৮২ বছর বয়সেও পুরুষ তার ৭০ বছর বয়সী স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিবে বলে এখনো ধমকায়। যদিও সে ইতোমধ্যে মধ্যে ছয় সাতটা বিয়ে করে ফেলেছে বলে তার স্ত্রীর অভিযোগ। অবশ্য সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, আমি মান-সম্মানের ভয়ে এই কথাগুলি কখনোই প্রকাশ করিনি। আমার পরিবারের মান-সম্মান নষ্ট হবে, আমার সন্তানদের মান-সম্মান নষ্ট হবে এই ভয়ে আমি এসব নিয়ে ঘরে ঘরে তার সঙ্গে বাদানুবাদ করে অনেক মার খেয়েছি, অনেক নির্যাতন সহ্য করেছি, সন্তানদের নিয়ে উপোস করেছি কিন্তু বাইরের মানুষদের জানতে দিইনি।
বাইরের মানুষ জানতো, কি জানতো না সেটা নিয়ে অবশ্য এখন তাঁর কোনো মাথাব্যাথা নেই। কারণ এখন ঘরের শত্রুই বিভীষণ! এখন তাঁর বড় ছেলে সম্পদের লোভে তার বাবার দুর্বল দিকটি ব্যবহার করে বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে আবারও বিয়ে করাবে বলে। সম্পদের লোভ মানুষের নৈতিকতাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়! পুঁজির লোভ কত নিচে নিয়ে যায় তাকে, এটা মানুষ কবে আর ভাবতে শিখবে!
লোকটা অনেক টাকার মালিক। এককালে প্রবাস করে ম্যালা টাকা কামাই করেছে। কথায় বলে টাকায় টাকা আনে। তারও অনেক টাকা হয়েছে। কিন্তু অনেক টাকা হলেই মানুষ আর মানুষ থাকে না। আমার ব্যক্তিগত জীবনে চারপাশ খেয়াল করে আমি সেটাই দেখে এসেছি। ব্যতিক্রমটা সবক্ষেত্রেই আছে।
একসময় সে শহরের একটা বোর্ডিং এর নাম মালিক ছিল। বোর্ডিংয়ে নারী নিয়ে পড়ে থাকতো নিজেও। প্রথম স্ত্রী এগুলোতে বাধা দিলে স্ত্রীর উপর অকথ্য নির্যাতন চলতো। খাবার খরচ বন্ধ করে দিত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা না খেয়ে থাকতো প্রায়ই। কেবলমাত্র প্রথম স্ত্রী ছাড় দিয়ে দিয়ে সংসারটাকে এ পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু শেষরক্ষা আদৌ হবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ বাপকা বেটা জন্মে গেছে ততোদিনে। ছাত্রজীবনে আমি যতটা না ভালো ছাত্র ছিলাম তার চেয়ে বেশি ছিলাম আবেগি। তাই বাবার সঙ্গে প্রায়ই আমার তর্ক লেগে যেত। বিভিন্ন বিষয় নিয়েই তর্ক হতো। তার মধ্যে একটা – মানুষের ওপর বংশগতির প্রভাব নয়, পরিবেশের প্রভাবই বেশি কাজ করে বলে আমি মনে করতাম। বাবা মনে করতেন জিনের প্রভাবই বেশি কাজ করে। অনেক বিষয়ে বাবার সঙ্গে তর্কে আমি জিতে যেতাম। তবে এ বয়সে এসে মনে হলো, আমি আসলে জিততাম না। বাবাই আমাকে জিতিয়ে দিতেন, ইচ্ছে করে। আমার চিন্তা- ভাবনা আর আবেগের প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে আমার বাবার প্রভাব। কেবলমাত্র লোকজনকে খাওয়াতে পেরে আনন্দিত হওয়া, এই দিকটা পেয়েছি মায়ের। এর বাইরে মায়ের চরিত্রের কোনো প্রভাবই আমার ওপর পড়েনি। আমাদের সময়ে বাবারা ছিলেন খোদ একটা আতঙ্কের নাম। আমার বাবা ছিলেন তার বিপরীত। অন্যের বাবার কথা বলতে বলতে নিজের বাবাকে টেনে আনলাম। ইদানিং লিখতে গিয়ে আমার এই সমস্যা। প্রায়ই হয় খেই হারিয়ে ফেলি। এবার ফিরতে হয় প্রসঙ্গে।
এই লোকটির বড় ছেলে নাকি রাষ্ট্রপতির ভাগিনার বন্ধু (যদিও তার পরিবারেরর অন্য সদস্যরা বলে, এটা এখন আর সত্য নয় একদা সত্য ছিল। তার ধান্দাবাজির কারণে এই সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেছে আরো আগেই, তবুও সেই পরিচয়টা এখনো দিয়ে বেড়ায় )। তার পেশা ধান্দাবাজি, এটা তার মায়ের কথা, আমার কথা নয়। লোকটার বড় ছেলে এক সময় ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতো। তার পরে কি করে যেন চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে ধান্দাবাজিতে নেমে গেল সেই গল্প আমি নিজেও জানি না। পরিবারও জানে না। জানার দরকারও মনে করি না। কারণ আমার দৃষ্টি কেবল ঐ ৭০ বছর বয়সী নারীর ওপর, যিনি এখন বারবার বলে বেড়ান আমার মাথার ছাদ( স্বামী) কেড়ে নিয়ে গেলো। বড় ছেলে গন্যমান্য ব্যক্তি এবং তাঁর অন্য সন্তানদের সামনে বলে গেছে উদ্ধত্য নিয়ে, ‘আমি চার-পাঁচ হাজার মানুষ নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবো আমার বাবার বিয়েতে। বাবাকে আমি আবার বিয়ে করাবো।’ হ্যাঁ যোগ্য বাবার যোগ্য পুত্রই বটে! নইলে কি আর ৮২ বছরের পিতাকে নিয়ে কোনো পুত্র এমন কথা বলে, যদিও তার জন্মদাত্রী মা এখনো জীবিত। ভাবছেন, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণ ছাড়াতো এটা হওয়ার কথা না। আমিও বলছি কারণ ছাড়া কিছুই ঘটে না। প্রধান কারন বিচারহীনতার সংস্কৃতি। তার ওপর এই লোকটার অনেক সম্পদ ছিল, এখনও আছে। কিন্তু সবকিছুর মালিক হতে চায় তার বড় ছেলে। যে বলে বেড়ায়, অনেক ডিসি এসপি নাকি তার পকেটে থাকে। এটা তার ছোট ভাইয়ের কথা। তবে আমি এই নারীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি। আর তার ছোট ছেলে কথা বলার সময় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েছে। ছেলেদের এমন কান্না আমি খুব একটা দেখিনি। তবে মেকি কান্না আমি বুঝতে শিখেছি। তাই আমি জানি এই ছেলে যে গল্প বলছে, সেটা মেকি নয়। তার কান্না সেটা বলে দিচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই কোনো কিছু হলেই বা বা বাজার করা বন্ধ করে দিত। এর জন্য বাবার কাছে টাকা চাইতে গেলে কিভাবে টাকা ছুঁড়ে মারতো সেটা মনে করলে এখনো খুব অপমান লাগে। বলতে বলতেই ছেলেটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল আবারও। আমি যতই বলি সে কান্না থামাতে পারছিল না। হ্যাঁ, এই লোকের দুই ছেলে তিন মেয়ে। ছোট ছেলে ঢাকায় একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে চাকরি করতো। বড় ভাই ছোট ভাইকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে এসে বাবার সম্পত্তি রক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে বলেছে। তখন নতুন সরকার ক্ষমতায় এলো।তার ধারণা ছিল, নতুন সরকারের লোকজন সব লুটপাট করে নিয়ে যাবে। তাই ছোট ভাইকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলো। মা বাবা ছোট ভাই মিলে এই সম্পত্তি গুলি তিল তিল করে গড়ে তুলেছে। তাদের অনেক আছে কিন্তু এই নারীটি এবং তার ছোট ছেলে ছেলের বউ নাতি সবাই এখন অসহায়। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ মালিকানা ছিলো সম্পদের আয়ে।কিন্তু বড় ছেলে বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। বাবা এখন আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলেছে। তাদের বিভিন্ন দোকানপাট থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে যৌথ একাউন্টে টাকা জমা হতো। সে টাকা এখন জমা হয় ওই ৮২ বছরের পুরুষের একাউন্টে।এই লেখায় হাত দিলাম মাত্র এরইমধ্যে খবর পেলাম এই নারীটির স্ট্রোক হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে জেলার শহরে পাঠানো হয়েছে। ছোট ছেলে তার বোন এবং মা অর্থাৎ রোগী তিনজন মিলে রাতভর এম্বুলেন্সে তিন-চারটা হাসপাতাল ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হল। ৩/৪ দিন পর এই ঘটনা তার বড় ছেলে শুনে উত্তর দিয়েছিল এরকম যে, তার ( মায়ের) কি অসুখ হয়েছিল যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাবে! অর্থাৎ তার ধারণা ছিল তার মা অসুস্থতার নামে নাটক করছে। অথচ এরপর এখন এই ছেলে তার মাকে হাসপাতাল থেকে নিজ বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বসে আছে। বিগত দশ বছরেও এই ছেলে তার মাকে নিজের বাসায় নিতে পারেনি। আজ অসুস্থ মা এই ছেলের বাসায় যাবে কি যাবে না সেটা আমি বলছিনা। সেটা পাঠকের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিলাম।
পুঁজি মানুষের সহজ সরল জীবনকে কতো জটিল করে দেয় ! সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ এখন পুঁজির দাসে পরিণত হয়েছে ।
– শামা আরজু, লেখক