আজ বাঙ্গালী জাতির জীবনের চির অম্লান, চির স্মরণীয় একটি দিনটি, দিনটি গর্ব আর অহঙ্কারেরও। এই দিনেই পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম রচিত হয়।
জিন্নাহ’র দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক একটি অসম রাষ্ট্রকে বাঙ্গালীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। দিনের পর দিন পাকিস্তানী বর্বর শাসক গোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী একে একে গড়ে তোলে আন্দোলন-সংগ্রাম।
এরই ধারাবাহিকতায় ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২- এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে বিজয়, সবশেষে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে বাঙ্গালীর চূড়ান্ত বিজয়। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় এই বিজয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪.৩১ মিনিটে ঢাকার রমনা রেস কোর্স ময়দানে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী মিত্র বাহিনীর জেনারেল জগজিত সিং অরোরার সামনে আত্মসমর্পণের সই করেন। পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল তিন প্রস্থে প্রস্তুত করা হয়েছিল।
একটি প্রস্থ ভারত সরকার এবং দ্বিতীয় প্রস্থ পাকিস্তান সরকারের কাছে আর তৃতীয় প্রস্থ আছে ঢাকার শাহবাগ জাদুঘরে । যে টেবিলে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা ঢাকা ক্লাব থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই টেবিলটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৭ নম্বর প্রদর্শনী কক্ষে সংরক্ষিত আছে। আত্মসমর্পণের দলিলের নাম ছিল “INSTRUMENT OF SURRENDER”।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসিত ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অংশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে। জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা ঘটে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে উপায়ন্তর না দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে তারা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
তখন ভারতের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী বলেন “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে”। ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরী করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে:
(১) পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালী অভিমুখে।
(২) উত্তরাঞ্চল থেকে দু’ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে।
(৩) পশ্চিমাঞ্চল থেকে দু’ডিভিশনের সমন্বয়ে গঠিত ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে।
এবং
(৪) মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আর একটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে।
যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারা দেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানীরা পিছু হটতে শুরু করে। একের পর এক পাকিস্তানী ঘাঁটির পতন হতে থাকে। পাকিস্তানীরা অল্প কিছু জায়গায় তাদের সামরিক শক্তি জড় করেছিল; যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
বাংলাদেশের আপামর জনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পর্যদুস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তান ৯৩,০০০ সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাক্ষরিত হয় আত্মসমর্পণের দলিল। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙ্গালী জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সম্পাদনা
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, ভারতীয় ও বাংলাদেশী বাহিনীর যুগ্ম কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ সেনাপ্রধান, এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার আত্মসমর্পণে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানী নৌ-পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার রিয়ার-অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শরিফ এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বিমান বাহিনীর কমান্ডার এয়ার ভাইস-মার্শাল প্যাট্রিক ডেসমন্ড কালাঘান।
যারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন
বাংলাদেশের পক্ষে, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার আত্মসমর্পণের সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।
ভারতের পক্ষে, ভারতীয় ৪র্থ কোরের কমান্ডার লেঃ জেনারেল সগত সিং, পূর্বাঞ্চলীয় বিমান বাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চাঁদ দেওয়ান, ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।
দলিলে যা লেখা ছিল তা হল:
“পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশী নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে। ”
তবে স্বাধীনতা বিরোধী একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখনও এই জাতির উপর চেপে বসে আছে। চেতনার নামে অগণতান্ত্রিক শাসন চলছে। লুট টাকা পাচার নৈমেত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সব গণ শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গোটা জাতিকে আজ ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে, জাতি হবে কলঙ্কমুক্ত। এই প্রত্যাশায় মহান বিজয় দিবসে লাখো শহীদের স্মৃতির প্রতি আবারও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ।
– আরিফুল হক রোম,ইতালী