“পুরুষ তার প্রয়োজনে ধর্ম এবং ধর্মাবতার সৃষ্টি করিয়াছেন!”
আরে ভাই এখনই অতো লম্ফঝম্প দিয়েন না। কথাটা তো আমি বলি নাই।এটা তো আমি বলি নাই। আমি অতো সাহসী না,কারন আমার বাপ,ভাই,সোয়ামী কেউই নাই।কিন্তু তাঁর ম্যাজিস্ট্রেট স্বামী ছিলো বলেই হয়তো তিনি তনা হয়ে উঠতে পারেন নি।তাছাড়া মৌলবাদীদের তখন এতো বেশি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও প্রদান করা হতো না। নইলে রোকেয়াকে-ই তখন পাবলিক তনা বানিয়ে ছাড়তো।
আমি দিবস টিবসে অতো বিশ্বাসী নই।কিন্তু রোকেয়া দিবসের মতো আরো কিছু দিবসের প্রতি বিশেষ দূর্বলতা তো অবশ্যই আছে।সেটা বোধ করি আমার ডিজাইন দেখলেই বুঝা যায়।
আসলে অনেকদিন ধরেই সিদ্ধান্তটা নেবো নেবো বলে ভাবছিলাম। ঠিক রোকেয়া দিবসেই যে এটা ফাইনাল হয়ে যাবে সেটা কাকতালীয় বটে!
আসুন,গল্পটা তবে বলেই ফেলি! কর্ম এবং কর্মের প্রয়োজনেই আমার প্রচুর ঘর থেকে বের হতে হয়। না,আমি তালিমে যাই না। ধর্মটা না হয় ব্যক্তিগতই থাক। ওটা নিয়ে আলোচনার আমার আগ্রহ নাই। কর্মের কথাই বলি।তো কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার পথে পুরুষদের কষ্ট লাঘব করার জন্যই আমার এই সিদ্ধান্ত। অটো কিংবা বাস যেখানেই জার্নি করি না কেন একটা জিনিস গভীর মনোযোগে দিয়ে খেয়াল করলাম, নারীদের রাস্তায় বের হবার কারনে পুরুষদের মনে তীব্র ক্ষোভ আছে।উন্নয়নগুলো হয়তো নগর কেন্দ্রিক। আর আসল নাগরিক ও তাঁরা। নইলে সিএনজি অটোতে যাত্রী নেবার ধরণ আলাদা কেন ! যাই হোক সিএনজি অটোতে যাত্রী হয়ে নারীর সাথে ঘঁষাঘঁষি কিংবা ঘেঁষাঘেঁষিতে এই প্রজাতির পুরুষদের যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও পেছনের সিটে তৃতীয় নারীর আগমনে তারা প্রায় বলে উঠে-“রাস্তায় বেডি বাড়ি গেছে কিংবা বেডি বেগ্গুন রাস্তাত বারোই গেছে।” তর্জমা হচ্ছে, “রাস্তায় নারীর সংখ্যা বেড়ে গেছে কিংবা নারীরা সব রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে।” করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও প্রধান শিক্ষক হওয়ার কারণে প্রায়ই আমার দাপ্তরিক কাজে স্কুলে যাওয়া লাগে। সেদিন স্কুল থেকে আসার পথে যখন সিএনজিতে উঠেছি তখন আমার সঙ্গে একজন পুরুষ এবং একজন নারী যাত্রী ছিলেন। একটু পরেই আরেকজন নারী সিএনজি অটোতে ওঠার জন্য সিগন্যাল দিলেন। সিএনজি অটো থামল। পেছনের পুরুষ যাত্রীটি কিছুতেই নেমে সামনে যাবেন না। তাঁর মনে তীব্র ক্ষোভ।তাঁর পোশাকের বর্ণনা দিয়ে কারো অনুভূতিতে আঘাত করার ইচ্ছা আমার নাই।তাই সেটা নাই বা বললাম।রাস্তায় এত নারী কেন! নারী তো থাকবে ঘরে। নারী অবস্থান করবে গৃহের অভ্যন্তরে। রাস্তায় নারী দেখলেই এদের মাথায় বজ্রপাত হয়। তিনি যখন গজ গজ করছিলেন তখন আমি সিএনজি ড্রাইভারকে বললাম, আমি আসছি সামনে। আমি সামনে এসে বসবো। ঠিক এই কথা বলার পর পুরুষটি নেমে সামনে গেলেন।তাঁর গজগজানি থামেনি কিন্তু। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই রোকেয়া দিবসে আমি না হয় আরও একটা প্রথা ভাঙবো।বাসে যখন জার্নি করি পুরুষের পাশেই তো বসতে পারি। সিএনজি অটোর পিছনে পুরুষের সাথেই তো বসতে হয়। তাহলে সামনে কেন বসতে পারব না!এই সিদ্ধান্ত কিন্তু আমি একদিনে নিই নি। প্রতিদিনই এরকম দৃশ্যের অবতারণা হয়। কোনো না কোনো পুরুষ গজ গজ করেনই। তারা পেছনে নারীর শরীরের সাথে ঘঁষাঘঁষি করে বসতে পারবেন কিন্তু সামনে যাবেন না। নারী কেন ঘর থেকে বের হয়, এটাই তাদের ক্ষোভ। যে দেশে মোল্লারা বলে বেড়াতে পারে নারীদেরকে চতুর্থ শ্রেণীর বেশি পড়তে দেয়া উচিত না। নারী তেঁতুলের মতো। সেদেশের পুরুষের এমন মানসিকতায় আমি অবাক হই না একটুও। এমনকি রাগও হয় না খুব। স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্ত নেই এখন থেকে আমি সিএনজি অটো তে সামনের সিটে পুরুষের সঙ্গে বসবো। কিন্তু না, আমি সিদ্ধান্ত নিলে তো হবে না। ড্রাইভার তো আমাকে সামনে নেয় না। সিট খালি নিয়ে চলে যায় কিন্তু আমাকে সামনে নেয় না। একদিন মাত্র একজন ড্রাইভার নিয়েছিলেন আর নেয় না কেউ। আমি একা প্রথা ভাঙতে চাইলেই কি আসলে ভাঙতে পারছি! কিন্তু নিজের কাছে নিজের স্বচ্ছতা তো আছে এজন্য যে, আমিতো চেষ্টা করেছি।
অনেক চেষ্টাই সফলতা পায় না। বেশিরভাগ চেষ্টাই চেষ্টা পর্যন্তই থেকে যায়। দু-একটা সফলতা পেলে সেটা হয়ে যায় মিডিয়ার পণ্য। সেই সফলতা নিয়ে মিডিয়া আসলে ব্যবসাই করে। আমার কাছে তাই সফলতার সংজ্ঞাটা অন্যরকম। শুধুমাত্র চেষ্টা। সফলতা আসতে পারে, নাও পারে। চেষ্টা করেছি কিনা, এটাই আসল কথা।
হ্যাঁ আমি চেষ্টা করেছি।আমি অনবরত চেষ্টা করি।
– শামা আরজু, লেখক