স্বদেশী নব্য জমিদারেরা ভূমি গ্রাস ও ত্রাসের শাসন সৃষ্টির জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদ আর ধর্মীয় মৌলবাদের কাঁচামাল দিয়ে রামুর বৌদ্ধ বসতি থেকে নাসির নগর অথবা শাল্লার হিন্দু বসতি, মীরপুরে বিহারী বসতি অথবা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আগুন দেয়। ভাওয়ালপিণ্ডি তখন ব্যস্ত থাকে হিন্দু উগ্রবাদের বরপুত্র জয়শ্রীরামের জন্য শাকা নগরীর রেডকার্পেট সম্বর্ধনা আয়োজনে; হিন্দু মন্দির পরিদর্শন করে; পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন সামনে রেখে হিন্দুত্ববাদের ঘাঁটি মজবুতের সর্পাসনযজ্ঞের সহযোগিতায়। অসাম্প্রদায়িকতার দুধের নহর বইছে যেন শিবমন্দিরের আশপাশে।
দেশের মধ্যে এতোগুলো ভাওয়ালপিন্ডির ত্রাসনে পরাধীন মানবদ্বীপের অবরুদ্ধতার বিষাদসিন্ধুতে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির মূর্তিউন্মোচন উতসব। এই মূর্তির অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদের আদর্শের মাঝ থেকে কেবল উগ্রজাতীয়তাবাদ নিয়ে; ক্ষমতার পোল ডান্সারের সকালের প্রাতঃক্রিয়া না হলে তার জন্য একাত্তরের প্রেতাত্মাকে গালি দিয়ে দর্শককে সেই নট-নর্তক চড়িয়ে দেয় টাইম মেশিনের ইলিউশানে। ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা শাস্ত্র’-র সূতিকাগার শাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পাশে স্বাধীনতা পূর্তির বছরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসানেরা নীলক্ষেত বাজারে ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’ নেচে বেড়ায়।
রাতে সেখানে ভাওয়াল পিন্ডির শেয়াল কিংবা খানসামা এসে এক পলকের ছোট্ট দেখা ভাইয়াকে বোঝায়; একাত্তরের মতো একটা যুদ্ধ সাইবার জগতে করে আমরা মুক্তিযোদ্ধা টু পয়েন্ট জিরোর দক্ষিণীয় বা সম্মান গামছা পরতে চাই স্বাধীনতা পদকের হীরের মালা দেবার আসরে। বিদূষকেরা বোঝায়, সাইবার জগতে পাকিস্তানের পরাজিত শক্তিরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী প্রচারযুদ্ধ চালাচ্ছে। আমরা এর বিরুদ্ধে সাইবার যোদ্ধা হতে চাই; শুধু একটু একসেস টু টেকাটুকা (এটুটু) চাই ‘পড়েনা চোখের পলক ভাইয়া”। একাত্তরের ইতিহাসের প্রাইসট্যাগ যেন টেকাটুকার এক্কা-দোক্কার জুয়াঘর।
‘এক পলকের ছোট্ট দেখা” ভাইয়া বলেন, ঠিক আছে আরেকটু বেশি দেখা হলে ক্ষতি কী। তাতে শীর্ষপ্রাসাদ খুশি হবে। বুঝবে আমি ভালো পারফর্ম করছি।
অথচ ভারতে ও পাকিস্তানে একাডেমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষিত গবেষকেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এতো ভালো গবেষণা করছেন; যে গ্রন্থগুলো গোটা বিশ্বের জেনোসাইড স্টাডিজের পাঠ্য হবে। এছাড়া বাংলাদেশের নাগরিক সংগঠন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাখা সংগঠন পাকিস্তান সেক্যুলার ফোরাম ২০১২ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাকিস্তানের বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরার কাজ করছে নিয়মিতভাবে। পাকিস্তানের কোন হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসী-অন্যান্য সংখ্যা লঘু উপাসনালয়ে, বসতিতে কিংবা সূফি মাজারে হামলা হলে এই সেকুলার ফোরাম সদস্যরা সেখানে দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছে সমাধান দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করেন। অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সভা ও খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী সীমা কিরমানির নেতৃত্বে শান্তিপ্রত্যাশী ধামাল নৃত্য। উদারপন্থার পক্ষে এই লড়াই চলছে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের উদারচিন্তার নেতা শাহরিয়ার কবিরের উদ্দীপনায়। পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কতটুকু জানে তা বুঝতে; অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেছেন শাহরিয়ার কবির।
পাকিস্তানে সম্প্রতি লাহোরের লামস বিশ্ববিদ্যালয়; মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেমিনার আয়োজন করেছিলো ২৩ মার্চ। কিন্তু রাওয়ালপিন্ডির প্রেতাত্মারা তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের ফুটসোলজার দিয়ে টুইটারে ফোনে নানারকম হুমকি দিয়ে এই আয়োজন বন্ধ করে দেয়। ২২ মার্চ পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, পারভেজ হুডবয়ের মতো বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের লেখিয়েরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের সমস্ত লেখা অনলাইনে শেয়ার করতে থাকেন; এদের সমর্থনে অনলাইনে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ছিলো নাগরিকদের। তাদের কথা হচ্ছে, ৫০ বছর পরেও যদি একাত্তরের অন্যায়ের কথা উচ্চারণ না করা যায়; সে দেশ তো স্বাধীন নয়। এই প্রশ্নটি “ইয়ে আজাদি ঝুটি হ্যায়” অনুরণন তোলে সমাজ মানসে। যে সেমিনার অনুষ্ঠিত হলে, আর পাঁচটা ওয়েব শো’র মতো অল্প দর্শকের মাঝে প্রচারিত হতো; সেই সেমিনার নিষিদ্ধের তকমা হয়ে পড়ায়; সেদিকে এখন মনোযোগ সবার।
কী সেই একাত্তরের ইতিহাস! যা পাকিস্তানের ডিনাইয়াল রোগীরা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা দিলেন। এখন পাকিস্তানে টক অফ দ্য টাউন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আগামিকাল করাচি লিটেরেরি ফেস্টিভ্যালে আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসবে বিভিন্ন আলোচনায়। সত্য এমনই আবেদনময়ী প্রেমিকার মতো। সত্য যেন ইভের আপেলের মতো; নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ থেকেই তো আদম আকর্ষিত হয়েছিলেন গন্ধম ফলে। পাকিস্তানের চিন্তার জগতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যখন ‘গন্ধম’ ফলের মতো আকর্ষণীয়। এতে কামড় দিয়ে ডিনাইয়াল মুক্ত হতে পারলেই জার্মানির মতো নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে, অনুতপ্ত হবার, এগিয়ে যাবার সভ্য সুযোগ।
কাজেই পাকিস্তানের সচেতন সমাজ তা হাতছাড়া করে কীভাবে। আর এই একাত্তরের পরাজিত চিন্তার মৌলবাদ; জাতীয়তাবাদের ফুটসোলজারেরা তো গত ৫০ বছরের পাকিস্তানেও লুন্ঠনের, ভূমি খাওয়ার বোমা হামলার, শিশুদের স্কুলে ঢুকে শিশু হত্যার মতো নরভোজি নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। তাই ১৯৭১ এর সত্যের মাঝে নিজের বর্তমান উপায়হীনতার সত্য খুঁজছে পাকিস্তানিরা। ফলে নিজের প্রয়োজনের পাকিস্তান এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ করছে, লেখালেখি করছে, নানা ফোরামে আলোচনা করছে; যে আলোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন্ড তৈরি করেছে।
এইসময় পাকিস্তানের ভূমি বাস্তবতার কথা না জেনেই হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সেনাপতি হয়ে ‘এক পলকের ঝলক’ দেখাতে চাইছেন; যে শেয়াল ও খানসামা, ইতিহাসান নৃত্যের এক এক রাতে রাজকোষ থেকে মোহর ঝরবে। এইভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মুনতাসির ফ্যান্টাসি’ ফার্মার্স ব্যাংকের মোহর গলধকরণ করেছে। ইতিহাসের আর ধর্মের দোকানদারিতে; নীলক্ষেতের কলতলার “ফেইক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সার্টিফিকেট’ বিক্রির নিলামঘরের হৈ চৈ, বাবুদের নাগরীতে হেলিকপ্টারে করে নেমে তীব্র আর্তনাদে ‘সহি মুসলমানের সার্টিফিকেট নিলাম’-এর শোকরানা মেহেফিলে; চাপা পড়ে যায়, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মবাদের পতাকা উড়িয়ে অবরুদ্ধ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-দরিদ্র মুসলমান-বিহারি-রোহিঙ্গা উচ্ছেদ করে ভূমি দখল ও নতুন বাংলাদেশের চেতনার হাউজিং সোসাইটি কিংবা মদিনা মডেলের হাউজিং সোসাইটি রচনার এই যে নরভোজি ফ্যান্টাসির ট্র্যাজেডি; এটাকেই কী মুনতাসির ফ্যান্টাসি বলবো!
(এই লেখাটি শিক্ষাগুরুর মৃত্যুর কারণে আমার অসমাপ্ত রয়ে যাওয়া পিএইড-থিসিস সুপারভাইজার নাট্যাচার্য সেলিম আল-দীন এর প্রতি শ্রদ্ধা উপহার)