আজকে অধ্যাপক ইমতিয়াজের সাক্ষাতকার পড়লাম প্রথম আলোতে। জানতাম না, এমন অত্যাশ্চার্য অনেক কিছু জানাও হলো। দুটো উদাহরণ দেয়া যাক।
১. বাংলাদেশে গুম এবং মার্কিন গুম নিয়ে। অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেছেন “একটি দেশে এত বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে, সে আবার অন্য দেশের সমস্যা নিয়ে কথা বলছে, এটা রাজনৈতিক বিষয় না হয়ে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে গুমের সংখ্যা বিপুল। ”
বাংলাদেশে সরকারী বাহিনীগুলোর হাতে গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে মার্কিন গুমের তুলনায় মনে হবে সেদেশের বাহিনীগুলোও নিজের দেশের নাগরিকদের এভাবে গুম বা খুন করে। আসলেই আমার জানা ছিল না মার্কিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের নাগরিকদের এত এত গুমের অভিযোগ সাম্প্রতিককালে আছে।
আপনাদের জানা ছিল কী?
২. “ক্যাপিটল হিলের ওপর যে হামলা হলো, তাতে বিশ্বজুড়ে মার্কিন গণতন্ত্র একটি কার্টুনে পরিণত হয়ে পড়ে। এটা তো অস্বীকার করলে চলবে না। এটা অন্য কোনো দেশে হলে তার পেছনে একেবারে ব্যর্থ রাষ্ট্র তকমা জুড়ে দেওয়া হতো।”
ক্যাপিটল হিল ও তার সাথেকার ঘটনাবলিতে পৃথিবীর যে কোন নির্বাচনী গণতন্ত্রের একটা অনিবার্য সঙ্কটের চিত্র আছে, এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু মার্কিনীরা যেভাবে সেগুলোকে সামলেছে, তাকে কি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা জুটবে তাদের, নাকি তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিমত্তা এবং নির্বাচনী গণতন্ত্রের গভীরতা প্রকাশ পায়?
আপনাদের কী মত এ বিষয়ে?
অধ্যাপক ইমতিয়াজকে বিব্রত করতেই যেন বা, দুদিন আগে তাহসান বললেন, ওই প্রথম আলোতে সাক্ষাতকারেই, যাদের অনুরোধে ইভ্যালিতে গিয়েছিলেন, তাদের নাম বললে তো দেশেই থাকতে পারবেন না।
এই রকম একটা কথা এমনকি প্রতিবেশী ভারত বা পাকিস্তানের বাস্তবতা বলে মনে করেন আপনারা? যেখানে বসে মার্কিনী গণতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে আলাপ চলতে পারে নিজের দেশের সঙ্কটের আলাপ বাদ দিয়ে?
কয়েকজন ব্যক্তির ওপর মার্কিন অবরোধের তাৎপর্য নিয়ে আলাপের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সঙ্কট আদৌ কোনভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে? নাকি প্রধান প্রসঙ্গ হবার কথা কিভাবে একটা রাষ্ট্রের সরকার জনপ্রতিনিধিত্বহীন হলে বাইরের সমর্থন ও বৈধতা পাবার জন্য তাকে বহুক্ষেত্রে অযাচিত সব ছাড় দিতে হয়, দেশের স্বার্থকে ছেড়ে কথা বলতে হয়?
যেমন বাংলাদেশ ভারতকে প্রায় বিনা বাধায় ট্রানজিট দিয়েছে, পানি নিয়ে প্রায় কথা বলছে না, চীনকে দিয়েছে কল্পনাতীত পরিমানে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা। রাশিয়া। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নীতিকে তো মনে হয় সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন না তুললে যে কাউকে যে কোন কিছু দিতে রাজি আছে তারা।
কতিপয় ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসলেই হয়তো বোঝা যাবে না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী চায়। বরং এই নিষেধাজ্ঞার চরিত্রটা আসলে কী, লোক দেখানো, মানবাধিকার গ্রুপগুলোকে ঠাণ্ডা করা নাকি চাপে ফেলে আরও বাড়তি কিছু আদায় তারা করতে চায়, সেটা সামনের দিনে তাদের সুস্পষ্ট কর্মসূচিগুলো দেখেই বুঝতে হবে।
কেননা একটা বিষয় খুব পরিস্কার, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সাথে পশ্চিমা স্বার্থের যা সম্পর্ক, সেটা অত্যন্ত গভীর। আবার বর্তমান সরকারের ভিত্তিও এরাই। স্বার্থে সামান্য পরিমানে আঘাত লাগলে বা তা ক্ষুন্ন হবার সম্ভাবনা দেখা দিলেও এই মানুষগুলোই সরকারকে পথে নামিয়ে দেবে। শুধু পোষাক শিল্পের স্বার্থের কথাই ভাবা যাক, এই খাতে চাপ দিয়ে পশ্চিমারা প্রায় যে কোন কিছু আদায় করে নিতে পারে। ফলে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চিত না হলেও সংশয় বোধ করি পশ্চিমাদের এই সব নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির গভীরতা নিয়ে।
একটা দেশ তখনই নিজের পায়ে দাঁড়াবার গর্ব করতে পারে, যখন তার অর্থনৈতিক খাতগুলো থাকে পরের ওপর এমন একতরফা নির্ভরশীলতা মুক্ত। বাংলাদেশের বেলায় সেটা বলবার আদৌ কোন উপায় নেই। বরং অধ্যাপক ইমতিয়াজের সাক্ষাতকারেই আমরা দেখবো যে কোন একটা পরিস্থিতি সামলে নেয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি বলি, আত্মপ্রবোধ বলি, দেয়া আছে: এখন চীনেরও অনেক টাকা!
কী কী লক্ষ্য অর্জনের জন্য মার্কিনীরা এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা আসলে এখনো স্পষ্ট না। আমরা এখনো জানি না কী কী শর্তে দরকষাকষি করবে সরকার তাদের সাথে। কিন্তু “চীনাদেরও এখন অনেক টাকা”, এই রকম আত্মপ্রসাদ জাতিকে ভুলিযে রাখা ছাড়া আর কী! কেননা মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় যে সব দেশে কাজ হয়, সেদেশের ধনীদের, ক্ষমতাশালীদের, আমলাতন্ত্রের প্রধান ব্যক্তিদের এবং বিশেষত চোরদের অর্জিত সব অর্থ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার করায়ত্তে থাকে। এমনকি তারা তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের বাসভূমি হিসেবেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার মত দেশগুলোকেই অগ্রাধিকার দেয়, অধ্যাপক ইমতিয়াজের ভাষ্য মোতাবেক দেশটিতে যতই ‘গুম’ ইত্যাদি হোক না কেন। এটা কি রীতিমত স্পষ্ট না যে এই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিতে গরিব শরিকের ক্ষমতাবানরা পুরোপুরি জিম্মি দশাতেই থাকে? তাদের সকল অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকে একদমই নাজুক দশায়? এবং এই ক্ষমতাবান অংশ নিজেদের স্বাভাবিক স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য যে কোন সরকারের ওপর থেকে নিমিষে তাদের আনুগত্য বদলে ফেলবে।
ফলে এখনও পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা একটা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যবস্থা। এমন কিছু আরোপ করার বহুরকম কারণ থাকতে পারে, যেটা অধ্যাপক ইমতিয়াজ নিজেও বলেছেন। কিন্তু কী কী সম্ভাব্য কারণ, সেটা অবশ্য এই সাক্ষাতকারে নাই। কয়েকটা বিকল্প সম্ভাবনা আমরাই অনুমান করতে পারি:
১. এটা বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের চাপের কারণে ঘটেছে।
২. এটা ২০১৪ থেকে অনির্বাচিত সরকারটিকে সীমিত চাপে রেখে পছন্দনীয় ভূমিকা রাখতে বাধ্য করার কৌশলের অন্তর্ভূক্ত।
৩. এটা বাংলাদেশে ধূমায়মান অথচ এখনো চাপা গণঅসন্তোষ বিষয়ে দূরবর্তী অনুমানের প্রেক্ষিতে আগাম মার্কিন পদক্ষেপ।
এসবের বাইরেও আরও বহু কারণ থাকতে পারে, কিংবা একত্রে অনেকগুলো কারণ যুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু এটা খুবই স্পষ্ট যে, দেশের ভেতরে গণতন্ত্রের সংগ্রাম শক্তিশালী না হলে গুটিকয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে কোন দেশে গণতন্ত্র আসে না। এমনকি বাইরে থেকে চাপ দিয়ে সরকার ফেলে দিয়েও গণতন্ত্র আসে না, অজস্র দেশে তার উদাহরণ আছে। বরং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী হতে হয় ভেতর থেকে, জনগণের মধ্য থেকে।
দেশের ভেতরে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন তৈরি না হলে আমরা বুদ্ধিজীবীদের লাগাতার মোসাহেবিও যেমন দেখবো, তেমনি দেখতে পাবো আমাদের দেশটাকে নিয়ে নানান আন্তর্জাতিক খেলাধূলাও। তাতে ক্ষণে আশা জাগবে, ক্ষণে হতাশা জাগবে, কিন্তু মূল চাবিকাঠি রয়ে যাবে পরের হাতে।
– ফিরোজ আহমেদ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংগঠক