প্রিয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা, আমার ভালোবাসা জেনো। আমি খুব ভাল করেই জানি তোমরা আমাদের সমাজে ধনী-গরীবের বাড়তে থাকা ব্যবধানে অধিকার বঞ্চিত শিশু। তোমাদের পিতা-মাতা তোমাদের লেখাপড়া ও সামান্য অন্নসংস্থানের সুযোগ খুঁজতে মাদ্রাসায় পাঠান। এতো অল্প বয়সে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তোমরা ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা অর্জনের চেষ্টা করো। তবে পবিত্র কুরান এমন একটি গ্রন্থ যা পুরোপুরিভাবে বুঝতে অন্যান্য অনেক বিষয় সম্পর্কে জানা জরুরী। আর এরকম একটি জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ পাঠ করে এর অর্থ তোমাদেরকে বোঝানোর মত সামর্থ্য তোমাদের কজন শিক্ষকের রয়েছে আমি নিশ্চিত নই।
তোমরা এতো অল্প বয়সে মাদ্রাসায় চলে যাও যে তোমাদের মা-মাটি-মানুষ সম্পর্কে অনেক ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার একটি ষড়যন্ত্র করা হয় তোমাদের বিরুদ্ধে। আজ থেকে বহু বছর আগে কত মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানী সভ্যতার জন্য অনেক অবদান রেখে গেছেন। অথচ তোমাদের দর্শন-বিজ্ঞান থেকে দূরে রেখে কেবল মসজিদের ঈমাম-মুয়াজ্জিন হবার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়। এমনকি কী এতো দুর্বল আরবী শেখানো হয় যে আরব দেশগুলোতে কাজ করতে গিয়ে মাদ্রাসার ছাত্ররা টের পায় আবার নতুন করে সব শিখতে হবে। এছাড়া মাদ্রাসায় কোন কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে অত্যন্ত কম মজুরীতে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়।
তোমরা-আমরা আতরাফ মুসলমান। ইসলামে কোন শ্রেণী বৈষম্য না থাকলেও আশরাফেরা নিজেদের আজীবন অভিজাত মুসলমান হিসেবে ধরে রাখতে আমাদের আতরাফদের জন্য প্রচলন করেছিলো এই মাদ্রাসাশিক্ষা। ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষা প্রচলিত হবার পর হিন্দু ধর্মের মানুষেরা দ্রুত সে শিক্ষা অর্জন করে। আর কতিপয় কথিত আশরাফ মুসলমান মওদুদী নামে এক আত্মকেন্দ্রিক লোকের প্ররোচনায় মুসলমান ছাত্রদের আধুনিক শিক্ষায় বাধা দেয়। আতরাফদের আতরাফ করে রেখে আজীবন শোষণের এক কারাগার মাদ্রাসা শিক্ষায় বাধ্য করে আল্লাহর ভয় দেখিয়ে। এই মওদুদীর ছেলে-মেয়েরা কেউ মাদ্রাসায় পড়েনি কেন? তোমাদের প্রশ্ন জাগে না! এই প্রশ্নের উত্তরে মওদুদীর বড় ছেলে বলেছেন আমাদের সবসময় পাশ্চাত্য শিক্ষায় উৎসাহিত করেছেন আমাদের আব্বা (মওদুদী)। এও বলতেন, জামাতের রাজনীতির ধারে কাছেও যাবে না। এ হলো ভাইরাস। সাবান দিয়ে ধুলেও সে ভাইরাস যাবে না। মওদুদীর ছেলে মওদুদীকে ঘৃণা করেন। কারণ যে লোক নিজের ছেলেদের বিদেশে পড়িয়ে গরীব শিশুদের ঠেলে দেন মাদ্রাসায়, যিনি নিজেই জামাতের মতো ধর্ম-বেচা অপরাজনৈতিক দল তৈরী করে অন্যের ছেলেদের রাজপথের সংঘর্ষে ঠেলে দিতে পারেন, তাকে শ্রদ্ধা করা অসম্ভব।
বৃটিশের শোষণের মুখে গোটা ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান যখন যে যার অবস্থান থেকে লড়ছে মওদুদী তখন বৃটিশের পক্ষ নিয়েছে সেই মীরজাফরের মতো যে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বৃটিশদের হাতে তুলে দিয়েছিল আমাদের শাসনদণ্ড। ১৯৭১ সালে তেমনি যখন বীরবাঙ্গালী মুক্তির জন্য লড়ছে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিক নির্দেশনায় গোলাম আজম তখন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে নেয়। পাকিস্তানের ঘাতক সেনাদের চিনিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ী। তালিকা তৈরী করে হত্যা করে লাখ লাখ মানুষকে। আজ পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে দেখো সেটি অর্থনৈতিকভাবে ভেঙ্গে পড়া একটা গরীব দেশ। সেই তুলনায় বাংলাদেশ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়েসম্ভাবনাময় দেশ। তুমি নিজে যে কোন ভোকেশনাল (কারিগরী) শিক্ষা নিয়ে আবেদন করলেই কম খরচে তোমাকে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে চাকরী পেতে সাহায্য করতে সরকার প্রস্তুত। তার মানে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলো।মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে উনি আমাদের সবচেয়ে বড় উপহার দিয়েছেন। পাকিস্তানের চেয়ে অনেক সফল এই বাংলাদেশ।শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তার মানে গোলাম আজম মওদুদীর মত বা মীরজাফরের মতই জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। গণহত্যার নীল-নক্সা করেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে।
গোলাম আজমের ছয়টি ছেলের একজনও মাদ্রাসায় পড়েনি। সবাই ইংরেজী শিক্ষা নিয়েছে। বিভিন্ন দেশে আছে সুখে। তার তোমাদের বয়েসী নাতি-নাতনীদের জন্ম হয়েছে সোনার চামচ মুখে দিয়ে। তাহলে তোমরা গরীব ঘরের সন্তান বলেই কী তোমাদের মাদ্রাসায় পড়তে হবে! তোমাদের জন্য এর চেয়ে ভাল জীবন নির্মাণের একটা চেষ্টা কী আমরা করতে পারি না! যে গোলাম আজমের নির্দেশে গণহত্যা করা হয়েছে পাকিস্তানের পক্ষে (বর্তমানে ব্যর্থ রাষ্ট্র), যার নির্দেশে তোমাদের আধুনিক শিক্ষার সুযোগ নিতে বাধা দিয়ে ধর্মের নামে মাদ্রাসা শিক্ষার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে, জামাত-শিবিরের রাজনীতিতে জীবন দিচ্ছে উপায়হীন দরিদ্র ঘরের সন্তানেরা; সেই গোলামের সন্তানেরা মাদ্রাসায় পড়েনি, জামাতের মিছিলে যায়নি, গায়ে তাদের ফুলের আঁচড় লাগেনি। এই গোলাম আজমকে তোমরা কীভাবে মূল্যায়ন করবে!
মওদুদীর সন্তান তার পিতার ঘৃণিত কর্মকান্ডের জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু, কোন অনুতাপ নেই গোলাম সন্তানদের তাদের পিতা গোলাম আজমের ঘৃণ্য রাজনীতি ও গণহত্যার জন্য। তার মানে মাদ্রাসার অসহায় শিশুদের রাজনীতিতে ব্যবহারের সুপ্ত ইচ্ছা তাদের মনে এখনো রয়ে গেছে। সেই কারণে তোমাদের সাবধান হতে হবে। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পেয়ো না। মহানবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর আদর্শকে বুকে ধারণ করতে তোমাদের জ্ঞানার্জন করতে হবে। পড়ো, জানতে পারবে। ইসলামের দুর্নামকারী গোলামচক্রের হাতের পুতুল হয়ো না তুমি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তানেরা আর পাঁচজনের মত সাধারণ স্কুলে পড়েছে। আর পাঁচজনের মতো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বুঝতে পারো এরকম সততাই আল্লাহর চোখে সবচেয়ে পছন্দের। যিনি নিজের সন্তান এবং অন্যের সন্তানের মাঝে পার্থক্য করেন না মওদুদী বা গোলামের মতো। আর বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন মুক্ত দেশে সব ধর্মের মানুষ নিজের ধর্ম শান্তিতে পালন করবে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। পরমতসহিষনুতা ছাড়া জাতি গঠন হয় না। সেটা উনি বুঝতেন। সততার অপরিমেয় সাহসের সঙ্গে তিনি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙ্গানির মুখে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ভয় দেখিও না। মুসলমান একবারই মরে। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তোমাদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে তোমরা পড়ো। গোলাম এর শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে নিজেকে যুগপোযোগী শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করো। একটু কষ্ট করে কম্পিউটার ব্যবহার শিখে গেলে গোটা পৃথিবীর জ্ঞান তোমার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। সত্যকে নিজেই খুঁজে নাও।
আজকের দিনেও দেখো তোমাদের অনেককেই কীভাবে ব্যবহার করছে হেফাজত। তোমাদের জীবনমানে এতোটুকু উন্নতি হয়নি। অথচ সম্পদ বেড়েছে আল্লামা শফিপুত্র মাদানীর। পৈতৃকসূত্রে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা সে। তোমাদের জীবন যেমন অনিশ্চিত; শফিপুত্রের তা নয়। বাংলাদেশ রাজনীতির “রাজপুত্র” কুসংস্কৃতি তোমাদের জীবনকে জেল-জুলুম-গুম হয়ে যাবার কিংবা পাখির মতো গুলি খেয়ে মরার ফাঁদে আটকে রেখে কথিত নয়া-আশরাফ যুবরাজকে গদিনসীন করার নিষ্ঠুর এক প্রতারণা। তোমাদের কোমল মনে আবেগ উস্কে দিয়ে অবৈধ সম্পদের মালিক হবার ধাপ্পাবাজি। কখনো তোমরা দর কষাকষির লোকবল, কখনো তোমরা নেহাত ভোটব্যাংক। আজকের যুগের প্রতিটি রাজনীতি ও ধর্ম ব্যবসায়ী নিজের ছেলেকে গদিনসীন করে এক একটি জমিদারী নিশ্চিত করে মরতে চান। একবারো ভাবে না সাধারণ মানুষের সন্তানের কথা। তোমরা যেনো জন্মেছো অবহেলিত প্রজা হতে। মরবেও নিপীড়িত প্রজা হিসেবে।
এ অবস্থা বদলাতে হবে। সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়তে সচেতন ও সুশৃংখল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হবে তোমাদের। তাই তোমরা আজকের দিনের আত্মা বেচে দিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো দলদাস লিখিয়ে বা কথিত টিভি টকারদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ো না। আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে নিজের জীবন গড়ো। নিজেদের বিকশিত করো। তোমাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ইবনে সিনা, আল-রাজির মতো বিজ্ঞানী হওয়া। ওমর খৈয়াম বা কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবি হওয়া। ইসলামকে যদি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসো, নবজাগরণের জন্য আলোর খোঁজ করো।
একাত্তরের গণহত্যার মাস্টার মাইন্ড গোলাম আজমের মৃত্যুর মাঝ দিয়ে একটি অন্ধকার যুগের অবসান ঘটেছে। আরেকটি নতুন অন্ধকার যুগ চলছে। অনন্তকাল ধরে এ অন্ধকারের গোলকধাধায় ঘুরপাক খাওয়া জীবনের আর সম্ভাবনার অপচয়। এবার অশুভ রাজনীতি ও ধর্ম-ব্যবসার ঠিকাদারদের রুখে দাও। বাংলাদেশকে ভালোবাসো। বাংলাদেশ তোমাকে আশা জাগানো একটা সুন্দর ভোর উপহার দেবে।
চিঠি লেখার তারিখঃ ৯ মে, ২০১৬