একজন মানুষের মৃত্যুর পর সাধারণ মানুষ তাঁকে যেভাবে মূল্যায়ন করেন; সেটাই তার জীবনের গড়ফল। ছোটবেলায় একটা লোকজ প্রবচন চোখে পড়তো, এমনি করে গড়তে হবে জীবন; মরণে হাসবে তুমি, কাঁদবে ভুবন।
বাংলাদেশের সোনালী যুগের দিকচিহ্নগুলো ধীরে ধীরে মুছে যাবার সময় এটা। আবুল মাল আব্দুল মুহিত আজ চলে গেলেন নিঃসীম অন্যলোকে। তাঁর চলে যাবার লক্ষণ চোখে পড়েছে; হাসপাতালের বিছানায় কমলালেবুর বিষণ্ণতার ম্রিয়মান দিনগুলো দেখে। সিলেটের সাংবাদিক বন্ধু মুক্তাদিরের ফেসবুক ডায়েরিতে মুহিত স্যারের চলে যাওয়ার প্রস্তুতির মন খারাপ চোখে পড়েছিলো।
২০০৮ সালে মুক্তাদিরের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে মুহিত স্যারের সঙ্গে দেখা। উনি এসে উষ্ণ আলিঙ্গনে সিলেটে স্বাগত জানান। কমলালেবুর দুপুরে নক্সী পাঞ্জাবি পরা বাঙালি পিতার অবয়বে তাঁকে দেখে এতোটা পথ ঠেলে সিলেটে যাবার ক্লান্তি জুড়িয়ে যায়। উনি পাতে খাবার তুলে দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এই উষ্ণ আপ্যায়নই তো মমতাময় বাংলাদেশ। টানা একঘন্টা তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন অতিথি আপ্যায়নে; আমার ভীষণ সংকোচ হচ্ছিলো।
ফেরার সময় জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিস ফিস করে বলেন, স্যার বলছো কেন আমাকে! আমিও ফিস ফিস করে তাঁকে বললাম, ছাত্রজীবনে আপনাকে ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট থিয়েটারের দাওয়াত দিতে গেলে, টানা দেড় ঘন্টা লিটেরেচার পড়িয়েছিলেন, সেই থেকে আপনি আমার শিক্ষক।
জার্মানির ডয়চেভেলেতে উনার ছোট ভাই মোমেনকে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ধারাবাহিক আয়োজনে যুক্ত করতে গিয়ে, একটি দিনও পাইনি; যেদিন উনি হেসে সাদর সম্ভাষণ জানাননি।
এটি বাংলাদেশের শিষ্টাসম্পন্ন পরিবারগুলোর একটি। সমাজ যতই কর্কশ হোক না কেন; মুহিত-মোমেনের তাতে কিচ্ছু এসে যায়নি। তারা শেষ পর্যন্ত শৈশবে পরিবার থেকে শেখা শিষ্টাচার ধরে রেখেছেন।
এই ধূসর মোহরের যুগে; মুহিতের উপার্জন কমেছে; মন্ত্রী হবার পরে। বাংলাদেশে যেখানে মানুষ এমপি মন্ত্রী হয় জমিদার হবার জন্য; সেখানে অর্থমন্ত্রী মুহিত গরীব হয়েছেন।
ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট থিয়েটারে একবার টর্নেডো আক্রান্ত গ্রামের মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিলাম। মুহিতের মতো সৎ মানুষের কাছে টাকা চাইতে মন চায়নি। আমন্ত্রণ পত্র দিয়ে বিদায় নেবার সময়, নিজে থেকে টাকা বের করে আমার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলেন, ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট থিয়েটার তার ওপর টর্নেডোহত গ্রামের পুনর্বাসনের মতো একটা মহৎ কাজ; এটা রেখে দাও বালক।
এরকম ঔদার্য্যের সংস্কৃতিবান বাঙালি পুরুষদের স্নেহ সাহচর্যই এ জীবন পূর্ণ করেছে। তার সঙ্গে দেখা হওয়া যেন ছিলো হাসন রাজার সঙ্গে দেখা হওয়া। কখনো যেন সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে দেখা হওয়া। মুহিত মানেই রম্য দুপুর, অসংখ্য রেফারেন্সের ট্যাবলেট রসগোল্লায় পুরে খাইয়ে দিতে দিতে বলা, সাহিত্য পড়ে কেউ যদি সাহিত্য রচনাটাকেই ব্রত হিসেবে নেয়; সেটাই সাহিত্য পড়ার সার্থকতা। বাকিটা আপনি হয়ে যাবে। আরে বাবা তোমরা তো স্বাধীন দেশে সচ্ছল পরিবারে জন্মেছো; আমরা তো জন্মেছিলাম পরাধীন দেশে। সুতরাং তোমাদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং হতে হবে স্বাধীন দেশের ছেলের মতো।
মুহিত পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসে ঢুকলেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে প্রবাসে পাকিস্তান দূতাবাসে বিদ্রোহ করেছেন। নিজেরাই গড়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অধীনে স্বাধীন বাংলাদেশ দূতাবাস।
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃটিশ সেনাদলের মঙ্গল পান্ডের দ্রোহ আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের মুহিতের বিদ্রোহ; দুইটি যুগক্ষণে দুজন দেশপ্রেমিকের জেগে ওঠা।
মুহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পাস করে; শিক্ষকতা থেকে সিভিল সার্ভিসে চলে যান। সেসময় বাঙালি তরুণেরা সিস্টেমের মাঝে ঢুকে পাকিস্তানের বৈষম্য নিরসনে কাজ করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মুহিত যদি ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হিসেবে রয়ে যেতেন, আজ আমরা আরেকজন অধ্যাপক রাজ্জাকের গল্প হয়তো করতে পারতাম।
কিন্তু সিভিল সার্ভিসেও জুনিয়রদের জন্য তিনি শিক্ষকই ছিলেন। এমনকী অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রতিটি বক্তব্য ছিলো শিক্ষকের। যে শিক্ষক এনশিয়েন্ট ম্যারিনারের মতো শেয়ার বাজারের নরভোজি ফাটকা ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে আমাদের সাবধান করেছেন।
হেনরি কিসিঞ্জার আমাদের তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। কেননা বিদেশী সাহায্য ভিক্ষা চেয়ে দেশে নিয়ে এলে, চোরের খনির চাটার দল অর্থের ঝুঁড়ির নীচ থেকে চুরি করে বিরাট চৌধুরী হয়ে পড়েছিলো যুদ্ধাহত দেশে। মুহিত অর্থমন্ত্রী হবার পর চেয়েছেন, আমরা আর কখনো যেন ভিক্ষুক জাতি হিসেবে পরিচিত না হই । বরং ঝুড়ি উপচে পড়লে চেতনার চৌধুরীরা সেকেন্ড হোমে টাকা রপ্তানী শুরু করলে, মুহিত বলেন, চার হাজার কোটি কোন ব্যাপার না! মুহিত জীবনের যে কোন অবস্থায় আশাবাদী থেকেছেন। তার ছোট ভাই মোমেনও সে চেষ্টাটাই করেন। আমরা চুন খেয়ে মুখ পোড়া জাতি; তাই মুহিতের সততার দইকেও মাঝে মাঝে চুন ভেবেছি।
অথচ মুহিতের বার্ষিক আয় প্রতিবছরই কমেছে। দুহাত উজাড় করে দান করা আর ঐ যে আতিথেয়তা-আপ্যায়নের জীনগত ঔদার্য; মুহিত পরোয়া করেননি; পকেটে কিছু অবশিষ্ট রইলো কীনা!
যতবার উনার সঙ্গে দেখা হয়েছে; কমলালেবু থাকতো প্রতিটি আপ্যায়নে। শেষ দেখায় সিলেট থেকে ফেরার জন্য গাড়িতে ওঠার আগেও মুহিত স্যার একটা কমলালেবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে বলেন, এই নাও পথে খেয়ো। যতক্ষণ গাড়িটা দৃষ্টিসীমার ভেতরে ছিলো তাঁর, উনি তাকিয়ে ছিলেন গভীর মমতায়। আজ উনি চলে গেলেন আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। পকেট থেকে ভালোবাসা উনার হাতে দিয়ে বলি, এই নিন, পথের জন্য ভালোবাসা রইলো।