কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আন্দোলন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বুড়ো ভামেরা ফেসবুকে দুই ভাগে বিভাজিত হয়। সরকারের সহমত ভাইয়েরা চায়, কোন আন্দোলন নয়, নিশ্চিন্তে ফইন্নি থেকে ধনী হবার শাসনযন্ত্রটি কোনরকম প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ছাড়াই চলতে থাকুক। আর সচেতন অংশটি চায়, তরুণেরা এই স্বৈরাচারের পতন ঘটাক। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা পুলিশকে ফুল দিয়ে দানব থেকে মানবে রূপান্তরের চেষ্টা করায়; অনেকে যুক্তি দেখালেন, আগের দিন যারা দানবের মতো পেটালো; তাদের ফুল দেয়া অর্থহীন।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শেষ বছরটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। এই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা শফি আহমেদ ভাই আমাকে মিছিলে নিতে নিষেধ করেছিলেন; বলেছিলেন, ও পড়াশোনা আর লেখালেখির ছেলে। সবাইকে সম্মুখ সমরে অংশ নিতে নেই। পেছনের বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গার লোক হিসেবে ওকে গড়ে উঠতে দাও। আমার বন্ধু আহকামউল্লাহও আমার চোখে আমার চেয়েও বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তার মানুষ। কিন্তু আহকাম সম্মুখ সমরে থাকতো। আমি এরশাদ বিরোধী বিক্ষোভে যেতে চাইলে ও বলে দিতো, দোস্ত পুলিশের দৌড়ানি খাইয়া নিজেরা দৌড়ায়া কূল পাইনা; তোরে নিয়া গেলে উদ্ধার কইরা আনা কঠিন হবে। ফলে আমি রয়ে গেলাম সফট মুভমেন্টের লোক হিসেবে। কিন্তু যেদিন ডা মিলন শহীদ হলেন, শোক আমার ঘরে উপস্থিত হলো। ডা মিলন ছিলেন আমার বন্ধু রোমেলের বড় ভাই। রোমেলের বাসায় ভাবী, ভাতিঝি, খালাম্মার কান্নার রোল শুনে আমার মনে হলো, একাত্তরে তিরিশলাখ মানুষ প্রাণ দেবার পরেও এই স্বাধীন দেশে আর কতো রক্ত চাই!
সময়ের স্রোতে এটা প্রমাণিত হলো, এরশাদের স্বৈরাচার সরিয়ে খালেদার স্বৈরাচার আর তা সরিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারই আমাদের নিয়তি। রাজনীতিকরা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা আর নিজের মসনদের ব্যবস্থা করতেই তরুণদের ব্যবহার করে। ডা মিলনের পরিবারের কতটুকু খোঁজ আমরা রেখেছি; আমরা শফি আহমেদের মতো সৎ ও জনপ্রিয় নেতার কতটুকু মূল্যায়ন করেছি! বরং ব্যবসায়ীদের সংসদে এনে টেকাটুকার বুলবুলি আখড়াই বসিয়েছি। আহকাম উল্লাহ’র মতো মেধাবী তরুণের কতোটুকু মূল্যায়ন হয়েছে এ দেশে। সব আত্মত্যাগ বৃথা গেছে; শুন্য থেকে আমরা শুন্যতর অর্জনের দিকে ধাবিত হয়েছি।
এ কারণে আমি বুড়ো ভামদের মসনদ দখলের জন্য তারুণ্যের ব্যবহারকে ঘৃণা করি। তরুণরা নিজেদের দাবীতে, নিজেদের প্রয়োজনে আন্দোলন করবে আর সেটা হবে অহিংস পদ্ধতিতে। অহিংসার চেয়ে বড় কোন শক্তি নাই। কাজেই ফুল খেলবার দিনই অদ্য।
দানবের রক্ততৃষ্ণার প্রতিশোধ ইতিহাস নেয়। এরশাদের নামটির সঙ্গে মিশে যায় তাই নূর হোসেন-মিলনের রক্ত। খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণে ২০০১-এর নির্বাচন পরবর্ত্তী সহিংসতার শিকার পূর্ণিমা শীলের নামটি মনে পড়ে। আর শেখ হাসিনার নামের সঙ্গে মিশে থাকে লেখক মুশতাকের নাম।
শাসকেরা এই নির্মম বাস্তবতা উপলব্ধি করতে চায় না। সৌদি যুবরাজ এম বি এস সৌদি আরবকে যতই আধুনিক করে তুলুক; সাংবাদিক খাশোগজীর রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে তার নামটি। ইতিহাস এই ঘৃণা-পদক নির্দিষ্ট রেখেছে খুনে স্বৈরাচারি শাসকদের জন্য।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকদের দলীয় দালালি ও নিকৃষ্ট আচরণের ব্যাপারে দুটি কথা বলা যাক। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে লীগ অথবা বিএনপির বুদ্ধি আবর্জনার স্তুপ থেকে তুলে এনে এতোগুলো শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ তার কথা-বার্তায় বিকৃতি; নিজের সন্তানতুল্য ছাত্রীদের নিয়ে তার যে মন্তব্য, ঐটিই তার জাত চিনিয়ে দেয়। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীহলের যে শিক্ষিকা ছাত্রীদের জীবনকে তেতো করে দিয়েছে; তার সাংস্কৃতিক মান অত্যন্ত নিম্নগামী। এরকম শিক্ষিকা এর আগে শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে চোখে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত মৈত্রী হলেও চোখে পড়েছে। এই মহিলাগুলো তো আচার আচরণই শেখেনি। পার্লার থেকে চুল কেটে এসে ফিটফাট হয়ে ঘুরলেও এদের মনের সদরঘাট বেরিয়ে যায় মুখ খুললে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে এসব নমুনা বেশি চোখে পড়ে। বঙ্গবন্ধু পদায়নের জন্য খুঁজতেন যোগ্য অগ্রসর চিন্তার মানুষ। আর তাঁর মেয়ে খোঁজেন অনুগত দাসানুদাস। এই দাস উপনিবেশের পীড়নে দেশের প্রতিটি নাগরিক আজ প্রজায় রূপান্তরিত হয়েছে। গত দশ বছরে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরেরা স্বদেশ বলতে পেলো ভীতির ভূখণ্ড। সরকারি হেলমেট আর হাতুড়ি বাহিনী, পুলিশ কিংবা ছাত্রলীগের বেশে রক্তাক্ত করে চলেছে এই জনপদ। এর বিপরীতে ছাত্র-ছাত্রীদের ফুলের প্রতিবাদ স্বপ্নদায়ী। এই গানের দেশ কবিতার দেশের আলো এখনো নিভে যায়নি; দৈত্য-দানব-রাক্ষসের অবরুদ্ধ অন্ধকার ভূখণ্ডে অমল কিশোরের হাতের তালুতে অবাক সূর্যোদয় ঘটতে থাকে।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক