কামাল আতাতুর্ক মাত্র ১৫ বছরের শাসনামলে তুরস্ককে একটি বহুত্ববাদী সুশৃংখল সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র পরিণত করেন। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর বিশৃংখল সমাজকে সুশৃংখল ও শিক্ষিত সংস্কৃতিবান করে তোলেন তিনি। আজকের তুরস্কের দিকে তাকালে সেখানে আতাতুর্কেরই সুকৃতি চোখে পডে। সমাজ তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধরে রেখেছে সাফল্যের সংগে। একটি মিনি স্কার্ট পরা মেয়ে ও একটি পর্দা করা মেয়ে ট্রামে পাশাপাশি বসে থাকে অনায়াসে। রেস্তোরায় একজন কোমল পানীয় পান করে, তার পাশে বসে আরেকজন শক্ত পানীয় পান করে সহজাতভাবে। মসজিদের শহর ইস্তান্বুলে যার খুশি সে নামাজ পডে, যার খুশি সে নামাজ পডে না। সারা শহর জুডে সংগীতের মূর্ছনা। মসজিদের সামনে পথ সংগীত গাইছে তরুণেরা। রোজার মাসে বোঝার উপায় থাকে না সেখানে রমজান মাস চলছে। সারাদিনে একজনও ধর্ম মোল্লা চোখে পডেনি, চোখে পডেনি সংস্কৃতি মোল্লা। সারাদিন খুঁজে একটি সহমত ভাই খুঁজে পাইনি, যে এসে বলবে, এরদোয়ানই পারে, এরদোয়ানই পারবে।
তুরস্ক তাদের অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার চেতনাতেও চলছে না। তুরস্ক মদিনা সনদ বা ইসলামী চেতনায় চলছে না। পুরো ইস্তান্বুলে এরদোয়ানের ছবি দেখিনি একটিও। জাতির জনক কামাল আতাতুর্কের একটি ভাস্কর্য চোখে পডলো জাতীয় জাদুঘরের সামনে। আর একটি ভাস্কর্য তার ঠিক সামনে। একটি গ্রন্হ, আর পানির ফোয়ারা যেন বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে।
আমি পশ্চিমা মিডিয়ার ভোক্তা বলে আমি ভেবেছিলাম, এখানে এরদোয়ানের সমালোচনা করলে হয়তো পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। বাসে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম এরদোয়ান সম্পর্কে। সবাই বললো, ২০২৩ এ পরিবর্তন ঘটবে। জনগণ পরিবর্তন চায়। অনায়াসে মত প্রকাশ করে সবাই।
বহুত্ববাদী অসাম্প্রদায়িক সমাজের দৃষ্টান্ত হিসেবে, তুরস্ক আর জার্মানির সমাজকে একই রকম লেগেছে আমার কাছে।
ধর্ম, প্রগতিশীলতাকে ভাগ করে নিয়ে দুইদল ব্যবসায়ী লুন্ঠকের যন্ত্রণা তুরস্কে নেই। কঠোরভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন আর ধর্মপালন করেন না , এমন মানুষের পাশাপাশি অনায়াস অবস্হান তুরস্কের সৌন্দর্য। জার্মানিতে এমন দুই রকম মানুষের সহজাত অবস্হান রয়েছে।
খ্রীস্ট ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ জার্মানি আর ইসলাম ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ তুরস্ক খুব সম্ভব গোটা পৃথিবীর জন্যই দৃষ্টান্ত হবার মতো।
তবে শিষ্টাচার ও মানুষকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে তুর্কী সমাজ জার্মানদের চেয়ে আন্তরিক। ইউরোপের সমাজের যান্ত্রিকতা তুরস্কে নেই, অথচ একই রকম জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত সামাজিক সুবিচারের দেশ।
তুরস্কের খুব সম্ভব পশ্চিমের কোন দেশকে দেখে শেখার কিছু নেই। গ্রীস আর তুরস্ক খুব সম্ভব একই রকম জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। ক্যানাডার সুশাসনের সংগে গ্রিসের এনলাইটেনমেন্ট মেশালে তুরস্ক তৈরি হয়। কামাল আতাতুর্ক একজন লেখক শাসক ছিলেন। গ্রীক দার্শনিকেরা যে দার্শনিক রাজার খোঁজ করেছিলেন, কামাল আতাতুর্ক ঠিক তাই ছিলেন।
পশ্চিমা মিডিয়ার নেতিবাচক বিজ্ঞাপন দেখে আমি ভাবতাম আতাতুর্কের স্বর্গ বুঝি নরক হয়ে গেছে। অথচ সরজমিনে দেখলাম আতাতুর্কের দেশ। এরদোয়ানের চিন্তার কোন প্রভাব সেখানে নেই। যা বুঝলাম একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ফাউন্ডেশন শক্ত হলে, এমেরিকা, সৌদি আরব, বৃটেন বা পৃথিবীর কোন শক্তি এর সমাজকে দুর্নাম করে টলাতে পারে না।
বাংলাদেশে যারা ধর্ম ও প্রগতিশীলতা শেখায়, এমন শীর্ষ মোশাররফ করিমের “উদ্ধৃতির ঘরের উদ্ধৃতিদের” কথাবার্তা কতটা উদ্ভট তার প্রমাণ আজ আরেকবার পেলাম তুরস্কে এসে।কট্টর ধর্মপন্হীরা গর্ব করে বলেছিলো, তুরস্ক ইসলামপন্হীদের দেশ! কট্টর প্রগতিপন্হীরা ঘৃণা প্রকাশ করে বলেছিলো ওটা তো কট্টর ইসলামপন্হার দেশ। অথচ আমি এসে পেলাম মানুষের দেশ, বন্ধুত্বের দেশ, সংগীতের দেশ, হুইরলিং ডারভিশ রুমীর দেশ আর নির্মল বেলি ডান্সের দেশ।