আজ এক বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পপতির কথা বলবো। তাঁর নাম- শ্রী জি কে পেন্ধারকার- গজানান কেশাভ পেন্ধারকার। ভদ্রলোক ২০১৫ সালে ইন্তেকাল করেছেন। এই উপমহাদেশে অভিজাত ও সুপরিচিত ভিকো গ্রুপ অফ কোম্পানিজ-Vicco Group of Companies- এর চেয়ারম্যান ছিলেন।২০ টি ভেষজ উপাদান দিয়ে তৈরি ভিকো আয়ুর্বেদিক টুথপেস্ট ও নারীকুলের কাছে অতি জনপ্রিয় সৌন্দর্য় চর্চার উপাদান- ভিকো টারমারিক ক্রিমের জনক ছিলেন শ্রী জি কে পেন্ধারকার। ভারতে প্রথম কোন টেলিভিশন শো বাণিজ্যিকভাবে স্পন্সর করার আইডিয়াও ছিল তাঁর মস্তিষ্ক প্রসুত। ভিকো কোম্পানি বেশ ক’বার রফতানির জন্য ভারত সরকারের পুরষ্কার পায়। ভারতের কয়েকটি প্রদেশে তাদের কারখানা রয়েছে বেশক’টি। সদর দপ্তর মুম্বাইতে। সেখানকার অন্যতম অভিজাত ও ধনী পরিবারের একটি হলো পেন্ধারকার পরিবার।
১৯৯৬ সালে আমি একটি দৈনিক পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করি। আমার ক্যাডেট কলেজের এক ঘনিষ্ট ছোট ভাই লুৎফর একদিন অনুরোধ করলো তার ছোটভাইকে কিছু সহায়তা করার জন্য। আমি ব্যবসা বুঝি না, বুঝতেও চাই না। তবে, যেহেতু কথাবার্তা মোটামুটি বলতে পারি( বলা যায় চাপার জোর কিছু আছে!!!) সেজন্য ওর ছোট ভাইয়ের সাথে ভারতে যেতে অনুরোধ করলো ক্যাডেট কলেজের ভাইটি। রাজি হলাম। লুৎফরের ছোট ভাইয়ের নাম আজাদ।
আজাদের সাথে যেতে হবে মুম্বাই। সেখানে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে ভিকো কোম্পানির চেয়ারম্যানের সাথে! আজাদ বাংলাদেশে ভিকোর ডিলারশীপ আনতে চাচ্ছিল। ও আমাকে মোটামুটি ধারণা দেয় কি নিয়ে আলাপ হবে, এলসি কিভাবে খোলে, কমিশন কিভাবে- কতোটুকু রাখলে বাংলাদেশে কতোটুকু লাভ করা যাবে ইত্যাদি। আমি যেতে রাজী হয়েছিলাম দুটো কারনে- এক, মুম্বাই দেখা যাবে ও দুই, ভিকো তখন নামকরা কোম্পানি ও ওদের বিজ্ঞাপন ভারতীয় টিভি খুললেই দেখা যায়।তো ওরকম একটা কোম্পানি দেখার লোভ। আজাদ আমার বিমান টিকেট, খরচাদি সব বহন করে। আমি টুপ করে গিয়ে একদিন রাতে নামি মুম্বাইতে ওর সাথে।
পরদিন সকালে দশটার মধ্যে আমরা গিয়ে হাজির হই ভিকোর অফিসে। রিসিপশনে পা দিয়েই বুঝতে পারি যে আভিজাত্য কাকে বলে? কোন এক্সট্রা শান শওকত, অযথা শো পিস, বড়লোকি দেখানোর জন্য ঘরভর্তি এটা সেটা নেই। কিন্তু সবকিছুতে রুচি, শিক্ষা ও এরিস্ট্রোকেসির পরিচয়। বোঝা যায় ওনারা উচ্চ শিক্ষিত ও মার্জিত পরিবারের।
যাহোক, আমাদের সোজা চেয়ারম্যান মহোদয়ের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেযুগে গুগল দেখে কাউকে জানার সুযোগ ছিল না। তাই শ্রী পেন্ধারকার কতো বয়সের বা দেখতে কেমন তা আগে জানতে পারিনি। তাঁর রুমে গিয়ে দেখি তিনি আমাদের বাবার মতো বয়সী। তিনিও আমাদের দুই পিচ্চি দেখে যতোটা বিস্মিত তারচেয়ে বেশি আমোদিত হলেন। বসতে দেয়ার পর সোজা জানতে চাইলেন আমাদের বয়স কতো? আমার তখন ৩১ ও আজাদের ২৫ হবে হয়তো! উনি প্রশ্ন করলেন তোমরা ব্যবসা বোঝ? আমি আর ভয়ে আমার সাংবাদিক পরিচয় দিলাম না। সোজ ভাবসাব নিয়ে বলে দিলাম যে আমরা ব্যবসা শুরু করেছি। কেউ তো আর চট করে বাচ্চার বাপ হয় না। আগে বিয়ে করতে হয়! তিনি হো হো করে হেসে দিলেন। ওতেই খুশি হলেন। বললেন- তোমাদের সাহস আছে দেখছি। আমি তোমদের পছন্দ করেছি ইয়াং মেন। কফি আসতে আসতেই বলে দিলেন যাও তোমাদের এজেন্সি দিয়ে দিলাম। এখন লেন দেন, হিসাব নিকেশ নিয়ে আলাপ হবে মাত্র। আই লাইক ইয়্যু গাইজ। ইউ আর ইয়াং এন্ড হ্যাভ কাম টু টক টু মি…গুড, দ্যাটস মেনি ইন্ডিয়ান হ্যাগার্ড ডোন্ট ডেয়ার…
কি সব ব্যবসায়িক আলাপ হয়েছিল তাতে যাচ্ছি না। তাঁর রুমটিও পুরনো আসবাবপত্রে সাজানো। শ্রী পেন্ধারকার জানালেন ওগুলো সব তাঁর বাবার আমলের অর্থাৎ ১৯৫০ দশকের! উনি শুধু প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলো পরিবর্তন করেছেন মাত্র। বাহুল্য কিছুই নেই। সাদামাটা সব। মানুষকে দেখিয়ে চমৎকৃত করার যে খায়েশ অনেক নব্য ধনীর থাকে তা তাঁর রুমে এক রত্তিও নেই। একসময় তিনি তার এক ছেলেকে ডাকলেন। সাধারন, কিন্তু মার্জিত পোশাক পড়া এক যুবক এসে দাড়ালো। বসলো না বাবার সামনে।শ্রী পেন্ধারকার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন যে তার সব ছেলেরা পিএইচডি করা। একজন সম্ভবত তখন বাইরের কারখানা দেখাশোনা করতে গেছে। একজন হেড অফিসে। ছেলে পরিচিত হয়ে চলে গেল। আমরা কথা শুরু করলাম। পেন্ধারকার সাহেব খুবই রাশভারী মানুষ, চমৎকার বৃটিশ এ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলেন। মাঝে মাঝে কিছু ইতিহাসের বর্ণনা দেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথাও বলেন। মহারাষ্ট্রের মানুষের সংস্কৃতির কথা বলেন।
একসময় দুপুরের খাওয়ার সময় হলো। তিনি জানতে চাইলেন আমরা কি খাব? আমরা বিনয়ের সাথে বললাম যে আমরা বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে আসবো। আমরা আসলে উনার মতো পিতার সমান বয়সী কারো সাথে বসে খেতে সংকোচ বোধ করছিলাম। তিনি চেয়ার থেকে উঠে সহজ করে বললেন- চলো ওঠো। আমার সাথে চলো। আমার বাসায় খাবে। বলে কি? ভদ্রলোকের সাথে মাত্র পরিচয়। ভিন দেশি। তার উপর ধর্মের বাঁধা থাকতে পারে! (আমি শিওর ছিলাম না যে ভারতে কোন হিন্দু পরিবার তার বাসায় খাবার টেবিলে মুসলমানের সাথে খেতে পারবেন কিনা? কারন, আগে কলকাতায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলাম একবার)। যাহোক, আমরা না না বললেও তিনি ধরে নিয়ে গেলেন আমাদের। তাঁর গাড়িতেই গেলাম। বিশাল বাড়ি। বৃটিশদের সেই বাংলো ধাঁচের। পুরনো। তাঁর বাবা না দাদার আমলের। ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখি যেদিকে চোখ যায় শুধু বই আর বই! বই শেলফ ছেড়ে কার্পেটের উপর আশ্রয় নিয়েছে। চেয়ার, টেবিল দখল করেছে! বসায় জায়গা সংকুচিত হয়ে এসেছে। আমার অবাক করা ভাব দেখে শ্রী পেন্ধারকার বললেন- তিনি প্রতি মাসে গন্ডা গন্ডা বই কিনেন। তাঁর দাদার কেনা থেকে শুরু করে তার বাবা ও তার বই রাখার জায়গা ওই বিশাল বাড়িতে হচ্ছে না! পড়ার ঘর ভরে গেছে অনেক আগেই। আমি মিন মিন করে তার কাছে জানতে চাইলাম- ম্যাডাম কিছু বলেন না? কেন? ও তো আমার চেয়ে বেশি বই পড়ে! এরমধ্যে তাঁর স্ত্রী দেখা করতে এলেন। মাফ চেয়ে নিয়ে বললেন যে তাঁকে যেহেতু আগে জানানো হয়নি তাই যা আছে তাই থেতে হবে। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি একপাশে দুই কি তিনজন পরমা সুন্দরী যুবতী বসে আছেন। উনারা তার ছেলেন বউ। শ্রী পেন্ধারকার বাড়ির কর্তা হিসাবে তার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসলেন। ছেলের বউদের সাথে বসলেন তাঁর স্ত্রী। একপাশে আমি ও আজাদ। কোন বেয়ারা নেই। কোন কাজের মানুষ নেই! নিজেরা তুলে নিয়েই সবাই খাওয়া দাওয়া করেন। আমাদের পরম আদরে পেন্ধারকার সাহেব ও তাঁর স্ত্রী খাওয়া তুলে দিলেন। খুবই সাধারণ মেন্যু। সব ভেজিটারিয়ান ডিশ। খেতে খেতে শ্রী পেন্ধারকারের স্ত্রী জানালেন যে তাদের ঘরের সব কাজ তিনি ও তার ছেলেন বউরা মিলে করেন। রুটিন করে দেন তিনি। সেই অনুযায়ী কেউ রান্না করে, কেউ কাপড় ধোয়, কেউ বাড়ি তদারকি করেন, বাজার করেন ইত্যাদি। পেন্ধারকার সাহেব মুম্বাই থাকলে তারা একসাথে খান। ছেলেরা দিনে আসে না। রাতে সাথে থাকে।এসব শুনে খাবো কি? ভাবছিলাম কোথায়, কোন মহাপুরুষের বাসায় আসলাম? এতো ধনী মানুষ! তারা এতো সাধারনভাবে জীবন কাটায়? অথচ তাদের মাসে দুটি তিনটি করে মার্সিডিজ কেনা ও বাড়ির পর বাড়ি বা জমি কেনার সামর্থ আছে। তাদের কাজের লোক খুবই কম। সব বলতে গেলে তাঁর স্ত্রী ও ছেলের বউরাই সামলায়। সবাই উচ্চশিক্ষিত। কথাবার্তা, ম্যানার,এটিকেট দেখলেই বোঝা যায় কেতাদুরস্ত হওয়া ছোট থেকেই শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
পরের দিনও সকাল থেকে বিকাল পর্য়ন্ত ভিকো অফিসে থাকতে হয়েছে। সেদিন শ্রী পেন্ধারকার আমাদের তার অফিসের এক কর্তাকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন এক অভিজাত ক্লাবে খাওয়ার জন্য। তিনি ওটার মেম্বার ছিলেন।
আজাদের কোম্পানি বাংলাদেশে ভিকোর এজেন্সী পেয়েছিল। ভালোই ব্যবসা করেছিল কিছু দিন। পরে ও কি জন্য জানি ব্যবসা ছেড়ে লন্ডনে চলে যায়। আমাকে আজাদ কনসালটেন্সি ফি দিয়েছিল। সম্ভবত ১৯৯৭ সালে শ্রী পেন্ধারকারের মেয়ের বিয়ে ছিল। তিনি আমাদের দুইজনকে দাওয়াত দিয়েছিলেন নিজে ফোন করে। আমরা যেতে পারিনি। তবে একটা ভালো জামদানি শাড়ি কিনে ডিএইচএল মারফত পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
আজ যখন উঠতি সমাজতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ধনীদের (আসলে ছোটলোকদের) কার্য়কলাপ দেখি তখন চট করে মরহুম পেন্ধারকারের কথা মনে পড়ে। আহা! শিক্ষিত, অভিজাত পুঁজিপতি কেমন হতে পারেন তা ছিলেন ওই মহৎ মানুষটি। কতোই না পার্থক্য চাড়াল প্রজাতির সাথে? কতোই না…!!!
[ শ্রী পেন্ধারকারের অফিসে।ছবিটা আজাদ তুলেছিল আমার ক্যানন ক্যামেরায়। সম্ভবত তাড়াহুড়ো করে তুলেছে বলে আমার মাথার অর্ধেকই নাই! তখন অবশ্য ফিল্ম ক্যামেরায় ওয়াশ না করা পর্য়ন্ত বোঝা যেতো না ছবি কেমন উঠেছে!]
– আবু রুশদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা,
সম্পাদক, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল