পৃথিবীর যে জনপদে থেকেছি; যাপিত জীবনের ক্লেদ থেকে মুক্তি পেতে আমি নর্তকীর কাছে ছুটে গেছি। মম চিত্তে নিত নৃত্যে কে যে নাচে! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছি।
আমার শৈশবে আমার আম্মার সমান্তরালে আমার রুনি খালা আমার জীবনের প্রথম ছয়-সাতটি বছর আমাকে সন্তান স্নেহ দিয়েছেন। আম্মা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স মাস্টার্স করার সময় রুনি খালা ছুটে আসতেন পাবনা থেকে। পাবনা সুচিত্রা সেনের শহর; সেখানেই উইমেনস কলেজে রুনি খালা পড়তেন। ইমেডিয়েট বড় বোনের উচ্চশিক্ষা অর্জনের জার্নিটি সহজ করতে উনি বোনের বাসায় আসতেন, তাঁর ভাগ্নে পাভেলকে মাতৃস্নেহ দিতে।
উনি আমাকে পড়াতেন, স্কুলে নিয়ে যেতেন; আর আমি শিশুকাল থেকেই জীবনের বৈচিত্র্য খুঁজতাম। তাই উনি আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন পাকশীতে; উনার বান্ধবীর বাবার পদ্মা নদীর ধারে বৃটিশ আমলে নির্মিত রেলের বাঙলো ছিলো। ঈশ্বরদী থেকে ফ্রি ট্রেন রাইডে যেতাম প্রাচীন রেলশহর ঈশ্বরদীর আউটস্কার্টে পর্যটন আকর্ষণ পাকশীতে। সেখানে রুনী খালা তার বান্ধবীদের সঙ্গে গান গাইতেন, আলো আমার আলো সে যে আলোয় জীবন ভরা কিংবা আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো তবু, আমারে দেবোনা ভুলিতে।
আনতালিয়ার কনিয়েতে হুইরলিং ডারভিশের হৃদয় নগরীতে গিয়ে দেখলাম; সেখানকার মেয়েরা রুনি খালার মতো দেখতে; তাদের উচ্ছ্বল কথা বলার ভঙ্গিতে রুনি খালা। তাদের হুইরলিং ডারভিশ নৃত্যে রুনি খালার মুদ্রা।
আমি আমার নানা ও বুড়াম্মা (নানা’র মা)-র সঙ্গে অনেক আড্ডা দিয়েছি। বুড়াম্মা বলেছিলেন, তাঁর বিয়ে হয়েছিলো হানাফি সম্প্রদায়ের ইয়াসিন সরকারের সঙ্গে। এই সরকার সম্প্রদায়ের লোক পারস্য থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় অভিবাসী হয়েছিলেন।
এই যে আজকাল দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ যেমন পৃথিবীর নানা জায়গায় অভিবাসী হয়। দক্ষিণ এশিয়া তখন ভূ-স্বর্গ ছিলো। ফলে আফ্রিকা, পারস্য, মধ্য এশিয়া আর দূরপ্রাচ্য থেকে চারটি অভিবাসন ঢেউয়ে মানুষ বসতি গড়েছিলো। ডিএনএ পরীক্ষা করে; এই চার এলাকার মানুষের উপস্থিতিই দক্ষিণ এশিয়ায় ধরা পড়েছে। তাই সান অফ দ্য সয়েল বলে রাজনীতিতে “থাগস অফ বেঙ্গল সাজতে চায়” তারাও এই চারটি অঞ্চল থেকে আসা। দীর্ঘ গবেষণা করে; ডিএনএ বিশেষজ্ঞরা এই ফলাফল পেয়েছেন।
পারস্যে হানাফি ও হেদায়েতি সম্প্রদায়ের মাঝে মতপার্থক্যের কারণেই রুমী তুরস্কের আনতালিয়ায় গিয়েছিলেন শিক্ষকতা আর লেখালেখি করে কনিয়ের হৃদয় নগরীতে আনন্দময় সৃজনশীল সময় কাটাতে। রুমীর বাবা ছিলেন হানাফি সম্প্রদায়ের আর মা ছিলেন হেদায়েতি সম্প্রদায়ের। হেদায়েতিরা আবু বকর সিদ্দিকির ক্ল্যানের লোক।
বুড়াম্মা নূরবাহার সরকারের বাবা সোলায়মান সরকার ছিলেন হেদায়েতি। উনি তার হানাফি দর্শনের জামাইয়ের লাইফ স্টাইল খুব পছন্দ করেননি।বুডাম্মার দুই ছেলের মাঝে বড় ছেলে পুরোপুরি বাবার মতো। আনন্দের মাঝ দিয়ে খোদার কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। আর উনার ছোট ছেলে কিছুটা বাবার উদারপন্থার সঙ্গে মায়ের কড়া শৃংখলা মেশাতেন। দুই ছেলের অভিনীত “বিষাদসিন্ধু” থিয়েটার দেখতেই নূরবাহার বেশ রেশমি শাড়ি পরে দর্শকের সারিতে বসে মিটমিট করে হাসতেন। বড় ছেলের বউ তার পাশে বসে লাজুক হাসি হাসতেন।
রুনি খালা হুবহু তাঁর বাবার স্বভাব পেয়েছিলেন। আনন্দের মাঝ দিয়ে খোদার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। সম্পন্ন পরিবারের স্বামী আছে তার; তবু নিজের জনপদে “পরিবার পরিকল্পনা” প্রচারণা চালিয়েছেন। এজন্য পুরস্কার জিতেছেন। তিনি সবাইকে নিজের দুটি ছেলে রবিন আর রাসেলকে দেখিয়ে এলাকার নারী-পুরুষদের বোঝাতেন; আমার জমির চালে দশটি বাচ্চাকে খাওয়াতে পারি; কিন্তু আমি দুটি সন্তান নিয়েছি; ওদের পরিকল্পিত ভবিষ্যতের জন্য। উনার স্বামী মিন্টো পাকিস্তান আমলে নাটোর কলেজে ছাত্রলীগের ভিপি ছিলেন। উদারপন্থী স্মিতভাষী মানুষ। তাই মন্ডলবাড়ির বউ কেন রাস্তায় ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর প্রচারণা চালাবে, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি তাঁর চাচিকে বলেছিলেন, এটা রুনির ইচ্ছার স্বাধীনতা। উনার চাচা ইপিসিএস কর্মকর্তা মন্ডল সমর্থন করেছিলেন, ছেলের বউয়ের লিবেরেলিজম।
কিন্তু দাদি নূরবাহার রুনি খালাকে বলেছিলেন, গান কর, কিন্তু নাচানাচির দরকার নাই।
পরিবারের মাঝের এইরকম সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বই আমরা সমাজে ও রাষ্ট্রে দেখি। এটা আসলে পারিবারিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্বের বেশি কিছু নয়। মানুষের সংস্কার-কুসংস্কার লেখা আছে তার ডিএনএ মানচিত্রে। সেটাকে সংশোধন পরিশোধনের মাধ্যমেই ইতিবাচকতা আসে, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা আসে; গণতান্ত্রিক ও নৈতিক মূল্যবোধ আসে। সত্য-সুন্দর-মঙ্গল চর্চার তাগিদ থাকে ডিএনএ-তে।
যেমন আমার আব্বা চাইতেন আমরা পাশ্চাত্য ধারায় বড় হই দুইভাই। আম্মা চেয়েছেন প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মিশেল। তাই আমার সামান্য খুশিজল পানে আব্বার কখনো কোন আপত্তি ছিলো না। কিন্তু আম্মা বিরক্ত হতেন। মা কোন কিছু অপছন্দ করছেন জানলে; ছেলে বাড়তি কেয়ারফুল হয়। আর সেখানে ঘটে যায় ট্র্যাজি- কমেডি।
আমার জীবনে মাত্র দুবার খুশিজল পান করে একটু কার্ল মার্কসীয় ভাষণ দিয়েছি ড্রইং রুমের সোফায় বসে; সেটা আব্বা-আম্মা আর রুনি খালার সামনে। আব্বা পরে ফোন করে বলেছেন, তুমি টিপসি হলে সমাজতন্ত্রের কথা বলো, এটা কিন্তু বেশ মজার ব্যাপার। আম্মা অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন, আব্বাকে অভিযোগ করেছিলেন, কীসব খায় ছেলেটা! আমার ভয় ছিলো, রুনি খালা এটা নানার বাড়িতে ব্রডকাস্ট করেন কীনা! কিন্তু কনিয়েতে এসে তাঁর মতো নারীদের দেখে আমি নিশ্চিত; উনি এতো ছোট খাটো বিষয় নিয়ে বিচলিত নন।
রুনী খালা মনের আনন্দে নাচতেন-গাইতেন; শৈশব থেকে উনার ব্যক্তিত্ত্বের দৃঢ়তা দেখে আমি বুঝে ফেলি, যারা নাচে, তারা কেবল নিজের আনন্দের জন্য নাচে; হুইরলিং দরবেশ যেরকম পার্থিব মোহমায়া ভুলে নাচতে থাকেন।
এ কারণেই ঈশ্বরদী ভোজপুরী নর্তকী থেকে ঢাকার নর্তকী, লন্ডন, মাল্টা, সাইপ্রাস, ক্যাসাব্লাংকা, আফ্রিকা, ব্রাজিল, বলিভিয়া, জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ, ফ্রান্স, কায়রো, কলকাতা, করাচি দিল্লি, চেন্নাই, রাজস্থানের নর্তকীর নৃত্য দেখেছি; আর সম্প্রতি দেখলাম তুরস্ক, সিরিয়া লেবাননের নর্তকীর নাচ। আমার ধারণা বিশ্বের প্রায় সব দেশের নর্তকীরই নাচ দেখা হয়েছে সমবেত নৃত্যগুলো সামনে বসে দেখার অভিজ্ঞতায়। প্রত্যেক নর্তকীর সঙ্গে এক মিনিটের জন্য হলেও কথা বলেছি, এই নাচটা সে মনের আনন্দে জীবনের প্রয়োজনে নেচেছে; নাকি জীবিকার প্রয়োজনে! উত্তর একটাই, জীবনানন্দে নেচেছি।
সিভিল সার্ভিসে কাজ করার সময় টাঙ্গাইলের ভুঁইয়াপুর গ্রামে বাংলাদেশ বেতারের একটি লাইভ কনসার্টের আয়োজক হিসেবে, স্টেজের কোণায় দাঁড়িয়ে হঠাত দেখি, লালনের “মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষেরো সনে” গানের সময় গ্রামের এক মাঝবয়েসি নারী দর্শক দাঁড়িয়ে হুইরলিং ডারভিশের মতো আকাশ পানে তাকিয়ে নাচছেন; সব দর্শক তাকে এপ্রিশিয়েট করছে; এই হচ্ছে আমার জাদুবাস্তবতার আনন্দময় ডেল্টা।
ইস্তাম্বুল ছাড়ার আগে আমার স্ত্রী বলছিলো, আমার মনে হয় তুমি তোমার ফরাসি সাংবাদিক বন্ধু উদের সঙ্গে সেটল করার চেষ্টা করলে ভালো করতে। তা না করে তুমি উত্তর প্রদেশের মেহেনগাঁও-এর এমন এক ফ্যামিলিতে বিয়ে করেছো, যেখানে নৃত্যগীতের চর্চা নেই। এরা নেহাত দর্শক শ্রোতা। জানো, নার্গিস আমাদের চাইলি পরগণার মেয়ে আমার দূর সম্পর্কের ফুফু, উনি ফিল্মে নামায়, পরিবারের লোকেরা মেনে নেয়নি।
আমার স্ত্রীর শোয়েব মামাও ইসলামাবাদে একই কথা বলেছিলেন, এই ছেলে তুমি ফরাসী বান্ধবীর সঙ্গে সেটল না করে কেন এই ব্যাকওয়ার্ড এলাকার মেয়ে বিয়ে করলে!
আমার শ্বশুরও এক দুপুরে আমার শাশুড়ির সামনেই হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ইউরোপের সুরা ও সাকি ফেলে কেউ জিয়াউল হকের তৈরি ওয়েস্টল্যান্ডে আসে নাকী! আমি তোমার মতো সুযোগ পেলে ফরাসি কিংবা গ্রীক মেয়ের সঙ্গে সেটল করতাম।
আমার শাশুড়ি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ইমতিয়াজ উল্লাহ সাহেব, এখনো সুযোগ আছে; ফ্রান্স কিংবা গ্রিসে গিয়ে আবার নতুন জীবন শুরু করো। ছেলে-মেয়ে সবাই বড় হয়েছে; এ বাড়িটাও আমার নামে করে দিয়েছো; এখন বাকি সঞ্চয় নিয়ে জীবনের শেষ স্বপ্ন পূরণ করো। আমি হ্যাপিলি তোমাকে পারমিশান দিচ্ছি।
আমার মনে হয়েছে; জীবন আসলে ঘর ও বারান্দা। ঘরে মানুষ পার্থিব জীবন যাপন করে; আর বারান্দায় যায় স্বর্গের অভিলাষে। পার্থিব জীবনের সঙ্গী স্ত্রী আর স্বর্গের জীবনের সঙ্গী নর্তকী; চিন্তক হবস এভাবেই ভেবেছিলেন।
প্রতিদিনের যাপিত জীবন হচ্ছে সোসাইটি; আর হৃদয় মুক্তির অন্বেষণ হচ্ছে সাবসোসাইটি; জলসাঘর।
গুড়িয়াঃ দ্য উইরলিং ডারভিশ, আমার ইংরেজি উপন্যাসের নাম; বলা যায় প্রায় তিনদশক দশক ধরে এই উপন্যাস লেখার প্রস্তুতি নিয়েছি। হুইরলিং ডারভিশের হৃদনগরী ঘুরে আসার পর নিজেকে প্রস্তুত মনে হচ্ছে, উপন্যাস লেখার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবার জন্য।