স্বাধীনতার পর আমার গ্রামের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাম এখন চেনাই যায়না! কিছু রাস্তা পাকা হয়েছে, অনেকের বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে। গ্রামের লোকেরা সকালে বাড়িতে জাউ ও তেতুলের গুড় খাওয়া ভুলেই গেছে। অনেকেই ফজরের নামাজের পর মোড়ের রেষ্টুরেন্টে যেয়ে চা পরাটা খায়।
আগে গ্রামে দুইটা মসজিদ ছিলো এখন হয়েছে আঠারোটা।
আরও নাকি হবে তার তোড়জোড় চলছে। আমাদের এলাকায় পঞ্চাশ গ্রামের ভিতর মাত্র একটা মাদ্রাসা ছিলো। এখন আমাদের গ্রামেই দুইটা মাদ্রাসা। আগে গ্রামে এতো হুজুর দেখা যেতোনা। তখন মাত্র দুইজন হুজুর ছিলো। খোরাসানের কানা হাফেজ অস্থায়ী। তিনি ধানের সিজনে আসতেন ধানের বদলে ছেপারা পড়াতেন। আর একজন ছিলেন মাওলানা আব্দুস শাকুর। খোরাসান হচ্ছে পশ্চিমের পশতুভাষীদের একটি এলাকা। কান হাফেজ সাহেব অতোমুল্লুক ঠেঙ্গিয়ে এই কাদামাটির গাঁওগ্রামে আসতেন ক্ষুধার তাড়নায়।
শাকুর মাওলানা বেঁচে থাকতে হাই ইশকুলের সামনে আমাদের শহীদ মিনার করতে দেননি। তিনি পাকিস্তান আমলে ইউনিয়ন পিস কমিটির সভাপতি ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হন।
আর যেসব হুজুর রোজা ও মহাফিল উপলক্ষে আসতেন তাঁরা সব নোয়াখালি, কুমিল্লার দিক থেকে আসতেন। এই অঞ্চলে তখন হুজুরের আকাল ছিলো। এখন হুজুরের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। হুজুরেরা মসজিদের দখল নিয়ে বোমাবাজিও করে। আবার মাজহাব নিয়ে লাঠালাঠি চলে।
আগে গ্রামের ছেলেরা লুকিয়ে-চুরিয়ে বিড়ি-সিগারেট খেতো, মাঝেমধ্যে হুক্কাও টানতো। এখন কয়েকটা মোড়ে
ছেলেরা প্রকাশ্যে গাঁজা খায়। রাত হলে বাংলা মদ, হিরোইন খায়। তরুন দুইটা ছেলে ভেজাল মদ খেয়ে মারা গেছে আর একটা ছেলে নেশায় উন্মত্ত হয়ে খালে ডুবে মারা গেছে। আমাদের গ্রামের মানুষের প্রধান কাজ ছিলো কৃষি,মাছ ধরা। এছাড়া প্রায় চারশত লোক রূপসা শিল্প এলাকার দাদা, ইস্পাহানি ম্যাচ ফ্যাক্টরি, কোকোনাট প্রসেস মিলে শ্রমিকের কাজ করতো। এখন সেসব কলকারখানা বন্দ। কিছু মাছ কোম্পানী হয়েছে। সেগুলো
নিয়মিত চলেনা। এই এলাকার মেয়েরাও সেখানে কাজ করতে
যায়না। উন্নয়নকালে নতুন আর কোনো বড়ো কলকারখানা আশেপাশে গড়ে ওঠেনি। তবে একটা রেলওয়ে ব্রিজ হচ্ছে। এসব কাজের ইঞ্জিনিয়র শ্রমিক সব অন্যান্য এলাকার। তাই নতুন করে মানুষ শ্রমিক হতে পারছেনা। অনেকেই কাজের সন্ধানে ঢাকায় চলে যাচ্ছে। তবে রূপসা ব্রিজ ও হাইওয়ে আমাদের গ্রামের মাঝখান দিয়ে যাওয়ায় জমির দাম খুব বেড়ে গেছে। কিছুমানুষ জমি বেঁচে ইলিশমাছ ও কাঠাল খাচ্ছে। মেয়ের বিয়ের যৌতুক দিচ্ছে। জমি চাষ করা, খেজুরগাছ কাটা, গাছ থেকে নারকেল পাড়া এসব কাজের জন্য লোক পাওয়া যায়না। জমি চাষ ও মাছ ধরার কাজ কেউ করতে চায়না।
মানুষ এখন জমির দালালী, চাঁদাবাজি, সরকারি দল করা, ভাড়ায় মাস্তানি, মাদ্রাসা মসজিদের চাঁদা তোলা, চরমোনাইয়ের মুরিদ হয়ে জিকির করে লাফিয়ে গাছে চড়া, হিরোইন গাঁজা বিক্রি এই ধরণের কারিশমাটিক পেশা বেছে নিচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ডিজিটাল উন্নয়ন কালের ফাল্টুকুলুস পেশা।
– হারুন রশীদ, খুলনা