দক্ষিণ এশিয়ার নারীসমাজের একটি বড় অংশ নিজের স্বামীকে খান আতার মতো “এ খাঁচা ভাঙ্গবো আমি কেমন করে”-র দুরাবস্থায় রাখতে পছন্দ করে। কিন্তু সেলিব্রেটি কিংবা আইকন হিসেবে পছন্দ করে একজন প্লেবয়কে।
১৯৪৭ সালের আগে বৃটিশের সঙ্গে জমিজমার ভাগাভাগিতে নেহেরুর যে সাফল্য; তা একজন প্লে বয়ের সাফল্য। জিন্না-শেরে বাংলা এরা ছিলেন আমাদের নানা-দাদার মতো সরল সোজা রোমান্টিক। লেডি মাউন্ট ব্যাডেনকে শেক্সপিয়ারের একটি কবিতা শুনিয়ে দেবার মতো রস-ইচ্ছা তাদের ছিলো না। গান্ধী রসিক মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেকে “বাপু” বানিয়ে লেডি মাউন্ট ব্যাডেনের সঙ্গে রসায়নে ঘোল ঢেলে দিয়েছেন।
ফলে আমার চোখে ১৯৪৭ এর স্বাধীনতার সবচেয়ে সফল নেতা নেহেরু। ইন্ডিয়ার শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তারদের পশ্চিমে চাকরি জোগাড় করে দেবার ক্ষেত্রে নেহেরুর এই চার্ম অত্যন্ত কাজে লেগেছে।
ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় ইন্টারভিউ নেবার পর ভারতীয় লেখক ও রাজনীতিক শাশী থারুর আমাকে টিপস দিয়েছিলেন, নারী-পুরুষের সঙ্গে একইভাবে ফ্লার্ট করলে; জীবনে তুমি যা করতে চাও; সেটা সহজেই এসে যাবে।
নিজের জীবন থেকে শুধু একটি কথাই বলেছিলেন, ভালো একটা কম্প্যানিয়নশিপ খুঁজে পেতে জীবনের গোলপোস্টে আমি চারটা কিক নিয়েছি। ফোর্থ কিকে গোল হয়েছে। তুমি চেষ্টা করো, প্রথম কিক কোন কারণে গোলপোস্টে লেগে ফিরে এলে সঙ্গে সঙ্গে সেকেন্ড কিক নিতে। শাশী থারুরের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সেকেন্ড কিকে ব্রেক থ্রু এসেছে আমার জীবনে।
সোনিয়া গান্ধী নিজে দলের সভানেত্রী থেকে যেভাবে মনমোহনকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, ভবিষ্যতে গান্ধী পরিবার যদি হুবহু তা-ই করে; শাশী থারুরকে যদি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার বানানোর লক্ষ্যে এগোয়; ইন্ডিয়া আবার রাইজ করবে; শাইন করবে; এ আমার একান্ত উপলব্ধি।
শাশী থারুরের প্রেস কনফারেন্সে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, অতীতে লেখকরা অন্তর্মুখী হতেন; আর এখনকার লেখকেরা ফ্রাংকফূর্টে আসেন বুক লঞ্চিং রোড শো’তে। উনি কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়ে প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললেন, প্রেসকনফারেন্সের পর তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে চাই। এরপর একটা ক্যান্ডি পকেট থেকে বের করে বললেন, তোমার লেখালেখি সম্পর্কে শুনতে চাই। কলকাতার সাংবাদিক সুপ্রিয় বন্দোপাধ্যায় আর ঢাকার আমি তিন চারদিন শাশীর চারপাশে তারা হয়ে ঘুরতে থাকলাম। একজন চার্মিং মামুর পিছে ভাগ্নে যেভাবে ঘুর ঘুর করে।
ইমরান খান একই জিনিস; মোস্ট হিলারিয়াস মামু। আমার ছাত্ররা উনার অনলাইন সহমত ভাই। শিক্ষক ও সাংবাদিক হিসেবে নৈর্ব্যক্তিকতা ধরে রাখতে; উনার সঙ্গে সেভাবে পরিচিত হইনি। উনার একজন থিংক ট্যাংক বারবার অনুরোধ করেছেন, ইসলামাবাদে গেলে যেন জানাই। কিন্তু গণভবনের পিঠাপুলি আমার পেটে সয়না।
নৈর্ব্যক্তিকভাবে যা দেখি; ইমরানকে চার্মে পরাজিত করা কঠিন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয়ের পর ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি নিশ্চয়ই ইমরানের ফ্যান। সে একজন নীরস মেয়ে; আমাকে হতাশ করে বলে, আমি কারো ফ্যান নই; ক্রিকেট আর ক্রিকেটারে আমার কোন আগ্রহ নেই।
অথচ ইমরানের রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের নারী সমর্থনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। ইমরানকে যখন নাগরিক সমাজ “তালিবান খান” বলে গালি দিচ্ছিলো; তখন দেখলাম; তার জনসভাগুলোতে ডিজে পার্টি হয়। আমার ছাত্রীরা গিয়ে নাচে সেখানে “ও-তে ওড়না ছাড়াই”। ইমরান আসলে মোল্লাদের সঙ্গে ফ্লার্ট করেছেন; তাদেরকে চার্ম করেছেন; ফলে জামায়াত নেতাদের চেয়ে মোল্লাদের বেশি কাছে চলে গেছেন তিনি।
ইমরান তার বাইশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে শেখ মুজিবুর রহমানের “অসহযোগ আন্দোলন” মডেল অনুসরণ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন খায়বার পখতুন খোয়ার আওয়ামী ন্যাশনালিস্ট পার্টির এক প্রবীণ নেতা। ইমরান গত নির্বাচনে জিতে একে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার দলের পতাকায় লাল সবুজ; তার ব্যবহৃত মাফলারে লাল সবুজ চোখে পড়ে। তার আইকন বঙ্গবন্ধু এটা তার অসহযোগ আন্দোলনের বকৃতার বাক্য-শব্দ বিন্যাসে সুস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বে নেহেরুর মতো প্রেমিক চার্মার-এর গুন যোগ করলে যা হয়; ইমরান হয়তো সেটাই হতে চেষ্টা করেন।
ইমরানের বাবা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। খুব শিক্ষিত পরিবার তাদের; আর কয়েক পুরুষ ধরে উচ্চ মধ্যবিত্ত। ইমরানের চার বোন। বাসায় তাদের রাজত্ব। বোনেদের আদরে শাসনে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তার জনসভার সামনের চেয়ারে বসে স্পিচ শুনে বাসায় ফিরে “কিচ্ছু হয় নাই” বলার মতো ক্রিটিক্যাল এই বোনগুলো।
ইমরান অক্সফোর্ডে পড়ার সময় বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে প্রেম প্রেম ভাব ছিলো; কিন্তু বৃটিশ মেয়েদের কনফিডেন্সই তাকে বেশি টেনেছে। স্ত্রী জেমাইমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তার। কেবল ইহুদি বলে পাকিস্তানে থাকেননি জেমাইমা। এরপর ইমরান বিবিসির সাংবাদিক বলে এক “বিদিশার নিশা”কে বিয়ে করেছিলেন; পাবলিক ডিমান্ডে; নেতাকে বিবাহিত হতে হবে; এ হচ্ছে বিবাহিত জীবনে অসুখী জনতার চাওয়া। সেই বিদিশার নিশা একখানি কাউডাং মার্কা গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন, কলতলার স্পিরিটে।
ইমরান ক্ষমতায় আসার আগে যত গর্জেছেন; ক্ষমতায় এসে তত বর্ষাতে পারেননি। কর্পোরেট জীবনে সফল আসাদ উমর টাইপের লোকেরা মন্ত্রী হবার পর কিছুই ডেলিভার করতে পারেনি। ফলে ইমরান রাজনীতিতে তার দলে ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ান টিমের মতো; ওয়াসীম আকরাম বা জাভেদ মিয়ানদাদ পাননি। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হয়েছে; কিন্তু দ্রব্যমূল্য ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে পারেননি।
ইমরানের ভারতে অনেক বন্ধু ও সাবেক প্রেমিকা রয়ে গেলেও; বাংলাদেশের মুসলিম বিদ্বেষী কিছু হিন্দুত্ববাদী ও সুডো সেকুলার ইতিহাসান ভাইয়েরা ইমরানকে জেনারেল নিয়াজির ভাতিজা বলে থাকে; গান্ধা কইরা দেওয়ার কলতলার বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে খোদা বা ভগবানও নিজেকে প্রমাণ করতে পারেন না বাংলাদেশে। নিয়াজি একটা টাইটেল; কিন্তু ইমরানের ফ্যামিলি ট্রিতে “জেনারেল নিয়াজিকে” খুঁজে পাইনি। কারো টাইটেল সরকার হলেই তো সে বাংলাদেশ সরকারের ভাতিজা নয়!
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সরকারি বাতাবি মিডিয়ার প্রচারণায়; ১৯৭১কে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের নারেটিভ জেনেছিলেন। তাই চট্টগ্রামে এসে ভারতের করোদ রাজ্য ভেবে জনগণকে ” নমস্কার” দিয়ে রুদ্ররোষের মাঝে পড়েন ইমরান।
পরে ঢাকায় তার ক্রিকেটার বন্ধু রকিবুল হাসানের কাছে জানতে পারেন পাকিস্তানি খুনে সেনার নৃশংসতা সম্পর্কে। ইমরান তার অটোবায়োগ্রাফিতে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাবার মতো ঘটনা বলে বর্ণনা করে একাত্তর নিয়ে বেদনা ও অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। একাত্তরের গিল্টের কারণে পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙ্গালিদের স্বার্থে ইমরান সক্রিয়। কাজেই “শাহবাগে”-র চেতনার পরীক্ষায় ও “শিবসেনা”র সেকুলারিজমের পরীক্ষায় ইমরানকে ফেল করানোর চেষ্টাটা; ক্ষ্যাত ও মাঠা প্রচেষ্টা বলেই প্রমাণিত।
ইমরান তার জীবনের একটি প্রেম ও বন্ধুত্ব নষ্ট করেননি। জীবনে অসংখ্য লিবেরেল মেয়ের সঙ্গে মেশার পর লিবেরেল থেকে “পীর থিয়েটার” করা এক নারীকে বিয়ে করেছেন। প্রত্যক সফল মানুষের জীবনে একটা “হুব্রিস” থাকে; এই মহিলা ঠিক তাই।
ইমরান মাঝে মাঝে তার হাসিনা আপা ও মমতা দিদিকে ফোন করেন; ছোট ভাই হিসেবে চারবোনের সংসারে বেড়ে ওঠায় এ তার সহজাত গুন।
ইমরান যুদ্ধের লোক নন, সংলাপের লোক। তার বাবা সমাজতন্ত্রী ভাবনার ছিলেন বলে; ইমরান ইসলামের মদিনা আদর্শের কল্যাণ রাষ্ট্র, তুরস্ক মডেলের সেকুলার ইসলামি রাষ্ট্র; আর চীন-রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট।
পুঁজিবাদী এমেরিকা ইমরানকে শেখ মুজিব, গাদ্দাফি, বাসার আল আসাদের মতোই অপছন্দ করে। ইমরান আসলে পুতুল খেলা পছন্দ করেন না। তাই সেনাবাহিনী বা এমেরিকার হাতের পুতুল হওয়া তারপক্ষে অসম্ভব।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরোধী গণতান্ত্রিক মোর্চার আনা অনাস্থা প্রস্তাব, গণতন্ত্রের সংস্কারে অত্যন্ত জরুরী পদক্ষেপ। রাজনীতি হচ্ছে দাবা-খেলা; ফলে শক্তিশালী বিরোধী দলের জটিল চাল; গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ।
ইমরান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ” যন্ত্র ঐ একটাই ষড়যন্ত্রে”র ন্যারেটিভ দিয়ে বিরোধী দল তার উইকেট ভাঙ্গার আগে বিরোধীদের উইকেট ভেঙ্গেছেন।
ইমরান সেনাবাহিনীর ডিকটেশানে চলা লোক নন। ফলে সেনাবাহিনীর যতটুকু সামর্থ্য তা দিয়ে তারা কিছু পিটি আই সাংসদকে ও স্বতন্ত্র সাংসদকে ইমরানের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে পেরেছেন। এসবই শাতরাঞ্জ কী খিলাড়ির উপাদান। তবে এতোদিন ইমরানের বিরোধিতা করা অনেক নিরপেক্ষ মানুষেরা বলছে, হিজ হার্ট ইজ এট দ্য রাইট প্লেস।
এখন দেখার বিষয় ৯০ দিনের মাঝে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইমরান তার রাজনীতি ও প্রেমের দক্ষতাকে কী করে কাজে লাগান। তবে এটুকু প্রমাণিত হয়েছে, সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে কোন পলিটিক্যাল চার্মারের ফ্লার্টে জনগণ সাড়া দেয় না।