পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ও শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যক্তিত্ব,ভারতবর্ষের সিডিল কাস্ট ফেডারেশনের প্রতিষ্টাতা,তফসিলি সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক গুরু, পাকিস্তানের সংবিধান প্রণেতা হিসেবে প্রথম আইন ও শ্রম মন্ত্রী, কমনওয়েলথ ও কাশ্মীর বিষয়ক দ্বিতীয় মন্ত্রীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি।
তাঁর নাম ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। ১৯০৪ সালের ২৯ জানুয়ারি যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বরিশাল জেলার মৈস্তারকান্দিতে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা রামদয়াল মণ্ডল ও মাতা সন্ধ্যা দেবী।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট থেকে ১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তানের সাবেক রাজধানী করাচীতে বসবাস করে মুসলিমলীগের রাজনীতি করেছেন। সিলেট জেলা ও খুলনা জেলা পাকিস্তানে অর্ন্তভূক্ত হওয়ার জন্য ভারতের বাঙ্গালীরা ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে দায়ী করেন। তিনি যোগেন আলী মোল্লা নামে পশ্চিম পাকিস্তানে পরিচিত ছিলেন।
১৯২৪ সালে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল অংক ও সংস্কৃতে লেটার নিয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।
১৯২৬ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাশ করেন।
১৯২৯ সালে বিএ পাস করেন।
১৯৩৪ সালে লন্ডন থেকে ব্যারিষ্টারি পাশ করেন।
১৯৩৪ সালে কলকাতার হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন।
১৯৩৬ সালে বরিশাল জজ কোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন এবং বরিশাল লোকাল বোর্ডের সদস্য হন। সেসময় হতেই সামাজিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণীর উন্নতিসাধনে জনসেবামূলক কাজকর্মে যুক্ত হন।
১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায় নির্দলীয় প্রার্থী হিসাবে লড়াই করে পরাজিত করেন কংগ্রেসের প্রার্থী জমিদার সরল দত্তকে। এরপর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও শরৎ চন্দ্র বসুর অনুসারী হয়ে পড়েন।
১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় বিধানসভায় তফশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যদের নিয়ে তিনি ‘ইনডিপেনডেন্ট শিডিউলড কাস্ট পার্টি’ নামে একটি নিরপক্ষ তফশিলি দল গঠন করেন।
১৯৪০ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করলে ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সদস্য হন ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। সেইসময় বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দলিত সম্প্রদায়ের বাংলা শাখা খোলেন।
১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রী সভা গঠন করলে ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ২১ জন তফসিলী সদস্য নিয়ে সমর্থন করলে সমবায় ও ঋণদান বিষয়ক মন্ত্রী হন। তফসিলী সম্প্রদায়ের প্রেমবিহারী বর্মন ও পুলিন বিহারী মল্লিক মন্ত্রী হন।
১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে যাতে দাঙ্গায় জড়িয়ে না পড়েন তাতে তিনি বারণ করেন। ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের দাবী ছিল, কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের মধ্যে বিবাদে ধবংস হতে পারে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়।
১৯৪৬ সালে ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারের আইনমন্ত্রীর দায়িত্বভার পালন করেন।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল যেসব এলাকায় দলিত সম্প্রদায়ের ভোটার বেশি ছিল সেই সব এলাকায় মুসলিমলীগ প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেন এবং তাঁদের জিতিয়ে আনেন। ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সব সময় হিন্দু নিম্ন সম্প্রদায় – মুসলিম লীগ একতার জন্য কাজ করেছেন। ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল মুসলিমলীগের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বঙ্গীয় আইন পরিষদে বাকেরগঞ্জ উত্তর-পূর্ব সাধারণ সংসদীয় এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা হয় সর্বভারতীয় নিম্নবর্ন সম্প্রদায় ফেডারেশনের (All India Scheduled Caste Federation) বাংলা শাখা। দলিতদের এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডঃ বি আর আম্বেদকার। যিনি বাবাসাহেব আম্বেদকার হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। নিজেও একজন দলিত ছিলেন, তবে তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত।
ডঃ আম্বেদকার অর্থনীতিতে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ভারতবর্ষের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে ছিলেন একজন অচ্ছুত। সে সময় ডঃ আম্বেদকার ও ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ভারতের ছয় কোটি দলিত সম্প্রদায়ের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দলিত সম্প্রদায় ও ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল রাজনীতিতে জিন্নাহর মুসলিম লীগের অন্ধ সমর্থক হয়ে পড়েন।
১৯৪৬ সালে ভারতবর্ষের কংগ্রেস পণ করেছিল কোনো দলিত সম্প্রদায়ের লোককে ভারতের গণপরিষদে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। দলিতদের অবস্থা এতই শোচনীয় ছিল যে কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লবভাই প্যাটেল জনসম্মুখে বলেন, ডঃ আম্বেদকারের জন্য সংসদের দরজাই শুধু বন্ধ করে দেওয়া হবে না এমনকি সব জানালাও বন্ধ করে দেওয়া হবে।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ডঃ আম্বেদকারকে তাঁর সংসদীয় এলাকা মহারাষ্ট্র থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
ব্যারিষ্টার যোগেন মণ্ডল তাঁর নেতা ডঃ আম্বেদকারকে যশোর-খুলনা নির্বাচনী এলাকা থেকে দাঁড় করিয়ে তাঁকে সেখান থেকে জিতিয়ে আনেন। যে আম্বেদকারের প্রতি কংগ্রেস নেতারা অবিচার করেছিলেন সেই ব্যক্তি ভারতের গণপরিষদের শুধু সদস্যই হননি তাঁকে ভারতের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়কও করা হয়।
১৯৪৭ সালের ৬ এবং ৭ জুলাই সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। সিলেট জেলা পাকিস্তানে যোগ দেবে নাকি ভারতের অংশ হবে এ দ্বিধায় ছিল। তখন সিলেট জেলা আসাম প্রদেশের অংশ ছিল। আসাম ও সিলেট মিলে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যার অনুপাত ছিল অনেকটা সমান সমান। সিলেট জেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার ছিল নিম্নবর্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা যেদিকে সমর্থন দেবে পাল্লা সেদিকে ভারী হবে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুরোধে ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সিলেট জেলায় গিয়ে সুনামগঞ্জের অক্ষয় কুমার দাস ও হবিগঞ্জের বিপিন বিহারী দাসকে নিয়ে নিম্ন বর্নের হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য জোর প্রচারণা চালান। শেষ পর্যন্ত গনভোটে জয়ী হয়ে সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান স্বাধীন হলে ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ও তাঁর নিম্নবর্ন হিন্দু অনুসারীরা দেশ ত্যাগ না করে পূর্ব পাকিস্তানেই রয়ে যান। ৬৯ সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। জিন্নাহ ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রী নিয়োগ করেন। পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ও অস্থায়ী সভাপতি হন। দলিত শ্রেণীর নেতা হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল কতকগুলো সাধারণ বিষয় নিয়ে মুসলিম লীগের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। তিনি আশা করেছিলেন যে, এরফলে দলিত শ্রেণীর লোকেরা লাভবান হবে। ফলশ্রুতিতে তিনি নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের মন্ত্রীসভায় আইন ও শ্রম মন্ত্রী হন। এর মাধ্যমে সরকার প্রশাসনে সর্বোচ্চ স্তরের হিন্দু সদস্য হন।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যু হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পাকিস্তানকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করলে ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মানসিকভাবে অসহায়ত্ব বোধ করেন।
দিল্লি থেকে পাকিস্তানে চলে আসা ষড়যন্ত্রে পটু ও কট্টর সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের আমলা চৌধুরী মোহাম্মদ আলী (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী)। তিনি বৃটিশদের একজন অত্যন্ত আস্থাভাজন আমলা ছিলেন। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের মন্ত্রিপরিষদের সচিব নিযুক্তি হন।
চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর অভ্যাস ছিল সরকার বা মন্ত্রিপরিষদে যত হিন্দু বা সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর সদস্য বা কর্মকর্তা ছিলেন তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করা এবং বিতাড়িত করা।
ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল একসময় লক্ষ করেন তাঁকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল না দেখিয়ে মন্ত্রিপরিষদের সচিব চৌধুরী মোহাম্মদ আলী সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। তাকে কোন পাত্তাই দিতেন না।কোন মানুষই মনে করতেন না। এতে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মন ভেঙে যায়।
১৯৫০ সালে পুর্ব পাকিস্তান জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। বরিশাল ও খুলনা জেলায় নমঃসূদ্র সম্প্রদায়ের লোকদের উপর আক্রমন চলে। নমঃসূদ্র সম্প্রদায়ের অনেক লোক নিহত হয়।
১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে ” পাকিস্তানে হিন্দুদের পক্ষে বসবাসপযোগী স্থান নহে” ইস্তফাপত্র দিয়ে ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল পাকিস্তান ত্যাগ করে পালিয়ে কলকাতায় চলে যান।
১৯৫২ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালু হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের অনুসারী নিম্নবর্নের হিন্দুরা অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং দলে দলে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করতে থাকেন।
১৯৬৩ সালে ডঃ আম্বেদকারের রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন।
১৯৬৭ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভারতের রিপাবলিকান পার্টি থেকে বামফ্রন্টের সমর্থন পেয়েও পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত আসন থেকে পরাজিত হন।
ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের দুর্ভাগ্য ভারতে গিয়েও কলকাতার মানুষও তাঁকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। সবসময় ঘৃনার চোখে দেখেছেন।বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।পশ্চিমবাংলার মানুষের ধারনা ছিল,ব্যারিষ্টার যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের কারনে ভারত বৃহত্তর সিলেট জেলা ও বৃহত্তর খুলনা জেলা হারিয়েছে।
১৯৬৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ জেলায় যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল মৃত্যুবরণ করেন।
নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের কাছেও তিনি হয়ে গেলেন খুবই অবহেলিত। হিন্দুদের কাছে হলেনএকজন ঘৃনিত ব্যক্তি।
বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল যিনি নিজেই পাকিস্তানের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন কিন্তু তাঁর সেই অবদান পাকিস্তান রাষ্ট্র কোনদিন মনে রাখেনি। যারা ইতিহাস নির্মান করেন তারা ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যান।
তেমনি ইতিহাসের পাতা থেকে একেবারেই হারিয়ে গেলেন “বরিশালের যোগেন মন্ডল “।
অনুলিখনঃ আরিফুল হক তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট