যে কোন ব্যক্তিকে গুম করে; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ খবর পড়ার পর; পুলিশ যে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিখোঁজ ব্যক্তিকে ফেরত দেয়; সেইখানে বলা গল্পগুলো দুর্বল ও পুনরাবৃত্তিকর হওয়ায়; জনমনে আরো বেশি সন্দেহ বাড়ছে; গুম বা মিসিং পারসনের ঘটনা সম্পর্কে।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থায় যারা কাজ করেন; তারা পেশাগত কারণেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। সাধারণ মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশেই পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর লোকের সঙ্গে অনায়াসে মেশে না। নেহাত কার্টেসি বা ফর্মালিটি বজায় রাখে। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর মানুষেরও পেশার নৈর্ব্যক্তিকতা ধরে রাখতে কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন জীবন কাটাতে হয়।
এ কারণে সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প তাদের জানা হয়না। জীবন সতত পরিবর্তনশীল। নতুন সমাজ ব্যবস্থায় নতুন ধরনের ঘটনা ঘটে। বিংশ শতকের জীবনের গল্প আর একবিংশের জীবনের গল্প এক নয়। ফলে ‘অন্তর্ধান রহস্যে’র যে গল্পগুলো রেল স্টেশানে নিউজপ্রিন্টের বইতে পাওয়া যেতো; আজকের জীবন বাস্তবতায় তা অত্যন্ত আউটডেটেড বা তামাদি।
সরকারের ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা করে যারা; তারাই সরকারের প্রকৃত বন্ধু। আর সরকারকে তেল দেয় যারা; তারাই সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামায়; এ কথা সর্বতো সত্য। স্কুল কলেজ জীবন থেকে ছাত্রলীগ করেছেন; এমন কেউ কখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কথা বলেন না; যাতে সরকারের জনপ্রিয়তায় চিড় ধরে। কারণ রাজনীতির প্রথম কথাই হচ্ছে; জনমানুষের সঙ্গে শিষ্টাচার বজায় রেখে কথা বলা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কেউ শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য রাখেন না। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাদের যে বিতর্ক হয়; তাতে শ্লেষ থাকে কিন্তু অশ্লীলতা থাকে না। ফেসবুকে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে যারা জনগণকে গালি দেয়; এরা অবশ্যই অন্যদল থেকে আসা। হোলিয়ার দ্যান দাউ হয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের যে অনেক বেশি আগ বাড়িয়ে আক্রমণাত্মক তারা।
শৈশব থেকে পরিচিত আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকেই ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। তারা ইনবক্সে বহুবার একথা বলেছে যে, তুমি যার কথায় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছো; সে তো দলের কেউ নয়। সে স্বপ্রণোদিত আওয়ামী লীগ সমর্থক হলে আমরা কী করবো!
একটি দল যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে; তখন ক্ষমতাবলয়কে ঘিরে অনেক দুধের মাছি ভন ভন করে। সুতরাং দুধের মাছি লীগ কোনভাবেই আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্বশীল নয়। আওয়ামী লীগ যখনই কোন সদস্যের অপরাধ ধরতে পারে; তাকে বহিষ্কার করে।
১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যারা আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নানাভাবে লড়াই করেছে; তারা আওয়ামী লীগের শুভাকাংক্ষী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে আমি টাকা কামাবো; এ চিন্তা তাদের মাথায় কখনো ছিলো না।
বিংশ শতকের শেষাশেষি পর্যন্ত ছাত্রলীগের যে নেতা কর্মীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা আমার নিজের শহর ঈশ্বরদীতে দেখেছি; তারা অত্যন্ত শিষ্টাচার সম্পন্ন মানুষ। কোন রকম খিস্তি দিয়ে কথা বলবে; এ তাদের রাজনৈতিক শিক্ষার মধ্যেই নেই।
আওয়ামী লীগ এই ইনিংসে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর; সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাত আলোর ঝলকানির মতো লেট ইয়ুথের অত্যন্ত খারাপ ছাত্র; জীবনে বিশেষ কিছু করতে পারেনি; ন্যুনতম অর্থ উপার্জনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকা সম্পন্ন লোকেরা; সোস্যাল মিডিয়ার কাভারপিকে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি টাঙ্গিয়ে; শুরু করে স্বপ্রণোদিত ‘দেশপ্রেমের ম্যানেজারির গ্যাং’। তাদের লক্ষ্য সাইবার স্পেস দখলে রাখা জরুরি এইরকম রুপকথার গল্প শুনিয়ে এক্সেস টু টেকাটুকা প্রকল্প থেকে টাকা টুকার বিনিময়ে গালাগালের ‘হ্যাপি ওয়ার্ক্স’ জোগাড় করা। এদের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে স্বপ্রণোদিত ধর্মের ম্যানেজারেরা। তারাও ‘কল্লা নামিয়ে দেবার’ ভয় দেখিয়ে একসেস টু টেকাটুকার মডেল মসজিদ প্রকল্পে হিস্যা চায়।
এই দুটি গোষ্ঠী যেহেতু ক্ষমতাসীন দল বা সরকারি দল হিসেবে নিজেদের ‘পজিশনিং’ করতে সতত চেষ্টা করে; তাই তারা পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর লোকেদের পোস্টে গিয়ে ‘ইয়েস স্যার’ ও ‘প্রেসেন্ট প্লিজ’ বলে আসে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এরা ড্রপ আউট হলেও; ফেসবুকের পোস্টে নিয়মিত তেলাঞ্জলি কোর্সের ছাত্র। এদের কাছ থেকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীরা যে সমাজ চিত্র পায়; তা যৌন অবদমন, প্রতিহিংসা, লোভ, ঘৃণা, পেট বানিয়ে ‘স্যার’ তুষ্টিকর কথা বলার মতো ব্লাফ-মাস্টারদের সমস্ত বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এদের নিজেদের জীবনের গল্প ২০১০ থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে কোন গল্প নেই। থাকলেও নরেন্দ্র মোদির মতো গল্প; এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন; যেখানে কোন ক্লাস মেট নেই; টিচার নেই; এমন রেল স্টেশনে চা বেচার গল্প; যেখানে কোন রেলস্টেশন নেই। মানে একটা লোকের ২০১০ সাল পর্যন্ত কোন সাবস্ট্যানশিয়াল কাজের, লেখালেখির নজির নেই। হঠাত আলোর ঝলকানির মতো এরা লেখক, ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পন্ডিত, সংস্কৃতির পুচ্ছটি উচ্চে তুলে নাচানোর সংস্কৃতি মাতবর; বা ‘অনুভূতির গোলাপজল ছেটানো’ ধর্ম মাতবর।
এই এইচ এস সি ড্রপ আউটদের সঙ্গে নিয়ত মেলামেশায় পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর লোকেরা ‘অষ্টাদশ শতক’-এর অন্তর্ধান রহস্যের গল্প পায়। ঐ গল্পগুলোই সংবাদ সম্মেলনে এসে খুব গর্বের সঙ্গে বলা হয়। আর ঐ গল্পের ভোক্তা তো সেই ড্রপ আউট সংস্কৃতি ও ধর্মের ঘৃণাবাদী গ্যাং। সাংবাদিক কাজল গুম হলে ধর্ম-গ্যাং খুশি, ওয়াজিটিউবার ত্বাহা গুম হলে সংস্কৃতি গ্যাং খুশি। কাজলকে গুম থেকে ফেরত দেয়ার গাল্পগল্পে পুলক পায় ধর্ম-গ্যাং। ত্বাহাকে গুম থেকে ফেরত দেয়ার গালগল্পে হুটোপুটি করে সংস্কৃতি গ্যাং। ড্রপ আউট গ্যাং-এর প্রতিক্রিয়া স্থির হয়ে আছে স্কুল-কলেজে। গুমের গল্পও আটকে আছে এইচএসসি সমমানের শিক্ষায়।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে; ইন্টারনেট আসায় বিশ্বের খবর সবার হাতের মুঠোয়; ফেসবুক যেহেতু সমাজের দর্পন; তাই এইখানে সমাজচিত্র স্পষ্ট হয়। অর্ধ-মূর্খের স্বর্গের খুশি হওয়াদের নিয়ে ভাবতে নিষেধ করেছেন দার্শনিকেরা। তারা তো এমনও বলেছেন; সব জীর্ণ কাপড় সেলাইয়ের যোগ্য থাকে না। তাই ফেসবুকের জীর্ণ ত্যানা পেঁচিয়ে সরকার সমর্থনের ভান করা; রুলিং এলিটের আস্তিন পরে লালসালু ও বালসালুর মজিদ হয়ে ওঠাদের এই তামাদি ‘রাজাকার’ স্বভাব; নতুন প্রজন্মের চোখে ঘৃণ্য একটি ব্যাপার। কারণ তারুণ্য সতত প্রতিষ্ঠান বিরোধী। সমকালীন সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা যে ‘তেলাঞ্জলির বিদূষক’ এটা তরুণেরা ধরতে পারে খুব সহজেই।
সিলেক্টিভ জাস্টিসের জন্য ড্রপ আউট ধর্ম ও সংস্কৃতি মামাদের যে কুম্ভীরাশ্রু; তা চিহ্নিত হয়ে রয়ে যায় তারুণ্যের চোখে। মনে মনে ‘দালাল’ শব্দটি উচ্চারণ করে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নতুন প্রজন্ম। আর প্রবীণেরা তো এমনি প্রবীণ নন। তাদের আছে অভিজ্ঞতা। তারা একটা দুটো ভাত টিপেই ক্ষমতার হাড়ির মধ্যের স্বপ্রণোদিত ধর্ম ও সংস্কৃতির ম্যানেজার ভাতগুলোর সেদ্ধ না হওয়া, বা পচে যাওয়া টের পান।
গুমের গল্পগুলোর ব্যাকোয়ার্ড লিংকেজ যেহেতু অসিদ্ধ বা পচাভাত; ফলে গুমের ফরোয়ার্ড লিংকেজের গল্পের ভাতও অসিদ্ধ বা পচা হতে বাধ্য।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া