এ কে এম বেলায়েত হোসেন কাজল
১৯৭৫ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে নবীন ক্যাডেটদের সমাপনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণের ধারণকৃত একটি ভিডিও ফেইসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককেই নিজেদের টাইমলাইনে শেয়ার করতে দেখেছি।
বঙ্গবন্ধুর তাঁর দেওয়া এই ভাষণে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে অত্যন্ত ব্যথিত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন।
‘এত রক্ত দেওয়ার পরে যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয় নাই। এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরকারবারি, মুনাফাখোরী বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত আমি এদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি। কিন্তু আর না।
বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে এভাবে লুটতরাজ করে খায়। আমি শুধু এমার্জেন্সি দিই নাই, এবারে প্রতিজ্ঞা করেছি, যদি ২৫ বছর এই পাকিস্তানি জালেমদের বিরুদ্ধে, জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে গোলাম মোহম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে বুকের পাটা টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি, আর আমার ৩০ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তাহলে পারব না? নিশ্চয়ই ইনশাআল্লাহ পারব। এই বাংলার মাটি থেকে এই দুর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, এই মুনাফাখোরী এই চোরাচালানকারীদের নির্মূল করতে হবে। আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও, বাংলার জনগণও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো। আর না, অধৈর্য, সীমা হারিয়ে ফেলেছি। এই জন্য জীবনের যৌবন নষ্ট করি নাই। এই জন্য শহীদরা রক্ত দিয়ে যায় নাই। কয়েকটি চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে বাইর করে দিয়ে আসে, …মানুষকে না খাইয়া মারে।
উত্খাত করতে হবে বাংলার বুকের থেকে এদের। দেখি কত দূর তারা টিকতে পারে। চোরের শক্তি বেশি না ঈমানদারের শক্তি বেশি, সেটাই আজ প্রমাণ হয়ে যাবে।’
১৯৭৪ সালের মার্চ থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
এই দুর্ভিক্ষের দেশে অসংখ্য মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে রোগে শোকে মারা গিয়েছিল।
সরকারী হিসেব অনুসারে ২৭,০০০ হাজর মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছে বলে দাবি করা হয়। যদিও বেসরকারি হিসেবে আনুমানিক এক লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করে বলে জানা যায়।
অবশ্য সত্তর দশকের শুরুতে সারা বিশ্বব্যাপী খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। বিশ্ব বাজারের সাথে সাথে স্থানীয় বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ ৭৪-এর মার্চ মাস থেকেই দেখা দেয়।
একই সময়ে রংপুর সহ দেশের উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ মঙ্গা দেখা দেয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দুই বছর তিন মাসের মাথায় দেশে এই বিপর্যয় দেখা দেয়।
সে সময় বাংলাদেশের মত সদ্য স্বাধীন নতুন রাষ্ট্র দেশের ক্ষতিগ্রস্থ অবকাঠামো এবং অপ্রতুল অর্থনৈতিক অবস্থা দিয়ে এতবড় দুর্ভিক্ষ সামাল দেয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
তার উপর যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশে নব্য নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ব্যাপক দুর্নিতিপ্রবণতা এবং আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা কর্মীদের সীমাহীন দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখল, কালোবাজারি, প্রতিবেশী দেশে খাদ্যশস্য চোরা চালান,অধিক মুনাফার আশায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য গুদামে মজুদ করে বাজারে সংকট সৃষ্টি করা,
সরকারের অব্যবস্থাপনা, উনুনন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে খাদ্যশস্য আনা-নেয়ার সীমাবদ্ধতা, খাদ্যশস্য বিতৱণে অব্যবস্থা, ত্রাণ সামগ্রী আত্মসাৎ করার কারণে এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়ানক অমানবিক দুর্ভিক্ষ হিসেবে গন্য করা হয়।
মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে এপ্রিল থেকে একটানা তিন মাস দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।ব্রহ্মপুত্র সহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উত্তরাঞ্চল সহ সমগ্র দেশে বিধ্বংসী বন্যা দেখা দেয়। ফলে, ধানক্ষেত – শস্যফসলাদি বন্যার পানিতে তলিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।সরবরাহ এবং বন্যার কারণে দেশের বাজারে চাল-ডাল ও লবনের দাম সাধারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।
এই চরম খাদ্যশস্যের সঙ্কটময় মূহুর্তে প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করতে অপারগতা প্রকাশ করে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুত খাদ্য সাহায্য জাহাজ থেকে অবমুক্ত করতে ইচ্ছাকৃত বিলম্বিত করে।জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিউবায় পাট রপ্তানি করার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুত খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পড়ে বাংলাদেশ যখন কিউবায় পাট রফতানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন খাদ্য সহায়তা আসতে আসতে তা দুর্ভিক্ষের জন্য দেরি হয়ে যায়।
বাংলাদেশ সরকারের অহব্বানে সাড়া দিয়ে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশ তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে।
অনেকের মতে সাহায্য আসার পরিমাণ দেশের চাহিদারও অতিরিক্ত ছিল বলে দাবি করেন।
এই কথার সত্যতাও পাওয়া যায়। ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সাড়ে সাত কোটি কম্বল, আমার কম্বল কই’ এই জিজ্ঞাসা ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।
তাদের মতে খাদ্য সামগ্রী প্রাপ্যতার সল্পতার কারণে বাংলাদেশে তখন দুর্ভিক্ষ হয়নি বরং বিতরণ ব্যবস্থার ব্যর্থতা আর আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের লুটপাটের কারণে দেশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। রিলিফের গুড়া দুধ,বিস্কুট, ডাল, তেল, টিন, কম্বল দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে না দিয়ে রাতের অন্ধকারে তারা ভারতে পাচার করে ।
নিজেদের আত্মীয় স্বজন পরিবার পরিজনের মধ্যে বিলি বন্টন করে।দলীয় নেতা কর্মীদের ত্রাণ সামগ্রীর চুরি চামারি,কালোবাজারি এবং দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে গুদামে মজুদ, ভারতে পাচারের এইসব দৃশ্য দেখে,
বঙ্গবন্ধু সংক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন,’দেশ স্বাধীন করে অন্যেরা পায় তেলের খনি, সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’।
আজ সারাবিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করেছে করোনা ভাইরাস। বাংলাদেশও এর আক্রমণের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা ভাইরাস বিস্তার রোধে সরকারের পক্ষ থেকে সারা দেশে সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে সরকারি, বেসরকারি অফিস-আদালত,শিল্প -কলকারখান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রিক্সা, ঠেলাগাড়ি,সিএনজি, টেক্সি, টেম্পো থেকে শুরু করে সকল প্রকার গণপরিবহন চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে দেশের লাখ লাখ শ্রমজীবী কর্মজীবী মানুষ। অসহায় হতদরিদ্র এই মানুষ গুলোর ক্ষুধা নিবারণে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য সামগ্রী সহ বিভিন্ন সাহায্য- সহায়তা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী আর দলের আনুগত্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিলি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এই সমস্ত ত্রাণ সামগ্রী। দলের নেতা কর্মী এবং এই জনপ্রতিনিধিরা অসহায়, হতদরিদ্র মানুষের ত্রাণ আত্মসাৎ করার সংবাদ প্রতিদিন উঠে আসছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। চাল-ডাল চুরি করে এক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এমন হাজারো ঘটনা ঘটছে। যার কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। যার কল্যাণে প্রশাসন এই নির্লজ্জ জনপ্রতিনিধি এবং দলীয় নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে।
পুলিশ সরকারি ত্রাণ সামগ্রী আত্মসাৎ এর অভিযোগে অনেক জনপ্রতিনিধিকে
ইতিমধ্যে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।
ঘটনা দৃষ্টে ৭৪ থেকে ২০২০ সময়ের ব্যবধান অনেক দীর্ঘ হলেও দলীয় জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা কর্মীদের অনেকেই তাদের পুরনো চরিত্রের পরিবর্তন আনতে পারেনি।
এই জন্যই আজ বহু পুরনো একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল।
‘স্বভাব যায় না মলে, খাছলত যায় না ধুলে।’
এ কে এম বেলায়েত হোসেন কাজল
ইতালি প্রবাসী ।
Hi, this is a comment.
To get started with moderating, editing, and deleting comments, please visit the Comments screen in the dashboard.
Commenter avatars come from Gravatar.