় মুসলিম জাগরণ ঠেকাতে উগ্র জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদিকে হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। যেটি শুরু হয়েছিল ২০১২-১৩ সালে। নরেন্দ্র মোদির পেছনে কাড়ি কাড়ি ডলার ঢালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। যার মাধ্যমে মোদীকে ব্যাপক জনপ্রিয় নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় এলে মার্কিন ইসরায়েল পলিসি বাস্তবায়নে একের পর এক ধাপে এগিয়ে গেছেন। করোনা সংকটের দায় চীনের ওপর চাপিয়ে দেশটি থেকে ইউরোপ-আমেরিকার কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ তুলে ভারতে নিতে চাপ সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। ভারতে চীনা পণ্য বাতিল করে দেশটিতে ব্যাপক বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখায় দেশ দুটি। সেইসাথে সব ধরনের সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে চীনকে হটিয়ে এশিয়ার মোড়ল হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয় ভারতকে।
পরিকল্পনা মাফিক চীনের বিআরআই প্রকল্প নস্যাৎ করতে প্রথমে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর কারাকোরাম হাইওয়ের পাশে সামরিক সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করে ইন্ডিয়া। অবশ্য এর আগে ওই এলাকায় গোপনে সড়ক নির্মাণ করে চীন। যেটি নিয়ে দুদেশের উত্তেজনা চরমে ওঠে। সম্প্রতি চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অর্থনৈতিক সহযোগি হতে বার বার তাগিদ দিয়েছে চীন। কিন্তু ইসরায়েল ও মার্কিন প্রস্তাবের মোহে ভারত তাতে কর্নপাত করেনি। এতে চীনা কর্তৃপক্ষ চটে গিয়ে কড়া সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। যার ফলশ্রুতিতে ২০ জন ভারতীয় সেনা প্রাণ হারান।
শেষ করি, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন, পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হয়। নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার কাছে নতি শিকার করে ভেঙ্গে ১৪ খণ্ড হয়। সে সময় পাকিস্তান তার পররাষ্ট্রনীতির জন্য বিজয়ের হাসি হাসলেও দেশটির সুখ বেশিদিন টেকেনি। কয়েক বছরের মধ্যে মিত্র আমেরিকাই পাকিস্তানের সুখের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। বর্তমানে দেশটির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক যেকোন সময়ের তুলনায় খারাপ। পাকিস্তান এখন চীন-রাশিয়া বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবে ভারত উলটে পথে হেঁটে মার্কিন-ইসরায়েলের বলয়ে তরী ভিড়িয়েছে। ভারত হয়তো আবারো তার সাবেক মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিতে চায় (তখন সোভিয়েত হেরেছিল উদীয়মান শক্তি আমেরিকার কাছে এবার আমেরিকা হারতে চলেছে উদীয়মান শক্তি চীনের কাছে) আর বাস্তবে এটি হলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলও কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়বে। চায়নিজ আর্মি সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকে পড়বে। এরই মধ্যে মার্কিন আধিপত্য ঠেকাতে রাশিয়া-চীন-ইরান ও তুরস্কের মধ্যে অক্ষ শক্তি গড়ার চেষ্টা চলছে। সেটি কার্যকর হলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনীদের চুড়ান্ত মৃত্যু অনিবার্য হবে। ফলে ভারতকে আরও সাবধানী হয়ে পা বাড়ানো উচিৎ।
–আশরাফুল ইসলাম রানা : সাংবাদিক