সরকার করোনা মোকাবিলায় তিন মাস আগে থেকেই সম্পূর্ণ প্রস্তুত। শুধু পর্যাপ্ত পরিমাণ মাস্ক নাই, পিপিই নাই, আইসিইউ নাই, ভেন্টিলেটর নাই, টেস্ট কিট নাই, ল্যাব নাই। থাকার মধ্যে আছে মন্ত্রী এমপিদের বক্তব্য জুড়ে বড় বড় কথার ছড়াছড়ি আর তেলবাজি। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
ফেব্রুয়ারি মাস। দেশের সচেতন মানুষ করোনা ভাইরাস নিয়ে চিন্তিত। এই ভাইরাস মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে দাবী করার পরই সরকার হুশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়েছে একটি গোষ্ঠী করোনা নিয়ে ভীতি ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আরও জানানো হয়েছে করোনা মোকাবিলায় যে কোনো উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি ভালো। মন্ত্রী এবং সরকার দলীয় এমপিরা নিশ্চয়তা দিয়েছেন, দেশে করোনা ভাইরাস আসবে না, কারণ প্রধানমন্ত্রী তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন, প্রধানমন্ত্রী আল্লাহওয়ালা মানুষ। করোনা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে যখন ব্যপক জনসমাগম এড়িয়ে চলার প্রেসক্রিপশন মানা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। তখন অর্থাৎ ফ্রেব্রুয়ারির ১তারিখে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কমিশনার নির্বাচন আয়োজন করা হয়। এই নির্বাচন আয়োজনে সচেতন জনগণ প্রতিবাদ জানালে নির্বাচন কমিশনার ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের মত জানান যে, নির্বাচনে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চট্রগ্রামে শেষ মুহুর্তে নির্বাচন বাতিল করা হয়। কিন্তু তার আগেই চলে ব্যপক জনসমাগম ও নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা। দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হবার পরও অর্থাৎ ২১মার্চ গাইবান্ধায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনী এলাকাতেই পরবর্তীতে করোনা পজেটিভ রোগী পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের একগুয়েমির কারণেই অনুষ্ঠিত হয় এসব নির্বাচন। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
মার্চের ৮তারিখে বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ৩জন রোগী সনাক্ত হয়। এর প্রেক্ষিতে সচেতন মানুষ লকডাউন চাইলো। কিন্তু সরকার থেকে একে বলা হলো ভীতি ছড়ানো। জানানো হলো – করোনা নিয়ে ভীতি ছড়ালেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর ১৭মার্চ পর্যন্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। জাতির পিতার জন্মদিনের কেক কাটা আর আতশবাজি উৎসবে ব্যাপক জনসমাগম। এই জনসমাগম নিয়ে যারা প্রশ্ন তুললো এবং আবারও লক ডাউন চাইলো তাদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হলো। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
জাতির জনকের জন্মদিন পালনের পরদিনই সবকিছু বদলে গেলো। যেনো ১৮মার্চ হঠাৎ করেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ গুণ আকাশ থেকে অবতরণ করলো। তবে ১৯ মার্চ একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী জানালেন, লক-ডাউন করে ভীতি ছড়ানোর মতো পরিস্থিতি এখনো হয় নাই। সচেতন জনগণ ফের লক ডাউন চাইলো। এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা এর আগে থেকেই দেশে ফিরে আসছিলেন। সংক্রমণ রোধে তাদের জন্য বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সরকারি উদ্যোগে কোয়ারাইন্টাইনের দাবী তোলা হলো। সরকার থেকে নিশ্চিত করলো করোনা নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরে থার্মাল মেশিন বসানো হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরই জাতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেলো বিমানবন্দরে বসানো সবগুলো থার্মাল মেশিন নষ্ট। গণমাধ্যম আরও জানালো, বিমানবন্দরে মাত্র ৫০০টাকার বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে করোনা মুক্তির সার্টিফিকেট। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
প্রবাসীদের কোয়ারাইন্টাইনের জন্য শেষ মূহুর্তে আশকোনা হাজি ক্যাম্পে কেন্দ্র খোলা হলো। বিশাল ফ্লোরে নোংরা ম্যাট্রেস আর মশারি দিয়ে তৈরী করা হলো গণ কোয়ারাইন্টাইন সেন্টার। প্রবাসীরা থাকতে রাজী হলেন না। করোনা ভাইরাস বিস্তারের আশঙ্কায় তখন গণহারে দায়ী করা হলো প্রবাসীদের। মন্ত্রীদের কেউ কেউ পর্যন্ত প্রবাসীদের তিরস্কার করলেন। প্রবাসীদের প্রতি সহমত ভাই এবং আয়োডিনলেস প্রজন্মের সে কি গালির স্রোত। ওই কোয়ারাইন্টাইন সেন্টারের ছবি আর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসার পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানালেন- ওখানে থাকলে করোনা সনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ দূরের কথা, নিউমোনিয়া আক্রান্ত হবার আশঙ্কা অত্যাধিক। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী সনাক্ত হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সংক্রমণ রোধে লক ডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্তের ১৭দিন পর ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি, লক ডাউন নয়। গত ২৩ মার্চে ২৬মার্চ হতে ৫এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এই ছুটি ঘোষণার সময় ঘরে থাকার এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষার অনুরোধ/আহ্বান জানান হয়, নির্দেশ নয়। খোলা রাখা হয় গণ পরিবহন। কর্মসূত্রে শহরে আসা মানুষ দলে দলে নিজ এলাকায় ফিরে যেতে শুরু করে। খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ যায় কক্সবাজারে ছুটি কাটাতে। সহমত ভাই এবং আয়োডিনলেস প্রজন্ম করোনার সংক্রমণ বিস্তারে নতুন করে দোষারোপ শুরু করে এসব সাধারণ মানুষদের। অথচ সরকার হতে শহর ছাড়ার ব্যাপারে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। এই মানুষগুলোকে জানানো হয়নি গণপরিবহন খোলা রাখা হয়েছে শুধু চালক আর হেল্পারদের হাওয়া পানের জন্য। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
এপ্রিলের ৩ তারিখে ফের ১১এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সবথেকে দরিদ্র ব্যবসায়ী সম্প্রদায় গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন পোশাক শ্রমিকদের ফিরে আসার নির্দেশ দেয়। ৫এপ্রিল তারিখে তাদের কাজে যোগ দেবার নির্দেশ দেয়। তাই পোশাক শ্রমিকরা দলবেধে একশো দেঁড়শো কিলোমিটার পায়ে হেটে কাজে যোগ দিতে শহরে আসে। এবার করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তারে পোশাক শ্রমিক এবং মালিকদের প্রতি দোষারোপ শুরু হয়। বর্তমান জাতীয় সংসদের সদস্যদের মধ্যে গার্মেন্টস কারখানার মালিকরা আছেন, মন্ত্রীত্বেও আছেন, মেয়রগিরিতে আছেন। আবার গার্মেন্টস কারখানার মালিক সংগঠনের অধিকাংশ নেতাই সরকারপন্থী অথচ শ্রমিকদের এভাবে ডেকে আনার ব্যাপারে সরকার কিছুই জানতো না। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
সরকারি ছুটি ঘোষণার সময়সীমা ৫এপ্রিল হতে বাড়িয়ে ১১এপ্রিল, এরপর ১৪এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। সর্বশেষ ২৫এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি বাড়িনো হয়। ১৬এপ্রিল সন্ধ্যায় ‘সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল আইন ২০১৮’র ক্ষমতাবলে সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। অবশ্য এর আগে থেকেই প্রায় সকল মিডিয়ায় একযোগে পাইকারি বাজারে জনসমাগমের ছবি ছাপতে থাকে। এবার করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তারে দোষারোপ শুরু হয় পাইকারী বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাদের প্রতি। যেনো ক্রেতা-বিক্রেতারা পাইকারি বাজারে হাওয়া খেতে, আড্ডা দিতে, মৌজ-মাস্তি করতে বা ডেটিংয়ে যায়। সরকার যেনো পাইকারি বাজারের যথাযথ ব্যবস্থাপনা করে দিয়েছে অথচ কেউ মানছে না, সরকার ঘরে ঘরে খাবার পৌছে দিচ্ছে কিন্তু কেউ নিচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে পুরো সরবরাহ চেইন ভেঙে পরেছে। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
গতকাল শুক্রবার একজন প্রখ্যাত ইমাম মারা গেছেন। আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার জানাজায় বিশাল জনসমাগম হয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক মানুষ আকাশ থেকে টুপ করে পড়েনি। এরা আশপাশের জেলা থেকে দলে বেঁধে এসেছে। সড়কে সড়কে চেকপোস্ট, তবু এদের আসতে কোনো সমস্যা হয়নি। দেশকে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পরও প্রশাসন এই জনসমাগমে কোনো বাঁধা দেয়নি। জনসামগমে উপস্থিত ব্যক্তিদের নিজ এলাকায় ফিরে যেতেও কোনো সমস্যা হয়নি। অথচ আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানা হওয়ার কথা। প্রশাসন আন্তরিক হলে সেনাবাহিনী দিয়ে এই জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা যেত, কিন্তু করা হয়নি। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
গত ক’দিন ধরেই গার্মেন্টস কর্মীরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করছে। এদের অনেকেরই দু’তিন মাসের বেতন বাকী। সরকার দরিদ্র গার্মেন্টস মালিকদের প্রতি ভীষণ মানবিক। তাই তাদের চাপ দিয়ে শ্রমিকদের বেতন আদায় করে দিতে পারছে না। এদিকে ত্রাণের জন্যও প্রতিদিনই বিক্ষোভ হচ্ছে। কারণ, ক্ষুধার্ত মানুষ ত্রাণ পাচ্ছে না। সরকার চাহিদা অনুযায়ী ত্রাণ দিতে পারছে না। জেলা প্রশাসকদের অধিকাংশই আজ পর্যন্ত তাদের জেলার ত্রাণ প্রাপ্য মানুষদের তালিকা করে পাঠাতে পারেননি। এদিকে বাজার দর উর্দ্ধমুখি, সরবরাহ চেইন ভেঙে পরায় এক বাজার থেকে আরেক বাজারে ঘুরছে মানুষ। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
প্রথম থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মীরজাদি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বারবার জানিয়েছেন যে করোনা মোকাবিলায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। এন-৯৫ মাস্ক, পিপিই, করোনা টেস্টকিটের কোনো অভাব নেই। অথচ বাস্তবতা হলো এসব অত্যাবশ্যক জিনিস এখনো চিকিৎসকদের হাতে পৌছেনি। পিপিই-এর নামে পৌছেছে রেইনকোট, এন-৯৫ মাস্কের পরিবর্তে নকল মাস্ক। ফলে ৯০ জনের বেশী চিকিৎসক এবং অর্ধশতাধিক চিকিৎসা সহযোগী/নার্স এখন করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত। ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। হট লাইনে ফোন দিয়ে কানেকশন পাওয়া যাচ্ছেনা, করোনা লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের এপি সেন্টার হিসেবে কথিত নারায়ণগঞ্জে আজ পর্যন্ত করোনা পরীক্ষায় ল্যাব স্থাপন করা যায়নি। টেলিভিশন মারফৎ আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রী জানেনই না করোনার এপি সেন্টার হিসেবে চিহ্নিত জেলায় ল্যাব নেই। আরও দেখেছি স্বাস্থ্য সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কতটা সাবলীলভাবে প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে এবং প্রধানমন্ত্রী তাতে আস্থা রাখেন। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
সাধারণ জনগণের দোষ এখানেই শেষ নয়। সারাবিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে ভীত, বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে, ভয়াবহ সংক্রামক করোনা ভাইরাস তার থাবা বিস্তার করছে, তখন সরকার জাতির পিতার জন্মদিন উদযাপনে অফিসে অফিসে জনসমাগমে কেক কাটতে এবং বিশাল দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে কনসার্ট ও আতশবাজির উৎসব পালনে আপোষহীন। কিন্তু ভাইরাস তো উৎসব জানেনা, জানে সংক্রমণের ব্যাকরণ। সুতরাং করোনা সংক্রমণের সব দোষ কার? অবশ্যই জনগণের।
.
করোনা মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতির অভাব, সমন্বয়হীনতা এবং সীমাহীন ব্যর্থতা ঢাকার একটাই মাত্র পথ খোলা, তা হচ্ছে সকল দোষ সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। ওই পথেই পরিকল্পিতভাবে হাঁটছে সরকার। সুযোগ বুঝে জনগণকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী দু’টো কথা বললেই হবে, বাকীটা সহমত ভাতৃসংসদ এবং আয়োডিনলেস প্রজন্ম প্রতিষ্ঠা করে দেবে। সুতরাং এখন থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন, সরকারের কোনো দোষ নেই, দেশব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সব দোষ জনগণের।
১৮এপ্রিল, ২০২০
আবু সাঈদ আহমেদ: লেখক ও সাংবাদিক