‘শাস্তি’ আর ‘প্রতিশোধ’- কখনোই এক জিনিস নয়। আমরা সভ্য রাষ্ট্রের আদালত কর্তৃক শাস্তি, আর বিচারহীন রাষ্ট্রের অসহায় জনগণের প্রতিশোধ গ্রহণের আকাঙ্খাকে এক করে ফেলেছি।
অপরাধীকে সুনির্দিষ্ট নিয়মে তার অপরাধবোধ আর অনুশোচনাকে জাগ্রত করে সংশোধন হবার সুযোগ দেওয়াকে বলা হয় ‘শাস্তি’। আর চোখের বদলে চোখ, হাতের বদলে হাত, কিংবা ধর্ষণ আর হত্যার বদলে হত্যা, এটাকে বলা হয় ‘প্রতিশোধ’।
কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করা একটা সভ্য আদালতের দায়িত্ব হতে পারে না। বিচারের ক্ষেত্রে একটা নৈতিক আর মানবিক অবস্থানই একটা সভ্য আদালতের মূল বৈশিষ্ট্য।
অন্যদিকে, একটা বিচারহীন রাষ্ট্রের নির্যাতিত আর হতাশাগ্রস্ত জনগণ বিচার না পেয়ে তাদের বাবার খুনির, বোনের ধর্ষিতার কিংবা সন্তানের নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চাইবে, এটাও স্বাভাবিক।
কিন্তু একটা আধুনিক আর সভ্য রাষ্ট্র বা তার আদালতের কি উচিত উত্তেজিত আর হতাশাগ্রস্ত জনতার একটা অমানবিক আর অনৈতিক দাবী মেনে নেয়া? একটা রাষ্ট্রের জনগণের গড় শিক্ষা আর মানবাধিকার সম্পর্কে জ্ঞান যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে রাষ্ট্র পরিচালক আর আইনপ্রণেতাদেরকে অবিবেচক আর অমানবিক হওয়া কি একটা জাতির জন্য বিপদজনক নয়?
তাছাড়া শুধুই ক্ষমতায় থাকার লোভে, কিংবা অসচেতন জনগণকে খুশী করতে মৃত্যুদন্ডের আইন প্রণয়ন করা কি একটা রাষ্ট্র আর তার জনগণকে আরো আদিম সময়ে নিয়ে যায় না?
একটা রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন আর জনগণ যদি একই সঙ্গে শিক্ষিত, সভ্য আর মানবিক পথে না এগোয়, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র আর তার আদালত ধর্ষণের মতো একটা ভয়াবহ সমস্যার সমাধানে সঠিক পথে না গিয়ে, বর্তমানে প্রচলিত আইনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ না করে, ক্ষুব্ধ আর হতাশাগ্রস্ত জনগণের একটা আদিম আর অমানবিক দাবীকে মেনে নিতে যাচ্ছে, যা পুরো জাতির জন্য আরো বিপজ্জনক হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের দাবীকে মেনে নিচ্ছে। কিন্তু, এরপরেও দেশে ধর্ষণের হার না কমলে এই জনগণই আবার ধর্ষকের প্রকাশ্যে ফাঁসি, শিরশ্ছেদ কিংবা লিঙ্গ কর্তনের দাবী তুলবে। সরকার কি তখন সেই দাবীগুলোও মেনে নেবে? এই সভ্য সময়ে একটা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর তার আদালতের নৈতিক আর মানবিক অবস্থান কি এতোটাই আদিম হওয়া উচিত।
– ওমর ফারুক লুক্স লেখক, অনলাইন এক্টিভিস্ট
ছবি- পৃথু সান্যাল