এথেন্সের রাষ্ট্রচিন্তকেরা দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর ঠিক করেছিলেন, এ নগররাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধি হিসেবে চাই গার্ডিয়ান এঞ্জেলদের। এই অভিভাবক ফেরেশতারা শাকান্নে তুষ্ট থাকবেন; কখনো শাক দিয়ে মাছ ঢাকবেন না। বলাই বাহুল্য; ব্যক্তিমানুষের ষড়রিপুর তাড়নামুক্ত হতে বা সেভেন ডেডলি সিনস মুক্ত হতে; জীবনের প্রায় অর্ধশতক লেগে যায়। ঠিক যে বয়সে বঙ্গবন্ধু গার্ডিয়ান এঞ্জেল হয়ে উঠেছিলেন; কিংবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম পার্থিব মোহ থেকে মুখ ফিরিয়ে দেশসেবায় মোটা ফ্রেমের অভিজ্ঞতার চশমা পরেছিলেন।
কিন্তু আমাদের সমাজ হলিউডের জেমস বন্ডকে ন্যায়দাতা হিসেবে মেনেছিলো। তারা প্লেটোর রিপাবলিককে অচল পুঁথি বলে ছুঁড়ে ফেলেছিলো; এমনকী কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটালকেও আউটডেটেড ইউটোপিয়া বলে রায় দিয়েছিলো। ফলে সানগ্লাস পরা জেমসবন্ড জিয়াউর রহমানের বিটিভি’র খবরে দেখানো মুভি ; সেইখানে চল্লিশ বছর বয়সের এক নায়ক জনসভায় সবাইকে হাত তুলে সমর্থন জানাতে বলছেন। ছোট চুল সুঠাম দেহী সুদর্শন জেমসবন্ড খাল কেটে কৃষি বিপ্লব ঘটাচ্ছেন। আবার অফ দ্য রেকর্ড রোজার দিনে ব্রেকফাস্ট করার সময়; জামায়াতের লোকেরা দেখা করতে এলে পুতুলের দিকে মুচকি হেসে বলেন; মোল্লাগুলোর ফজরের ওয়াক্তেই ঘুম ভেঙ্গে যায়; তাই সকাল ৮টাকে ছুটির দিনে ডিসেন্ট আওয়ার বলে ধরে নেয়। পুতুল নিজে রোজা রাখে; কিন্তু মোল্লাদের সামনে অস্বস্তি বোধ করেন; কারণ তাদের চোখের পর্দা নেই। জেমস বন্ড পরিবারের বন্ধুরা ভাবীদের চোখে চোখ রেখে কথা বলে; বোন বলে ডাকার ট্র্যাডিশান তাদের।
এইসময়টাতে বিশ্ব ব্যাংক- আই এম এফ; সব জায়গায় প্রবীন সরিয়ে নবীনের চেয়ার দখল করার বসন্ত। ‘তারুণ্য তারুণ্য’ বলে গলা পাঠাচ্ছেন আইভি লীগ ও অক্সফোর্ডের ‘ক্যাপিটালিজম’-এর ওস্তাদেরা। দ্রুত টেকাটুকা কামাতে ইয়াং রেসের ঘোড়া নামাও সিইও হিসেবে। এই যে অভিজ্ঞতাকে প্রতিস্থাপন করে এডভেঞ্চার অফ জেমসবন্ডকে বিশ্বব্যাপী বরণ করা হলো; তার অভিঘাতে বাংলাদেশে ‘গার্ডিয়ান এঞ্জেল’-রা পরিত্যক্ত হলেন।
জেমস বন্ড সমাজে, সবার চাই জিয়ার সাফারি-এরশাদের প্রিন্স কোট; তাই বাংলাদেশে এলো দর্জি বসন্ত; জোলার পোলারা যারা মসলিন কাপড় বয়ন পরিবারের তন্তুবায়ি প্যাশনে আকুল; তাদের জন্য খুলে গেলো গার্মেন্টস ব্যবসার আসর। এদের জিডিপি গ্রোথ ও রানাপ্লাজার জীবন্ত সমাধি নির্মাণের ক্রিয়াকলাপ ঘুরে দেখলেন, জিয়ার ছেলে তারেক রহমান। জোলার পোলার ড্রয়ারে একশো কোটি টাকা দেখে তার মনে পড়ে; জেমসবন্ড ‘সততা’র নিখুঁত অভিনয়ে তাকে টিফিনের পয়সা দেননি; বিদেশ সফরে নেননি; পড়াতে বসে, হি গোজকে ; হি গো বললে; কোমরের বেল্ট খুলে পিটিয়ে বলতেন, গাধার আইকিউ হয়েছে, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নম্বরের সঙ্গে এস বা ই এস হয়। হি গোজ; যে যায়; সে যায়।
এরশাদের অদ্ভুত উটের পিঠ থেকে বাংলাদেশ উঠলো তারেক রহমানের অদ্ভুত গাধার পিঠে। ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চারের বন্ধু দ্য লাস্ট বেঞ্চাররাই হয়। ফলে ঐ যে তারুণ্য সেই অভিজ্ঞতাহীন ব্লেফুসকুডিয়ান জেমসবন্ডের মিনিয়েচারের মতো করে দেশ দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করলো। ফেনসিডিলে ভাসতে থাকলো বাংলাদেশ। ফলে গড়ে উঠলো হাওয়া ভবন। রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র। খালেদা জিয়া একজন জেমসবন্ডের সঙ্গী হিসেবে; সুন্দর করে কথা বলতে, সাজতে আর চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে জানতেন। উনার পাশ থেকে ‘আপনার ডাক্তার’ সরিয়ে নেয়া হয়। ভ্যাড়ভেড়ে গ্রামের তরুণ সংসদ সদস্য, কালু-দুলু-ভুলু-জুলু বোঝায়; ‘আপনার ডাক্তার’ জেমসবন্ডের মাজার জিয়ারত করেন না। আমাদের অনুভূতিতে পোচন্ড আঘাত লেগেছে; উনারে সরান। (আমাদের টেকাটুকা হাওয়া করতে দিন।)
লুলু-দুলু-আমিনুলুরা বাঘমারা গ্রাম থেকে ধরে আনে এক কসাই; বাংলা ভাইকে। সে হাওয়া ভবনে ঢুকে বলে, আফগান মুজাহিদ অলস বইসা আছে; আল্লা চাহিয়াছেন জন্য মামা ডাকিয়াছেন তার হাওয়া দপ্তরে। তারেক এর মাঝে সুঠাম দেহ ছোট চুলের জেমস বন্ড মেক আপ নিয়ে সারাদেশে হাঁস মুরগী আর ছাগলের খামার পরিদর্শন করে। ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য ‘অপারেশান ক্লিন হার্ট’ ও ‘গ্রেনেড প্রচলনের স্টার্ট আপ বিজনেসে’ যথাক্রমে কালো এলিট ফোর্স ও কসাই মোল্লা ফোর্সের ফুটসোলজারদের লাগিয়ে দেয়। ফলাফল নিম্নচাপ।
এবার বিল গেটসের ‘লেটস টকে’-র পালা। ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিকাশে খুব স্বাভাবিকভাবে ডিজিটালাইজড হয়েছে নেপাল-ভুটান-মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো। কিন্তু বাংলাদেশ ডিজিটাইজড হয়েছে বিল গেটসের বিকল্প সড়ক ও জনপথ (সওজ) ভাইয়ের মাধ্যমে। সওজ ভাই যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাসার গ্যারেজের গবেষণাগারে সার্চ ইঞ্জিন সওজ বানিয়েছিলেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর কৃতিত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিলো যেমন মার্কনি তার রেডিও উদ্ভাবনে; সওজের কৃতিত্ব ছিনিয়ে নিলেন তেমনি বিল গেটস সার্চ ইঞ্জিন গুগল উদ্ভাবনে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ এই একটি শ্লোগানে মনে হতে থাকলো ফেসবুক উদ্ভাবনও করেছেন সওজ ভাইয়া। এই সরলতাপ্রসূত ভ্রান্তির ব্যাপারগুলো প্রকাশ করায় সওজ অভিমান করলেন। সিপি গ্যাং বা হ্যাপি ওয়ার্কস নামের একটি ভুঁইফোড় সংগঠনের চারটি রাজটোকাই গিয়ে কাওরান বাজারের চিপায় দাঁড়িয়ে দেশের শত্রু পত্রিকায় আগুন ধরিয়ে দিলো। ছোট খবর; তবু ফেসবুকের হ্যাশট্যাগে মনে হলো আজ শেষের আলো নিভিয়ে দিয়ে মিলন কন্ঠ ও বাতাবিত্তোর মিডিয়ার জয়রথ চালু হলো। সওজ ভাইয়া কোন ইমপ্যাক্ট না পেয়ে; লেট দেয়ার বি সাইলেন্সে চলে গেলেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশের লেজ ধরে, কিছু ইন্টারনেট ইতিহাসবিদ তৈরি হলো; তারা টাইম মেশিনে করে দেশের মানুষকে ফেলে দিলো একাত্তরে। একাত্তরের নয়মাসে আটকে গেলো বাংলাদেশ। বিসিএস-এর আচরণ সিএসপির মতো; বাংলাদেশ পুলিশের আচরণ পাকিস্তান পুলিশের মতো; ছোট চুল সুঠাম দেহী কোটালিপুত্রদের আচরণ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মতো। ফলে গুম-হত্যা-ধর্ষণ-লুন্ঠনের এক দুর্নীতি বিপ্লবে বাংলাদেশ পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বরফ যুগ ও পাথর যুগে থিতু হলো।
এদিকে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হয়েছে; রাজদর্জিরা সুন্দর সুন্দর পোশাকের বিজ্ঞাপনে ঢেকে দেয় ‘গণতন্ত্রে’র বস্ত্রহরণের ট্র্যাজেডি। কোথাও কোন শ্রী কৃষ্ণ নেই যে দ্রৌপদীকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবে। এক নেতা এক মত, ইঞ্চি ইঞ্চি করে মেলাতে হবে মত; কোন প্রশ্ন নয়; প্রতিবাদ নয়; ৫৭ ধারা আর ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের সাপের ছোবলে লেখক মুশতাক মারা যায়।
টাইম মেশিনে করে দেশ যেহেতু অন্ধকার যুগে; তাই হেফাজত ফতোয়া দেয়, নাস্তিক কতল করা ওয়াজিব। ফলে ১৪ই ডিসেম্বরের মতো লেখক-গবেষক-থিয়েটার কর্মীর লাশ পড়তে থাকে অনুভূতির চাপাতির আঘাতে। কান ধরার বিনিময়ে খাসজমি; ভোটসমনিয়ার জন্য শোকরানার মাঝ দিয়ে ক্ষমতায়িত ধর্মের ফুটসোলজার।
উগ্র জাতীয়তাবাদের ফুট সোলজাররা; প্রতিটি হত্যা-ধর্ষণে ভিক্টিম ব্লেমিং করে; জাস্টিফিকেশান দেয় শিয়ালের হুক্কা হুয়ায়। উগ্র ধর্মবাদের ফুট সোলজাররা জোনাকির আলো হয়ে জ্বলে খবরের লিংকের মন্তব্যে, নারীকে গালি দিয়ে, অন্য ধর্মের মানুষকে গালি দিয়ে; খিলাফত বিপ্লবের স্বপ্ন বুকে নিয়ে।
থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরের আদলে গড়ে ওঠে শাকা নগরীর পাশ্চাত্যে ইন করা পাঁচ তারকার পিউপাপিয়ার আসর জমিয়ে। সেইখানে লোডস অফ সুইফট ডেভেলপমেন্টে’র বা এল এসডির নেশায় চুর জিডিপির দুর্জয় শিখর। সম্রাটের ক্যাসিনোতে আঙ্গুল চোষে লিলিপুটিয়ান তারুণ্য; হুন্ডি হয়ে সব টাকা উড়ে যায়; সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোতে।
ভ্যাড়ভেড়ে গ্রামের সাংসদ পপলু-শিমুল-চটুল-ঝলকেরা কিন্তু প্রকল্পের টাকা মেরে ইহজগতেই গড়ছে জান্নাতি প্যালেস; আবার পশ্চিমের বেগম পাড়ায় কিনতে থাকে জমিদার বাড়ি।
প্রতি পাঁচবছরে তিনশোটি নতুন জমিদার সংসদ নামের জুয়াঘরের টিকেট পায়। পেশী-কালোটাকা আর দলীয় লিপসার্ভিস; সুচিন্তা ভবন মৌ মৌ করে উন্নয়ন ধারাপাতে।
মাও সে তুং-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আদলে গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক রাজভোঁদড়েরা; যারা শাহবাগ থেকে শহীদ মিনার বাংলাদেশের শতবর্ষের সার্বভৌম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শো ডাউন করে উগ্র জাতীয়তাবাদের। আর উটবাড়িয়ায় ধর্মের হেফাজত ব্রিগেডের খিলাফতের শো ডাউন চলতে থাকে।
এইসব একসেস টু টেকাটুকার সিক্স ডিজিট নগদ মোটিভেশনাল ভাঁড়েদের; ছাত্র জীবনে না খেয়ে মুখ শুকিয়ে থাকা; আর আজ চর্বি জমিয়ে বাঞ্জি জাম্প করার সাফল্য গাথা উন্নয়ন অর্থনীতির সূচক হয়। টেকাটুকা বিপ্লবের এল এস ডি সমাজে বাকস্বাধীনতাহীন একজন মূকাভিনেতা আত্মাহুতি দেয়, হা রে রে রে; আমায় ছেড়ে দেরে দেরে বলে। ভাওতাবাজির ডিজিটালাইজেশানের ভূতের আলোর ডাকে ‘ফ্রি লান্সার’ হয়ে ভারতের তামিলনাড়ুর আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশলের স্বপ্নের আলেয়ায় ব্লাফড হয়ে আত্মহত্যা করে তরুণ। লিলিপুটিয়ান ব্লাফ মাস্টারেরা গ্যালিভার মেধার এপারথেড শুরু করে। তারুণ্যের মৃত্যুর মিছিল চলে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে। স্বপ্ন হত্যার জীবন্মৃত জনপদ অপেক্ষা করে, পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের ব্রেকিং নিউজের জন্য।
৫০ বছরে বাংলাদেশ; গার্ডিয়ান এঞ্জেলদের হত্যা করে তরুণ জেমস বন্ড ইন্সটল করার ইঙ্গ-মার্কিন ক্যাপিটালিস্ট ড্রিমের বিষাদ-শীতলক্ষ্যা; যেখানে তরুণ সাংসদের চলাচলের অনুমতিহীন কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চ ডুবে মরে মানুষ; এস আলম গ্রুপের কয়লাখনির শ্রমিকেরা ভাত চেয়ে এরপর পুলিশের গুলি খেয়ে মরে; এলিট ফোর্সের প্রদীপের আগুনে পুড়ে মরে; পুড়ে মরে লোভে; ষড়রিপুর তাড়নায়; সেভেন ডেডলি সিনসের দোজখ যন্ত্রণায়।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক ই-সাউথ এশিয়া